২০ এপ্রিল, ভাওয়ালের রাজপরিবারের মেজকুমার দার্জিলিঙে পৌঁছলেন।
৬ মে, মেজকুমার অসুস্থ।
৭ মে, মেজকুমারের মৃত্যু।
১৮ মে, শ্মশানে সৎকার।

বারো বছর বাদে ঢাকায় সন্ন্যাসীর আবির্ভাব।

ঘটনাচক্র: মৃত্যু

মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী

মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী

ব্রিটিশ আমলের ঢাকা জেলা। জেলার সবচেয়ে বড় জমিদারি ঢাকার নবাব বাহাদুরের এস্টেট। তার পর ভাওয়াল এস্টেট। ভাওয়ালের জমিদার বাড়ি হল জয়দেবপুরে। যে আমলের কথা বলছি, তখনকার জয়দেবপুরকে গ্রামই বলা যায়। এখন অবশ্য জয়দেবপুর ঢাকার উত্তর দিকের শহরতলির অংশ হয়ে গিয়েছে প্রায়। জয়দেবপুর এখন বাংলাদেশের গাজিপুর জেলার সদর। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে জয়দেবপুর ছিল ভাওয়াল এস্টেটের কেন্দ্রস্থল— রাজবাড়ি, কাছাড়ি, হাইস্কুল, সবই ছিল জয়দেবপুরে। আগেই বলেছি, ভাওয়াল বেশ বড়সড় জমিদারি। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সরকারের ট্রেজারিতে খাজনা জমা পড়ত বছরে সাড়ে ছ’লাখ টাকা।

১৯০৯ সালে, যখন এই কাহিনির সূত্রপাত, তখন এস্টেটের মালিক ভাওয়াল রাজপরিবারে তিন ভাই। বড়কুমারের বয়স সাতাশ, মেজর পঁচিশ আর ছোটর বাইশ। তিন কুমারই তখন বিবাহিত, তিন রানি রাজবাড়িতেই থাকেন। কুমারদের তিন বিবাহিতা বোনও সে সময়ে তাঁদের স্বামী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে রাজবাড়িতেই ছিলেন।

মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী

১৯০৯ সালের ১৮ এপ্রিল মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ জয়দেবপুর থেকে ট্রেনে দার্জিলিং রওনা হয়ে সেখানে পৌঁছন ২০ এপ্রিল। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পত্নী বিভাবতী, বিভাবতীর দাদা সত্যেন্দ্র আর একুশ জন পরিচারকের একটি দল। পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাশগুপ্ত ছিলেন সেই দলে। দার্জিলিং যাত্রার কারণ ছিল রমেন্দ্রর স্বাস্থ্য। আসলে বছর তিনেক আগে ধরা পড়েছিল যে রমেন্দ্রর সিফিলিস রোগ হয়েছে। অবস্থা খারাপ হতে হতে শেষ পর্যন্ত হাতেপায়ে আলসারের মতো বড় বড় ঘা দেখা দেয়। গ্রীষ্মে পাহাড়ি দেশের ঠাণ্ডায় তিনি কিছুটা ভাল থাকবেন এই মনে করে দার্জিলিং ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ-কারণে তাঁর শ্যালক সত্যেন্দ্র কয়েক মাস আগেই দার্জিলিং এসে তাঁদের থাকার জন্য একটা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।

দলে বিভাবতী ছাড়া আর কোনও মহিলা ছিলেন না। ঘটনাটা কিছুটা আশ্চর্যের। ভাওয়াল রাজপরিবারের মতো রক্ষণশীল বাড়িতে বিভাবতীর মতো প্রায় সদ্য বিবাহিতা বধূ তাঁর স্বামীর সঙ্গে একা বিদেশভ্রমণে যাচ্ছেন, এ প্রায় অভাবনীয়। পরে যখন এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন জানা যায় যে, সত্যেন্দ্র বলেছিলেন, দার্জিলিংয়ের বাড়িটি ছোট, বেশি লোক নিয়ে যাওয়া যাবে না, তাই বিভাবতীর সঙ্গে পরিবারের আর কোনও মহিলা যাননি। দার্জিলিং সফরের প্রথম কয়দিন নির্বিঘ্নেই কাটে। হঠাৎ ৬ মে মেজকুমার অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরদিন জয়দেবপুর রাজবাড়িতে টেলিগ্রাম আসে, তাতে মেজকুমারের দলের এক কর্মচারী লিখছেন যে, মেজকুমারের জ্বর হয়েছে। তার পরদিন সকালে আর একটা টেলিগ্রামে জানা যায় যে, তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু, সন্ধের টেলিগ্রামে মারাত্মক খবর এল: ‘কুমার অত্যন্ত অসুস্থ। ঘন ঘন দাস্ত হচ্ছে। কাম শার্প’।

পরদিন ভোরে ছোটকুমার রবীন্দ্র দার্জিলিংয়ের ট্রেন ধরতে জয়দেবপুর স্টেশনে যাচ্ছেন, এমন সময়ে ডাকপিওন তাঁর গাড়ি থামিয়ে তাঁকে একটা টেলিগ্রাম দিল। তাতে লেখা, মেজকুমার মারা গিয়েছেন। তিন দিন পর দার্জিলিংয়ের যাত্রীরা জয়দেবপুর ফিরে এলেন, তাঁদের সঙ্গে সদ্যবিধবা বিভাবতী।

১৮ মে, মৃত্যুর এগারো দিন পর, মেজকুমারের শ্রাদ্ধশান্তি অনুষ্ঠিত হল স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে। তবু তাঁর মৃত্যু আর সৎকার নিয়ে নানা রকম কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল। শরিফ খাঁ নামে এক আরদালি মেজকুমারের দলের সঙ্গে দার্জিলিং গিয়েছিলেন। তিনি নাকি অনেককে বলেন যে, মেজকুমার যখন অসুস্থ, তখন তাঁকে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে সরিয়ে আনতে হয়। শরিফ খাঁ বিছানা সরাতে সাহায্য করছিলেন, এমন সময় মেজকুমার হঠাৎ বমি করেন। সে বমি নাকি এমনই বিষাক্ত ছিল যে, কয়েক ফোঁটা শরিফ খাঁর জামায় পড়াতে জামা ফুটো হয়ে যায়। আর একটা গুজবও ছড়াতে শুরু করে যে, মেজকুমারের দেহ সৎকারের জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলেও সৎকার হয়নি।

ভাওয়াল রাজপরিবারের লোকেরা তখন এসব গুজবকে আদৌ আমল দিয়েছিলেন কি না, বলা শক্ত। মেজকুমারের আকস্মিক মৃত্যুতে জয়দেবপুরবাসী বিস্ময়ে আর শোকে রীতিমত হতবাক হয়ে গিয়েছিল, সেটাই বরং বেশি সত্য। তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয় কোনও রকম জাঁকজমক ছাড়াই, নেহাতই যেন নিয়মরক্ষার জন্য। রাজবাড়ির শ্রাদ্ধ বলতে যে আড়ম্বর বোঝায়, তার কিছুই করা হয়নি।

পারিবারিক মন্দির

শ্রাদ্ধের ক’দিন পর থেকেই রানি বিভাবতীর দাদা সত্যেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ভাওয়াল এস্টেটের সম্পত্তিতে তাঁর বোনের অংশ সুরক্ষিত রাখার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। শোনা যায়, বিভাবতীকে একটা মাসোহারা দিয়ে সম্পত্তি থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল। তা শুনে সত্যেন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় ছুটলেন উকিলের পরামর্শ নিতে। প্রস্তাবটি অবশ্য বেশি দূর এগোয়নি। পরে শোনা যায়, শালাবাবু সত্যেন্দ্র বড় বেশি এস্টেটের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছিলেন, তাই তাঁকে ঠেকাতেই এই প্রস্তাব তোলা হয়। সত্যেন্দ্র ঢাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে তাঁর স্ত্রী আর মাকে কলকাতা থেকে নিয়ে এলেন। জয়দেবপুর রাজবাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই বোনের ব্যাপারে তাঁর ঘন ঘন হস্তক্ষেপ ভাল চোখে দেখছিলেন না। সত্যেন্দ্র এবার বিভাবতীকে রাজবাড়ি ছেড়ে চলে আসার জন্য বোঝাতে লাগলেন। প্রথমে কিছু দিন বিভাবতী রাজি হননি। কিন্তু ক্রমে তিনি মত পাল্টাতে লাগলেন। ১৯০৯ সালের নভেম্বর মাসে তিনি আমমোক্তারনামা লিখে সত্যেন্দ্রকে তাঁর এজেন্ট নিযুক্ত করলেন। সেই সঙ্গে মেজকুমারের নামে যে তিরিশ হাজার টাকার জীবনবিমা এস্টেট থেকে করানো হয়েছিল, সেই টাকাও দাবি করলেন।

ভাওয়াল রাজবাড়ির ওপর হঠাৎ যেন বিপর্যয়ের কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। ১৯১০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে বড়কুমার রণেন্দ্রনারায়ণ মারা গেলেন। ক’ মাস বাদেই ১৯১১-র এপ্রিলে এস্টেটের ম্যানেজার নিডহ্যাম সাহেব কলকাতায় মেজরানি বিভাবতীকে জানালেন যে, তাঁর অংশের সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডস অধিগ্রহণ করছে। ব্রিটিশ আমলে কোর্ট অব ওয়ার্ডস ছিল একটি সরকারি দফতর যা মালিকহীন জমিদারির তত্ত্বাবধান করত। জমিদারির মালিক নাবালক হলে অথবা জমিদারি পরিচালনায় অক্ষম হলে সেসব এস্টেট কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর আওতায় চলে আসত। ওই বছর মে মাসে সরকার ছোটকুমার রবীন্দ্রনারায়ণকেও জমিদারি পরিচালনায় অনুপযুক্ত ঘোষণা করে তাঁর অংশটুকু কোর্ট অব ওয়ার্ডসকে দিয়ে দিল। এক বছর বাদে বড় রানি সরযূবালার অংশটিও সরকারের আওতায় চলে এলে গোটা জমিদারিটাই কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর অধীন হল। ১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছোটকুমারও অল্প কয়েক দিন রোগভোগের পর মারা গেলেন। হঠাৎ দেখা গেল, ঢাকার এক প্রধান জমিদারবাড়ি ভাওয়াল রাজপরিবারের সদস্য বলতে বাকি রয়েছেন কেবল তিন নিঃসন্তান বিধবা রানি যাঁদের কারও সম্পত্তিই আর তাঁদের দখলে নেই। স্বামীর মৃত্যুর অল্পদিন বাদে ছোটরানি আনন্দকুমারীও জয়দেবপুর রাজবাড়ি ছেড়ে ঢাকা চলে গেলেন। ছ’বছর বাদে তিনি এক দত্তকপুত্র নেন।

এদিকে রমেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর থেকে বেশ কয়েক বছর ধরে নানা রকম গুজব রটতে থাকে। আগেই শোনা গিয়েছিল যে, তাঁর দেহ নাকি ঠিকমত সৎকার হয়নি। এবার শোনা যেতে লাগল যে, তিনি নাকি জীবিত আছেন এবং সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করছেন। জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অনেক সাধুসন্ন্যাসীর আনাগোনা ছিল। মেজকুমারের মারা যাওয়ার গল্প শুনে তেমন এক সন্ন্যাসী নাকি বলেন যে, তিনি এক বাঙালি উঁচুঘরের সন্তানকে একদল সাধুর সঙ্গে ঘুরতে দেখেছেন। সেই সাধুরা নাকি তাঁকে দার্জিলিংয়ে খুঁজে পায়। এসব গুজব শুনে ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে উত্তর ভারতে লোক পাঠানো হল এ ব্যাপারে ভাল করে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। কুমারদের এক বোন জ্যোতির্ময়ীদেবী খুব ধর্মপ্রাণ ছিলেন, মাঝে মাঝেই কাশী যেতেন। তিনি পরে জানান যে, কাশীতে সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে খোঁজ নিয়ে তাঁর স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল যে, মেজকুমার বেঁচে আছেন।

ভাওয়াল রাজার প্রসাদ

১৯১৭ সাল নাগাদ গুজবের স্রোত নিশ্চয় বেশ প্রবল হয়ে ওঠে, কারণ কুমারদের বৃদ্ধা ঠাকুরমা রানি সত্যভামা হঠাৎ বর্ধমানের মহারাজার কাছে চিঠি লিখে জানতে চাইলেন যে, তাঁর মেজ নাতির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কি না। সত্যভামা লিখলেন যে, উত্তর আর পূর্ব-ভারতের নানা জায়গা থেকে ক্রমাগত খবর আসছে যে, ভাওয়ালের মেজ কুমারকে নাকি এক দল সাধুর সঙ্গে ঘুরতে দেখা গিয়েছে। রমেন্দ্রর মৃত্যুর সময় বর্ধমানের মহারাজা দার্জিলিংয়েই ছিলেন। তিনি কি এ বিষয়ে কিছু জানেন? উত্তরে মহারাজা বিজয়চাঁদ জানালেন যে, মেজকুমারের মৃত্যুর কথা তাঁর মনে আছে। দার্জিলিংয়ে থাকার সময় এক দিন তিনি খবর পান যে, ভাওয়ালের মেজকুমার মারা গিয়েছেন। শুনে তিনি সৎকারের কাজে ব্যবহারের জন্য গঙ্গাজল আর তুলসিপাতা লোক মারফত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এর বেশি তাঁর কিছু জানা নেই।

মেজকুমারকে নিয়ে রটনা কিন্তু চলতেই লাগল। মাঝেমাঝেই শোনা যেত যে, তাঁকে নাকি অমুক জায়গায় দেখা গিয়েছে সাধুসন্তদের দলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বহু কাল পর কলকাতা হাইকোর্টের জজ লজ সাহেব মন্তব্য করেছিলেন যে, এত সব রটনা জল্পনা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, ভাওয়ালের লোক মেজকুমারের জীবিত থাকার গল্পটা বিশ্বাস করতে খুবই উদগ্রীব ছিল। কেউ যদি হঠাৎ উদয় হয়ে বলত যে, আমি সেই রমেন্দ্রনারায়ণ, লোকে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মেনে নিত। কোনও চক্রান্তকারীর মাথায় জাল মেজকুমারকে খাড়া করার মতলব এসে থাকলে, সে এ সব রটনা থেকে অন্তত এটুকু বুঝেছিল যে, খানিকটা চেহারায় সাদৃশ্য আনতে পারলেই তার কার্যসিদ্ধি হতে পারে।

কে এই সন্ন্যাসী?

ঢাকা শহরে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর বাকল্যাণ্ড বাঁধ এক কালে অত্যন্ত মনোরম জায়গায় ছিল। সারি সারি গাছ, দু’পাশে বাগান, মাঝেমাঝে বসার জন্য বেঞ্চ। সাহেবসুবোরা মর্নিংওয়াকে আসতেন এখানে। আজ অবশ্য বাকল্যাণ্ড বাঁধ সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাওয়ার পথ, ঢাকার সব চেয়ে ঘিঞ্জি আর নোংরা রাস্তার মধ্যে একটা। দু’পাশে এখন বাজার, কাদা আর আবর্জনার উপর দিয়ে ক্রমাগত সাইকেল রিকশার স্রোত বয়ে চলেছে। নদী দেখা যায় না— রাস্তার ধারে বিরাট পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়েছে, নদীর পাড়ে বেদখলকারীদের বসতি বসে যাবে এই ভয়ে। ঢাকার পুরনো অধিবাসীদের অনেকের কিন্তু বাকল্যাণ্ড বাঁধে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি মনে আছে।

১৯২১ সালের জানুয়ারি মাস নাগাদ বাকল্যাণ্ড বাঁধে এক সাধুর আবির্ভাব হয়। জটাধারী সন্ন্যাসীর সর্বাঙ্গে ছাই মাখা, পরনে কৌপীন। ব্যবসায়ী রূপলাল দাসের অট্টালিকা ঢাকা শহরের এক দ্রষ্টব্যস্থান। আজও হৃত জৌলুসের মলিন স্মৃতি বহন করে সংরক্ষিত ভবন হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে রূপলাল হাউস। সেই রূপবাবুর বাড়ির সামনে আস্তানা গাড়লেন সন্ন্যাসী। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি দিনরাত সেখানে বসে থাকতেন। তাঁর চেহারার জন্যই সন্ন্যাসী অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অনেকদিন পর আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময়ে একজন যেমন বলেন, ‘‘এমন সুন্দর গৌরবর্ণ, সম্ভ্রান্ত চেহারার জটাধারী সন্ন্যাসী ঢাকায় আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’’ প্রায়ই সাধুকে ঘিরে ছোটখাটো ভিড় জমে যেত। লোকে তাঁকে নানা প্রশ্ন করত— ‘কোত্থেকে এসেছ? তাবিজটাবিজ দাও নাকি?’ ইত্যাদি। সাধু বিশেষ উত্তর দিতেন না। দিলে উত্তর দিতেন হিন্দিতে। পরে শোনা যায়, সাধু নাকি বলতেন যে, তিনি পঞ্জাবের লোক, ছোটবেলায় ঘরবাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছেন। বাংলার জল-হাওয়া তাঁর একেবারে পছন্দ হচ্ছে না। ওষুধ চাইলে তিনি মাদুলি তাবিজের বদলে তাঁর গায়ের ছাই এক চিমটে তুলে দিতেন।

এরই মধ্যে কোনও এক সময়ে গুজব চালু হয়ে যায় যে, ভাওয়ালের মেজকুমার সন্ন্যাসী হয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছেন। হঠাৎ দেখা গেল, দূরদূরান্ত থেকে লোক সাধুকে দেখার জন্য বুড়িগঙ্গার ধারে রূপবাবুর বাড়ির সামনে ভিড় করতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ সময়ে সন্ন্যাসী লোকের কথায় কোনও সাড়া দিতেন না। বেশি রকম উত্ত্যক্ত করলে তিনি হিন্দিতে বলতেন যে, তিনি সংসারত্যাগী, ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন কিছু নেই। অনেকেই ‘যত সব বাজে গুজব’ বলে ফিরে চলে যেত। কেউ কেউ আবার বলত ‘লোকটা ঠগ’, যদিও সাধু নিজের পূর্বপরিচয় নিয়ে কোনও রকম দাবি করেননি। তবু সেই শীতকালের মরা রোদে বুড়িগঙ্গার পাড়ে সন্ন্যাসীকে ঘিরে থাকা ভিড়ের ভেতর থেকে গুঞ্জন শোনা যেতে লাগল, ‘হ্যাঁ, এই তো মেজকুমার! ভাওয়ালের মেজকুমার স্বয়ং!’ সাধুর ঢাকায় আসার প্রায় চার মাস বাদে ভাওয়াল রাজপরিবার থেকে প্রথম তাঁকে দেখতে যায় কুমারদের দিদি জ্যোতির্ময়ীর ছেলে বুদ্ধু।

জয়দেবপুরের পাশের গ্রাম কাশিমপুরের কয়েকজন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধু সন্ন্যাসীকে দেখে আসার পরও কিন্তু নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারল না। সন্ন্যাসীর সঙ্গে মেজকুমারের চেহারার মিল আছে ঠিকই। কিন্তু এই সাধুই যে তাঁর মেজমামা, মৃত্যুর দ্বার থেকে জীবন্ত ফিরে এসেছেন, এমন কথা বুদ্ধু জোর গলায় বলতে পারল না। কাশিমপুরের সঙ্গীরা তখন স্থির করলেন যে, সন্ন্যাসীকে একবার সশরীরে জয়দেবপুর নিয়ে আসতে হবে।

১৯২১ সালের ৫ এপ্রিল কাশিমপুরের অতুলপ্রসাদ রায়চৌধুরী সন্ন্যাসীকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে এলেন। অতুলবাবু মেজকুমারকে খুব ভাল রকম চিনতেন। ভাওয়াল আর কাশিমপুর, দুই জমিদার বাড়ির মধ্যে বিশেষ ঘনিষ্ঠতাও ছিল। পরে অবশ্য বলা হয় যে, সন্ন্যাসীকে আদৌ ভাওয়ালের মেজকুমার সন্দেহ করে কাশিমপুর নিয়ে যাওয়া হয়নি। নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কারণ, ওই বাড়ির কর্তা সারদাপ্রসাদের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না, তাই সন্ন্যাসীকে দিয়ে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করানোর চেষ্টা হচ্ছিল। সন্ন্যাসী অবশ্য সরাসরি বলে দেন যে, তিনি যজ্ঞটজ্ঞ কিছু জানেন না। তবু প্রায় দিন সাতেক সন্ন্যাসী কাশিমপুরে এক গাছতলায় আশ্রয় নেন। ১২ এপ্রিল বিকেলে সন্ন্যাসীকে হাতির পিঠে চড়িয়ে জয়দেবপুর নিয়ে আসা হয়।

সন্ধে ছটা নাগাদ হাতি সোজা এসে থামল রাজবাড়িতে। সন্ন্যাসী হাতির পিঠ থেকে নেমে ধীরে এগিয়ে গেলেন রাজবাড়ির অতিথিশালা মাধববাড়ির দিকে। সেখানে একটা কামিনী গাছের তলায় গিয়ে বসলেন। কুমারদের তিন বোনই ততদিন রাজবাড়ি ছেড়ে জয়দেবপুরে অন্যত্র বাড়ি করে চলে গেছেন। আশি বছরের বৃদ্ধা রানি সত্যভামাও তখন তাঁর এক নাতনির সঙ্গে ছিলেন। সেদিন সন্ধেবেলা সন্ন্যাসীকে চাক্ষুষ দেখতে আসেন রাজবাড়ির কিছু কর্মচারী আর দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তাঁদের একজন— সত্যভামার ভাইপো রাধিকা গোস্বামী— পরে বলেছিলেন যে, তিনি বিশেষ করে কৌপীনধারী সাধুর হাত-পায়ের গড়ন লক্ষ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ইনি মেজকুমার কি না, নিশ্চিত হতে পারেননি।

পরদিন সকালে ভাওয়াল স্টেটের সেক্রেটারি রায়সাহেব যোগেন্দ্রনাথ বাঁড়ুজ্যে আর তাঁর ছোট ভাই সাগর সন্ন্যাসীকে দেখতে এলেন। এঁরা এসে দেখেন সন্ন্যাসী রাজবিলাস নামে বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে আছেন। সাগরবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সন্ন্যাসীকে দেখতে লাগলেন। ‘আমরা ওঁর মুখোমুখি দাঁড়াতে উনি আমাদের দিকে তাকালেন। আমি ওঁর চোখের মণির রং দেখতে পেলাম। চোখ কটা। আমি ওঁর গড়নপেটন, ওঁর বসার, তাকাবার ভঙ্গি, ওঁর চেহারা, খুব ভাল করে লক্ষ করতে লাগলাম। ওঁকে মেজকুমার বলেই সন্দেহ হল। আমি যোগেনবাবুকে যা ভাবছিলাম তা বললাম। উনি বললেন, ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর। উনি বললেন হইচই কোরো না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওঁকে দেখা যাক। কিছুক্ষণ বাদে বুদ্ধু এসে জানাল যে, তাঁর মা সন্ন্যাসীকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছেন। জিজ্ঞাসা করাতে সন্ন্যাসী বললেন যে, তিনি দুপুরে সেখানে যাবেন।’’

সেদিন সন্ধেবেলা জ্যোতির্ময়ীদেবী প্রথম সন্ন্যাসীকে দেখলেন তাঁর বাড়িতে। সন্ন্যাসী কিছুক্ষণ আগেই টমটম চড়ে পৌঁছেছেন। জ্যোতির্ময়ী বারান্দায় বেরিয়ে দেখলেন সন্ন্যাসীকে আসন পেতে বসানো হয়েছে। তাঁকে ঘিরে বসে আছে পরিবারের লোকজন। সন্ন্যাসী মাথা নিচু করে আড়চোখে চারপাশ দেখছিলেন। ‘‘তাই দেখে আমার মেজর কথা মনে পড়ল। ও যেমন ভাবে লোকজনের দিকে তাকাত। আমার বেশ সন্দেহ হল। আমি ভাল করে লক্ষ করতে লাগলাম ওঁর চেহারা, মুখের আদল, চোখ, কান, ঠোঁট, গড়ন, হাত পা।’’ জ্যোতির্ময়ী সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তিনি কতদিন থাকবেন। সন্ন্যাসী জবাব দিলেন যে, পরদিনই তিনি নাঙ্গলবাঁধ যাবেন ব্রহ্মপুত্র স্নানে। জ্যোতির্ময়ী তাঁকে কিছু ফল আর ক্ষীর খেতে দিলেন। সন্ন্যাসী ক্ষীরটুকু খেলেন। তার পর চলে গেলেন। ‘‘আমি ওঁর চলনটা লক্ষ করলাম। ঠিক যেন মেজকুমারের মতো। ঠিক একই রকম লম্বা। তবে ওকে আরও মোটাসোটা লাগল। সামান্য মোটা।’’ সন্ন্যাসী চলে যাওয়ার পর সকলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। ঠিক হল, পরদিন তাঁকে নিমন্ত্রণ করে খেতে বলা হবে। তখন দিনের আলোয় তাঁকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা যাবে।

পরদিন সকালে সাধুকে রাজবিলাসের বারান্দায় পায়চারি করতে দেখা গেল। এই রাজবিলাস নামে বাড়িটিতেই রাজপরিবারের লোকেরা থাকতেন। সাধু মেজকুমারের ঘরের খড়খড়ি ফাঁক করে ভেতরে উঁকি মেরে দেখলেন। তার পর পাশের স্নানঘরে কল খুলে হাত মুখ ধুলেন। দুপুরে এস্টেটের ঘোড়া গাড়িতে তাঁকে আবার নিয়ে যাওয়া হল জ্যোতির্ময়ীদেবীর বাড়ি। এবার তিনি সোজা বৈঠকখানায় ঢুকে চেয়ার পেতে বসলেন। কুমারদের আর এক দিদি স্বর্গতা ইন্দুময়ীর স্বামী গোবিন্দ মুখুজ্যে সামনে চৌকিতে বসলেন আর সত্যভামা ও জ্যোতির্ময়ীদেবী বসলেন চেয়ারে। জ্যোতির্ময়ী পরে বলেছিলেন, ‘‘সন্ন্যাসী আমার ঠাকুরমাকে হিন্দিতে বললেন চৌকিতে উঠে বসতে। ঠাকুরমা উঠে চৌকির একধারে বসলেন। সন্ন্যাসী তাঁকে ধরে আরও আরাম করে বসতে সাহায্য করলেন। তার পর বললেন, ‘বুড়িকা বড়া দুখ হ্যায়।’’ ‘‘এর পর জ্যোতির্ময়ীর মেয়েদের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁরা কে।

ইন্দুময়ীর ছেলেদেরও পরিচয় নিলেন। ‘‘আমার বোনঝি কেনিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়ে কৌন হ্যায়?’ আমি বললাম, আমার দিদির মেয়ে। বলতেই সন্ন্যাসী কেঁদে ফেললেন। গাল বেয়ে চোখের জল গড়াতে লাগল। কেনি তখন বিধবা।’’ ইন্দুময়ীর ছেলে টেবু অ্যালবাম এনে সন্ন্যাসীকে মেজকুমারের ছবি দেখাল। ছবি দেখে তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। জ্যোতির্ময়ী সাধুকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তিনি তো সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, তবে কাঁদছেন কেন? সন্ন্যাসী বললেন, ‘হ্যাম মায়াসে রোতা হ্যায়।’ জ্যোতির্ময়ী জিজ্ঞাসা করলেন ‘কীসের মায়া?’ সন্ন্যাসী কোনও উত্তর দিলেন না। এরপর জ্যোতির্ময়ী মেজকুমারের মৃত্যুর গল্প বলতে শুরু করলেন। বললেন সে দার্জিলিংয়ে মারা গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর মৃতদেহ সৎকার হয়েছিল কি না তা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। জ্যোতির্ময়ীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, ‘‘না, না, তাঁর দেহ পোড়ানো হয়নি। তিনি জীবিত আছেন।’’ জ্যোতির্ময়ী সোজা সন্ন্যাসীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আপনার মুখ অবিকল আমার ভাইয়ের মতো, যেন কেটে বসানো। আপনিই কি সে?’’ সন্ন্যাসী বললেন, ‘‘ না, আমি আপনার কেউ হই না।’’

যাই হোক, সন্ন্যাসী সেদিন জ্যোর্তিময়ীর বাড়িতে খেয়ে যেতে রাজি হলেন। ‘‘উনি খাচ্ছিলেন, আমি ওঁকে লক্ষ করছিলাম। দেখলাম প্রতিটি গ্রাস মুখে তোলার সময় ওঁর ডান হাতের তর্জনী কেমন বেরিয়ে থাকে। জিভটাও কেমন একটু বেরিয়ে আসে। ঠিক মেজর মতো। আমি ওঁর মুখের গড়ন, কণ্ঠার ওঠানামা, ভালভাবে লক্ষ করলাম। দেখলাম ওঁর চুল লালচে, চোখ কটা। ওঁর দাঁত দেখলাম অবিকল মেজকুমারের মতো— পরিপাটি সাদা, মুক্তোর মতো। ওঁর হাত আর আঙুলের নখগুলো লক্ষ করলাম, প্রতিটি নখ আলাদা করে দেখার চেষ্টা করলাম। হাতের তেলো দেখলাম। পা, পায়ের পাতা, পায়ের আঙুলগুলো। ছোট্ট থেকে অামরা একসঙ্গে থেকেছি, বড় হয়েছি। ওঁর সারা শরীর— হাত, পা, মুখ, এমনকী চোখের পাতাও, ছাইমাখা। চুল লম্বা, মুখে দাড়ি। মেজো যখন দার্জিলিং যায়, ওর দাড়ি ছিল না। কথা বলছিলেন অস্পষ্ট ভাবে। গলার স্বর একেবারে মেজকুমারের মতো।’’

জ্যোতির্ময়ীর সন্দেহ এবার তীব্র হতে লাগল যে, এই সন্ন্যাসী তাঁর ভাই। তিনি চাইছিলেন যে, সন্ন্যাসী আর ক’দিন জয়দেবপুরে থাকুন যাতে তাঁর শরীরের দাগগুলো পরীক্ষা করানো যায়। কিন্তু সন্ন্যাসী ঢাকা ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, কিছুতেই থাকতে রাজি হলেন না।

এর পর প্রায় দিনসাতেক সন্ন্যাসী ঢাকায় ছিলেন না। জ্যোতির্ময়ীর নির্দেশে বুদ্ধু তাঁর খোঁজ করতে গিয়ে দেখা পেল না। শোনা গেল, তিনি চট্টগ্রাম জেলার চন্দ্রনাথ তীর্থদর্শন করতে গেছেন। ১৫ এপ্রিল নাগাদ তিনি আবার বাকল্যাণ্ড বাঁধে তাঁর পুরনো জায়গায় ফিরে এলেন। সেদিন বুদ্ধু সন্ন্যাসীকে ঢাকায় তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে জ্যোতির্ময়ী তাঁর ছোট বোন তড়িন্ময়ী (ডাক নাম মটর)-কে আসতে বলেছিলেন সন্ন্যাসীকে দেখার জন্য।

৩০ এপ্রিল সন্ন্যাসীকে আবার জয়দেব পুরে জ্যোতির্ময়ীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। এবার বহু আত্মীয়স্বজন লোকজন এসে হাজির হল সন্ন্যাসীকে দেখতে। সন্ন্যাসী নদীতে স্নান করতে যাবেন, জ্যোতির্ময়ী তাঁকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন গায়ে ছাই না মাখেন। সন্ন্যাসী শুনলেন না, সেই ছাই মেখেই ফিরলেন। দুদিন এ ভাবে গেল। তৃতীয় দিন কিন্তু সন্ন্যাসী নদী থেকে স্নান সেরে ফিরলেন ছাই না মেখে। জ্যোতির্ময়ী পরে বলেন, ‘‘আমি ওঁর গায়ের রং দেখলাম। ঠিক যেন মেজকুমারের আগেকার গৌরবর্ণ চেহারা, ব্রহ্মচর্যের দরুন আরও উজ্জ্বল হয়েছে। স্নানের পর ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন অবিকল রমেন্দ্র নিজে। লক্ষ করলাম, ওঁর চোখের পাতা গায়ের রঙের তুলনায় চাপা। ঘোড়াগাড়ির চাকার আঘাতের দাগটাও দেখতে পেলাম। পায়ের পাতা আর গোড়ালির ফাটা ফাটা শুকনো কড়া পড়ে যাওয়া অংশগুলোও দেখলাম। যে সব আত্মীয়ের নাম আগে বলেছি, আমার ঠাকুরমা আর অন্য সকলেই তাঁকে দেখে চিনতে পারলেন, আমারই মতো।’’

পর দিন ৪ মে ভোরে জ্যোতির্ময়ীর নির্দেশে বুদ্ধু সন্ন্যাসীর শরীরে কী কী দাগ আছে পরীক্ষা করতে চাইল। সন্ন্যাসী রাজি হলেন। জ্যোতির্ময়ী দেখতে চাইছিলেন যে, রমেন্দ্রর শরীরে জন্মদাগ আর অন্যান্য চিহ্নগুলো সন্ন্যাসীর দেহে আছে কি না। ‘‘কারণ বুঝতে পারছিলাম, ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর। শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিন্ত হওয়া দরকার, যাতে পরে মনে কোনও প্রশ্ন না ওঠে।’’ সেদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির বাইরে ভিড় জমতে শুরু করল। জ্যোতির্ময়ী ঠিক করলেন, সন্ন্যাসীকে সরাসরি জেরা করবেন। ‘‘আপনার চেহারা আর শরীরের চিহ্নগুলো অবিকল আমার মেজ ভাইয়ের মতো। নিশ্চয়ই আপনি সে। আপনার পরিচয় কী?’’ ‘‘না, না,’’ সন্ন্যাসী ঘাড় নাড়লেন, ‘‘আমি সে নই। কেন আমায় শুধু শুধু বিরক্ত করছেন?’’ জ্যোতির্ময়ী দৃঢ় ভাবে বললেন, ‘‘আপনাকে বলতেই হবে আপনি কে?’’

আত্মপরিচয়

জ্যোতির্ময়ী বুদ্ধুকে বললেন বাইরে গিয়ে সকলকে জানাতে হবে যে, মেজকুমারের শরীরের পুরনো চিহ্নগুলো সব সন্ন্যাসীর শরীরে পাওয়া গেছে। ততক্ষণে বাইরে কয়েক শো লোকের ভিড় জমেছে। বেশির ভাগই জমিদারের প্রজা। সকলেই সন্ন্যাসীর আসল পরিচয় জানতে চায়। জ্যোতির্ময়ী ততক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছেন যে, এই সন্ন্যাসীই তাঁর ভাই। তিনি সন্ন্যাসীকে বললেন যে, সকলের সামনে তাঁর আসল পরিচয় না জানালে তিনি জলগ্রহণ করবেন না। ঠিক বারো বছর আগে তারিখ মেলালে প্রায় একই দিনে, তাঁর ভাইয়ের তথাকথিত মৃত্যু হয়েছিল দার্জিলিংয়ে।

সেদিন দুপুরে সন্ন্যাসী এসে দাঁড়ালেন প্রায় হাজার দুয়েক লোকের সামনে। ভিড়ের ভেতর থেকে প্রশ্ন এল, ‘‘আপনার নাম কী?’’
সন্ন্যাসী বললেন, ‘‘রমেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী।’’
‘‘আপনার পিতার নাম কী?’’
‘‘রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী।’’
‘‘আপনার মায়ের নাম?’’
‘‘রানি বিলাসমণি দেবী।’’
একজন বলে উঠল, ‘‘আরে, রাজারানির নাম তো সকলেই জানে। আপনার দাই-এর নাম বলুন।’’
সন্ন্যাসী জবাব দিলেন, ‘‘অলকা।’’

এই শুনে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। ‘‘জয়, মধ্যমকুমারের জয়।’’ মেয়েরা উলুধ্বনি দিতে লাগল। তুমুল হইচইয়ের মধ্যে সন্ন্যাসীর যেন মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ার উপক্রম হল। জ্যোতির্ময়ী এবং বাড়ির অন্যান্য মহিলা চিকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সন্ন্যাসীকে পাখার বাতাস করে মাথায় গোলাপ জল ছিটোতে লাগলেন। কয়েক মিনিট বাদে তাঁকে ছোটবোন মটরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। জনতা তাঁকে ছাড়তে চায় না, পিছু পিছু ধাওয়া করল। অনেক বোঝানোর পর তারা ক্ষান্ত হল।

পর দিন, ৫ মে ভাওয়াল এস্টেটের ম্যানেজার নিডহ্যাম জয়দেবপুর থেকে ঢাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট লিণ্ডসে-কে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে একটা গোপন রিপোর্ট পাঠালেন।

মাই ডিয়ার লিণ্ডসে,

এখানে একটা অত্যন্ত অদ্ভুত আর আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে চলেছে যা গোটা জমিদারিতে, এমনকী তার বাইরেও, সোরগোল ফেলে দিয়েছে।

প্রায় পাঁচ মাস আগে এক গৌরবর্ণ সন্ন্যাসী ঢাকায় এসে নদীর ধারে রূপবাবুর বাড়ির উল্টোদিকে আড্ডা গাড়ে। লোকে বলছে সে নাকি হরিদ্বার থেকে এসেছে। কিছু দিন পর তাঁকে কাশিমপুরের জমিদারবাবু সারদাপ্রসাদ রায়চৌধুরীর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। ক’দিন সেখানে থাকার পর ঢাকা ফেরার পথে অন্যান্য সাধুসন্তের মতো তিনি দু-তিন দিন জয়দেবপুরের মাধববাড়িতে কাটান। ওই সময় তাঁকে শ্রীযুক্তা জ্যোতির্ময়ীদেবীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর মৃত মেজ ভাই (ভাওয়ালের কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায়)-এর চেহারার মিল দেখে তিনি কান্নাকাটি শুরু করেন। এবং সাধুও কেঁদে ফেলেন। তাই দেখে বাড়ির লোকজনের মনে সন্দেহ জাগে। মেজকুমারের একটা ফটো দেখার পর সন্ন্যাসী অঝোরে কাঁদতে থাকেন। তাতে সকলের সন্দেহ আরও জোরদার হয়। বাড়ির সকলে তাঁকে তাঁর আসল পরিচয় জানানোর জন্য চাপ দিতে থাকে, কিন্তু সন্ন্যাসী কোনও জবাব না দিয়ে ঢাকা ফিরে যান। এরপর কিছু দিন সাধুর আর কোনও খোঁজখবর পাওয়া যায়নি।

এক সপ্তাহ আগের কাশিমপুরের জমিদারবাবু অতুলপ্রসাদ রায়চৌধুরী আবার সাধুকে জ্যোতির্ময়ীদেবীর বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেই যাবৎ সাধু সেখানেই আছেন। রোজ প্রায় শ’খানেক লোক জমছে সাধুকে দর্শন করতে। দেখার পর সকলেই মনে করছে ইনিই মৃত মেজকুমার। জমিদারির বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রজারা দলবেঁধে এসে সাধুকে দেখে গিয়ে খবর ছড়াচ্ছে যে, উনিই মেজকুমার। সাধুর উপস্থিতি গোটা এলাকায় ভয়ানক সোরগোল ফেলেছে।

গতকাল সন্ধ্যায় কয়েকশো প্রজার প্রশ্ন আর অনুনয়ের চাপে সাধু জানায় যে, তাঁর নাম রমেন্দ্র এন রায়, তাঁর পিতার নাম রাজেন্দ্র এন রায় আর তার দাইয়ের নাম অলকা। এর পর সাধু মুর্চ্ছিত হয়ে পড়ে এবং প্রজারা উলুধ্বনি আর জয়ধ্বনি দিতে থাকে। ওই সময়ে সমবেত জনতার মধ্যে সকলেই নিঃসন্দেহ ছিল যে, এই সন্ন্যাসী মেজকুমার ছাড়া আর কেউ নন। প্রজারা প্রতিজ্ঞা করে যে, এস্টেট তাঁকে মেনে না নিলেও তারা তাঁর পাশে থাকবে। ব্যাপার গুরুতর দেখে ইন্দুময়ী ও জ্যোতির্ময়ীদেবীর বাড়ির লোকেরা মোহিনীবাবু ও মিস্টার ব্যানার্জিকে সাধুর স্বীকারোক্তির কথা জানিয়ে দেন। ওঁরা দু’জন তখন জ্যোতির্ময়ীদেবীর বাড়ি গিয়ে ঘটনার তদন্ত করেন। কিন্তু সাধু ওদের সঙ্গে দেখা করেননি। আজ সকালে ওঁরা আবার সেখানে যান। সাধু জানিয়েছেন যে, তিনি বিকালে দেখা করবেন। পরিবারের লোকেরা সাধুকে বারে বারে বলেছেন যে, নিজেকে মেজকুমার বলে দাবি করে তিনি বিশাল দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিচ্ছেন। তাঁর আগের জীবনের ইতিহাস পুরোপুরি না জানিয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধুর ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা খুব প্রয়োজন। প্রতি দিন সকাল থেকে সাধুকে দেখার জন্য বহুলোকের ভিড় জমছে। উত্তেজনা এতই প্রবল যে, এখন থেকে ঠিক মতো ব্যবস্থা না নিলে শেষ পর্যন্ত বড় রকমের গোলযোগ দেখা দিতে পারে।

আপনার আদেশের অপেক্ষায় রইলাম।

ইতি— এফ.ডব্লিউ. নিডহ্যাম।

এই চিঠির কপি কলকাতায় মেজরানি বিভাবতী দেবী এবং অন্য দুই রানিকেও তাঁদের অবগতির জন্য পাঠানো হয়। চার দিন বাদে ৯ মে কলকাতার দি ইংলিশ ম্যান পত্রিকায় নিম্নোক্ত চিঠিটি প্রকাশিত হয়।

স্যার,

গত শনিবার আপনারা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস দ্বারা প্রেরিত ‘ঢাকায় চাঞ্চল্য’ নামে একটি সংবাদ ছেপেছিলেন। সংবাদের বক্তব্য ছিল যে, এক ব্যক্তি হঠাৎ এসে নিজেকে বারো বৎসর পূর্বে মৃত ভাওয়ালের মেজকুমার বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে।

দার্জিলিংয়ে তদানীন্তন সিভিল সার্জেন লে: কর্নেল ক্যালভার্ট স্বর্গত কুমারকে তাঁর শেষ অবস্থায় চিকিৎসা করেন। কুমারের ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের ডেপুটি কমিশনার মি. ক্রফোর্ড।

আমি নিজে স্বর্গীয় কুমারের মৃত্যুশয্যার পাশে উপস্থিত ছিলাম এবং তাঁর বহু আত্মীয়পরিজন ও বন্ধু যাঁরা তখন দার্জিলিংয়ে উপস্থিত ছিলেন কুমারের শেষকৃত্যে যোগদান করেন। মৃত কুমারের বিধবা পত্নী ভাওয়ালের রানি আমার নিজের বোন এবং তিনি এখনও জীবিত আছেন।

ইতি— এস এন ব্যানার্জি।

ইতিমধ্যে জয়দেবপুরে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন জ্যোতির্ময়ীদেবীর বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়ে সন্ন্যাসীকে দেখার জন্য ভিড় জমাতে লাগল। সাধু তত দিনে সন্ন্যাসীর বেশ ছেড়ে সাধারণ জামাকাপড় পরতে শুরু করেছেন, যদিও তাঁর চুলদাড়ি তখনও আগের মতো লম্বা। প্রতি দিন বাড়ির সামনে চেয়ারে বসে তিনি লোকেদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন, পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতেন আর মাঝে মাঝেই নাকি অশ্রু বিসর্জন করতেন। জয়দেবপুর থানার দৈনিক রেজিস্টারে এ সব রিপোর্ট লেখা হয়েছিল।—

১০/৫/২১: দুপুর তিনটে। গত চব্বিশ ঘণ্টা কোনও বৃষ্টি হয়নি। জয়দেবপুর রাজবাড়ির সেই সাধু যিনি নিজেকে মেজকুমার বলছেন, তিনি এখনও এখানেই অবস্থান করছেন। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য লোক আসছে তাঁকে দেখতে। বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের ধারণা যে ইনিই মেজকুমার।

১১/৫/২১: জয়দেবপুরে এক সন্ন্যাসী এসেছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু লোক আসা-যাওয়া করছে তাঁকে দেখার জন্য। পনেরো আনা লোক বলছে যে, উনিই মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।

১৩/৫/২১: দুপুর আড়াইটে। খবর পাওয়া গেছে যে, আগামী রবিবার এক বিশাল প্রজা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। যে-সন্ন্যাসী নিজেকে মেজকুমার বলে পরিচয় দিচ্ছেন, তাঁকে সেই সভায় আনুষ্ঠানিক ভাবে মেনে নেওয়া হবে।

খবর পাকা ছিল পুলিশের কাছে । রবিবার ১৫ মে একটি প্রকাশ্য সমাবেশের ডাক দেওয়া হল জয়দেবপুর রাজবাড়ির সামনের ময়দানে। সেদিন ভোর হতে না হতে জয়দেবপুরে যেন মানুষের ঢল নামল। ঢাকা আর ময়মনসিং জেলার হাজার হাজার লোক সেখানে আসতে শুরু করল। রেল কোম্পানি স্পেশাল ট্রেন চালু করা সত্ত্বেও স্থানাভাবে মানুষ পাদানি আর জানলা ধরে ঝুলতে ঝুলতে এল। দুপুরের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে যায় দশ হাজারের বেশি। পরে অনেকে বলে যে, সেদিনের সভায় নাকি পঞ্চাশ হাজার লোক জমায়েত হয়েছিল। ভাওয়ালের এক মান্যগণ্য তালুকদার বারিসবার আদিনাথ চক্রবর্তী বক্তৃতা দিতে উঠে মেজকুমারের মৃত্যুর ঘটনাবলি বর্ণনা করতে শুরু করলেন। বললেন, তাঁর দেহের সৎকার নিয়ে কত রকম সন্দেহ ছিল। তার পর সন্ন্যাসীর আগমন, তাঁর জয়দেবপুর যাওয়া, জ্যোতির্ময়ীদেবী ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের প্রশ্ন, তাঁর শরীরের চিহ্ন পরীক্ষা এবং শেষে সন্ন্যাসীর নিজমুখে তাঁর পরিচয় স্বীকার করা, সব প্রসঙ্গ বিশদ ভাবে আলোচনা করলেন।

আদিনাথ জানালেন, বেশির ভাগ লোক যাঁরা সন্ন্যাসীকে দেখেছেন, তাঁদের মনে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, তিনি ভাওয়ালের মেজকুমার। শুধু মুষ্টিমেয় কিছু আত্মীয় তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য এখনও সত্য ঘটনা স্বীকার করতে চাইছে না। কিন্তু ভাওয়ালের তালুকদার আর প্রজারা সকলেই একমত যে, তাঁদের পরম প্রিয় মেজকুমার ফিরে এসেছেন। এখন প্রয়োজন, তাদের এগিয়ে এসে সকলের সামনে নির্ভয়ে মতপ্রকাশ করা। আদিনাথ সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করে আহ্বান জানালেন, যাঁরা বিশ্বাস করেন যে, সন্ন্যাসীই ভাওয়ালের মেজকুমার, তাঁরা সবাই হাত তুলুন। হাজার হাজার হাত আকাশের দিকে উঠল। আদিনাথ তখন বললেন, যাঁরা সন্ন্যাসীকে মেজকুমার বলে বিশ্বাস করেন না তাঁরা এবার হাত তুলুন। একটাও হাত উঠল না। তখন পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাওয়াল রাজের তালুুকদার ও প্রজাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেশ করলেন যে, সন্ন্যাসীকে ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায় বলে মেনে নেওয়া হল। প্রস্তাব বিনা বিরোধিতায় পাস হয়ে গেল। স্থির হল যে, প্রস্তাবের কপি গভর্নর, বোর্ড অব রেভিনিউ, ডিভিশনাল কমিশনার ও ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাঢিষ্ট্রেটকে পাঠানো হবে।

ততক্ষণে সূর্য দিগন্তে ঢলে পড়ছে। যাঁকে দেখার জন্য এত ঔৎসুক্য, এত ভিড়, সেই সন্ন্যাসী এ বার হাতির পিঠে চড়ে সমাবেশে হাজির হলেন। হাতি সন্ন্যাসীকে পিঠে নিয়ে ধীরে ধীরে সভামঞ্চটি প্রদক্ষিণ করল। জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ল। ‘জয়, মধ্যমকুমার কী জয়।’ হঠাৎ দমকা বাতাস বইতে শুরু করল, তারপরই ধুলোর ঝড়। কালবৈশাখী। কয়েক মুহূর্ত বাদেই প্রবল বৃষ্টি। সভা ভেঙে গেল। কিন্তু ততক্ষণ সমবেত জনতা তাদের প্রাপ্য উত্তেজনার ষোলো আনা পেয়ে গেছে।

কিছুদিন বাদে ভাওয়াল তালুকদার ও প্রজাসমিতি নামে সংগঠন তৈরি হল। উদ্দেশ্য, আইনের সাহায্য নিয়ে কুমারকে তাঁর ন্যায্য সম্পত্তি আর অধিকার আদায় করার জন্য চাঁদা তোলা। সমিতির সভাপতি হলেন হরবাইদের দিগেন্দ্রনারায়ণ ঘোষ, ভাওয়ালের আর এক গণ্যমান্য তালুকদার।

১৯২১-এর ২৯ মে, আত্মপরিচয় আর জনসভার দিনপনেরো বাদে, সন্ন্যাসী দু’জন উকিল আর স্থানীয় এক জমিদারকে সঙ্গে নিয়ে সটান হাজির হলেন ঢাকার কালেক্টর লিণ্ডসে সাহেবের বাড়িতে। সাক্ষাতের পর লিণ্ডসে তাঁদের কথাবার্তার একটি রিপোর্ট লিখে রাখেন তাঁর নথিতে।

আজ সকাল এগারোটায় বাবু শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী, বাবু পিয়ারিলাল ঘোষ আর বোধহয় কাশিমপুরের ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে সাধু দেখা করতে আসেন। তিনি বলেন যে, প্রজাদের স্বার্থে তিনি জমিদারির সুব্যবস্থা চান। আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম যে, বোর্ড অব রেভিনিউ তাঁকে মেজকুমার হিসেবে মেনে নিতে পারে না কারণ, বহু বছর ধরে বোর্ড মেজকুমার মৃত এ কথা জেনেই এস্টেটের কাজকর্ম চালিয়ে আসছে। আমি তাঁকে বললাম যে, চাইলে তিনি আদালতে নিজের আসল পরিচয় প্রমাণ করতে পারেন অথবা আমার সামনে কোনও প্রমাণ দাখিল করলে আমি তা নথিভুক্ত করতে পারি। সাধু দ্বিতীয় প্রস্তাবটিতে রাজি হলেন এবং ওঁর সঙ্গী দুই উকিল বললেন এ ব্যাপারে তদন্ত করবার জন্য আগামিকালই তাঁরা একটি আবেদন জমা দেবেন। তাঁরা জানতে চাইলেন যে, বোর্ড তদন্তের খরচ বহন করবে কি না। আমি বললাম যে, তাঁরা বোর্ডকে এই মর্মে আবেদন করলে আমি বোর্ডের সিদ্ধান্ত তাঁদের জানিয়ে দিতে পারি।

আমার প্রশ্নের উত্তরে সাধু (মেজকুমার) জানান যে, তিনি দার্জিলিংয়ে থাকাকালীন দু’চার দিন নিউমোনিয়ায় ভুগে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। দার্জিলিংয়ের বাড়িটির নাম তাঁর মনে নেই, তবে জয়দেবপুর থেকে দার্জিলিং যাত্রার কথা মনে আছে। জয়দেবপুর থেকে যাত্রার সময় ডান হাঁটুর ওপর একটি ফোঁড়া ছাড়া তাঁর আর কোনও রকম অসুস্থতা ছিল না। এই ফোঁড়াটি হওয়ার বিশেষ কোনও কারণ ছিল বলে তাঁর মনে পড়ে না। দার্জিলিং রওনা হওয়ার আগের দশ দিনের মধ্যেই ফোঁড়াটি হয়েছিল। দার্জিলিং যাওয়ার আগে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন কি না, তাঁর মনে নেই। অচৈতন্য অবস্থা থেকে যখন তাঁর জ্ঞান ফেরে, তখন তিনি পাহাড়ঘেরা এক জঙ্গলের মধ্যে এক সাধুর সামনে শুয়ে। ওই দিন থেকে সেই সাধুই তাঁর গুরু। সাধু তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি নাকি তিন-চার দিন অচৈতন্য অবস্থায় ছিলেন। কেউ তাঁর মৃতপ্রায় দেহটিকে জঙ্গলের ভেতর ফেলে রেখে গিয়েছিল, সাধু সেখানে তাঁকে খুঁজে পান। তার আগে ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল, তাই তাঁর দেহ নাকি সপসপে ভেজা ছিল। সাধু তাঁকে দিনে খুঁজে পান না রাত্রে, তা বলেননি।

বোর্ড অব রেভিনিউ-এর তত্ত্বাবধানে এস্টেটের কর্মচারীরাই জমিদারের খাজনা আদায় করবে, এই ব্যবস্থায় সন্ন্যাসী মেজকুমার রাজি আছেন। তাঁর উকিলেরা প্রস্তাব দিলেন যে, খাজনার রসিদ যদি বিভাবতীর মৃত স্বামীর বদলে শুধু বিভাবতীর নামে কাটা হয়, তা হলে প্রজাদের খাজনা দিতে আপত্তি কমবে।

এই নথির এক ধারে লিণ্ডসে একটি ছোট্ট কথা লিখে রাখতে ভুললেন না : ‘‘সাধুকে দেখে মনে হল উনি উত্তর ভারতীয়। তাঁর গৌরবর্ণ ত্বক সুন্দর মসৃণ, সিফিলিসের চিহ্নমাত্র নেই।’’

পাঁচ দিন পর ৩ জুন ভাওয়াল জমিদারিতে সকলের জ্ঞাতার্থে বাংলায় একটি ইস্তাহার জারি করা হল। তাতে লেখা:

নোটিস

এতদ্দ্বারা ভাওয়াল স্টেটের সমস্ত প্রজাবর্গকে জানানো যাইতেছে যে, রেভিনিউবোর্ড সিদ্ধান্ত প্রমাণ পাইয়াছেন যে, ভাওয়ালের দ্বিতীয় কুমারের মৃতদেহ বারো বৎসর পূর্বে দার্জিলিং শহরে ভস্মসাৎ হইয়াছিল। সুতরাং যে-সাধু দ্বিতীয় কুমার বলিয়া পরিচয় দিতেছে সে প্রতারক। যে কেউ তাহাকে খাজানা অথবা চাঁদা দিবেন তিনি তাহার নিজের ঝুঁকিতে দিবেন।

বোর্ড অব রেভিনিউর অনুমত্যানুসারে জে এইচ লিণ্ডসে, কালেক্টর, ঢাকা। ৩/৬/২১।

এস্টেটের কর্মচারীদের এই বিজ্ঞপ্তি চতুর্দিকে প্রচার করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হল। তাঁদের সতর্ক করে দেওয়া হল যে, তাঁরা যেন কোনও মতেই এমন কথা না বলেন বা এমন আচরণ না করেন যাতে মনে হয় সন্ন্যাসীকে মেজকুমার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার এক সপ্তাহ পর ১০ জুন যখন সেটি মির্জাপুরের হাটে ঢোলসহরৎ দিয়ে প্রচার হচ্ছে, তখন প্রজারা রীতিমত ক্ষিপ্ত হয়ে এস্টেটের কর্মচারীদের আক্রমণ করেন। পুলিশ ডাকা হয়, তবু গোলমাল চলতে থাকে। শেষকালে পুলিশ গুলি চালায়, ঝুমর আলি নামে এক প্রজা গুলিতে প্রাণ হারান।

সরকার আর জনতার মধ্যে বিরোধ প্রকট হয়ে পড়ল। অনেকেরই মনোভাব তখন এ রকম যে, সরকার যাই বলুক, দেশের মানুষ সন্ন্যাসীকে কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ বলে মেনে নিয়েছে— সে সিদ্ধান্তের কোনও নড়চড় হবে না।

পরবর্তী পঁচিশ বছর ধরে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কাহিনি বাংলার মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সে সময় বোধহয় এমন একজনও ছিল না যে, এই গল্প জানত না। আর সকলেরই একটা না একটা মত ছিল: সন্ন্যাসী কি সত্যিই ভাওয়ালের মেজকুমার, নাকি কোনও ধুর্ত ঠগবাজ?

এ দিকে ভাওয়াল অঞ্চলে ঘটনার গতি ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করছিল। পূর্বতন সন্ন্যাসী ঠাকুর বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন যে, তাঁর মনোগত বাসনা আসলে কুমার রমেন্দ্র হিসেবে ঢাকা শহরেই বসবাস করা। স্থানীয় মানুষ তাঁর নামে পাগল, সবারই মুখে এক কাহিনি, হারিয়ে ফিরে পাওয়া জমিদার কুমারের বৃত্তান্ত। অবস্থা শেষে এমনই ঘোরালো হয়ে দাঁড়ায় যে প্রজারা ব্রিটিশ কালেক্টরকে খাজনা দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে। সরকার বাহাদুর অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন— কী ভাবে এই ‘ভণ্ড সন্ন্যাসী’র ভণ্ডত্ব প্রমাণ করা যায়? বিভাবতী দেবী এক সময়ে জয়দেবপুরে গিয়ে প্রজাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে ইনি তিনি নন। অবশ্য, বিভাবতী দেবী নিজেই গিয়েছিলেন নাকি সরকার পক্ষ থেকে তাঁকে দূতী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।

এই পরিস্থিতিতে ‘সাধু’ কি ভণ্ড নাকি তিনিই প্রকৃত কুমার, তার ফয়সালার উদ্দেশ্যে ঢাকা কোর্টে মামলা শুরু হল ১৯৩০-এর ২৪ শে এপ্রিল।

মামলার বাদী পক্ষের বক্তব্য, সন্ন্যাসীই কুমার রমেন্দ্র, এবং ভাওয়াল রাজের সমস্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ তাঁরই প্রাপ্য। তাঁদের দাবি, এই মর্মে আদালত ডিক্রি জারি করুক। বাদী পক্ষের অভিযোগ, বিভাবতী দেবী কুমন্ত্রণার চাপে এবং সম্পত্তির লোভে এক বারও ‘স্বামীকে’ চাক্ষুষ না দেখেই তাঁর পরিচয় মানতে অস্বীকার করেছেন, এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁর এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়ে মাথা গলাচ্ছেন।

উল্টো দিকে, বিবাদী পক্ষে প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি— বিভাবতী দেবী। তাঁর মুখপাত্র ভাওয়াল এস্টেটের ম্যানেজার বিনওল্ড। আইনগত ভাবে যেহেতু ম্যানেজার সমস্ত এস্টেটেরই মুখপাত্র, তিনি একই সঙ্গে জমিদারির অন্য তিন জন ওয়ারিশেরও মুখপাত্র— বড় রানি সরযূবালা, ছোট রানি আনন্দকুমারী দেবী ও ছোট রানির দত্তকপুত্র রামনারায়ণ। এখানে বলে নেওয়া দরকার, ওয়ারিশ হিসেবে এই শেষ তিন জন মামলার বিবাদী পক্ষের অংশ হলেও তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন ছিল, যেমন রানি সরযূবালা সন্ন্যাসীকে দ্বিতীয় কুমার বলেই মনে করতেন।

মামলায় বাদী পক্ষের পরামর্শদাতা ছিলেন ব্যারিস্টার বিজয় চন্দ্র (সংক্ষেপে বি সি) চ্যাটার্জি, ভাবনাচিন্তা ও কার্যকলাপে যিনি ছিলেন দস্তুরমতো জাতীয়তাবাদী। মজার ব্যাপার, এ পক্ষের বি সি চ্যাটার্জিকে যদি জাতীয়তাবাদী ব্যারিস্টার বলা যায়, তা হলে বিবাদী পক্ষের পরামর্শদাতা ব্যারিস্টার অমিয় নাথ (এ এন) চৌধুরি ছিলেন ঠিক উল্টো, ঔপনিবেশিক শাসকদের বিশেষ নিকট ও আস্থাভাজন ব্যক্তি।

প্রসঙ্গত, ঢাকা কোর্টে এই জমজমাট মামলার মধ্য দিয়ে কিন্তু একটি নীরব অন্তর্নাট্যও ঘটে যাচ্ছিল। এই অন্তর্নাট্যের অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন সরকারি কর্মচারী ও আমলারা, এবং তাঁদের উল্টো দিকে— জজসাহেব পান্নালাল বসু। বাদী পক্ষ দাবি করছিল, ঢাকা জেলার সরকারি আমলারা প্রমাণ-ব্যতিরেকে আগে থেকেই সাধুকে ভণ্ড বলে ধরে নিয়েছে, এবং সত্যেন্দ্র ব্যানার্জির পক্ষ হয়ে কাজ করছে। এই সূত্র ধরে পান্নালাল বসু ও সরকারি পক্ষের মধ্যে রীতিমতো বিরুদ্ধতা শুরু হয়। সরকারের বিভিন্ন অফিস থেকে বসু যে সব দলিলপত্র তলব করেন, সরকারি প্রতিনিধিরা আদালতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে আপত্তি ও সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠেন। সব মিলিয়ে ভাওয়াল মামলার সূত্রে ঢাকার জজসাহেব সরকারের সঙ্গে একটা বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।

ঢাকা আদালত

পান্নালাল বসুর আদালতে শুনানি শুরু হয় ৩০ নভেম্বর। ফরিয়াদির পক্ষে প্রারম্ভিক বয়ান দেন বি সি চ্যাটার্জি। দ্বিতীয় কুমার যখন দার্জিলিং-এ, সে সময় তাঁর অসুস্থতা ও তথাকথিত মৃত্যুর ব্যাপারে যে সিভিল সার্জেন যুক্ত ছিলেন, সেই জে সি ক্যালভার্ট, ভাওয়ালের বড় রানি সরযূবালা দেবী, এবং কুমারের তথাকথিত মৃত্যুর সময়ে দার্জিলিং-এ উপস্থিত কলকাতার ডাক্তার প্রাণকৃষ্ণ আচার্য— এই তিন জনের সাক্ষ্য নিয়ে শুরু হয় মামলা।

ডাক্তার আচার্য সাক্ষ্যে বলেন যে তাঁর দিব্যি মনে আছে, দার্জিলিং-এ ১৯০৯-এর মে মাসের এক সকালে এক জন নার্স এসে তাঁকে ডেকে তোলে, দ্বিতীয় কুমার মারা গেছেন বলে ভয় হচ্ছে, তিনি গিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন ঘটনা তাই কি না। ভোর ছ’টার সময়ে ডাক্তার ‘স্টেপ অ্যাসাইডে’ পৌঁছলেন, দেখলেন এক ব্যক্তি খাটিয়ায় শয়ান, মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। পরীক্ষার জন্য তিনি যেই চাদরটা সরাতে যাবেন, ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বলে ওঠে, তিনি ব্রাহ্ম, মৃতদেহ ছোঁওয়ার অধিকার তাঁর নেই। ডাক্তার আচার্য ভয়ানক ক্ষুব্ধ হন এ কথায়, সে বাড়ি ছেড়ে তিনি তক্ষুনি হাঁটা দেন। অর্থাৎ দেহ তিনি দেখতেই পাননি। প্রতিবাদী পক্ষের উকিলের সওয়ালে ডাক্তার জানান যে তাঁর চল্লিশ বছরের ডাক্তারি জীবনে ধর্মের জন্য তাঁকে জীবিত বা মৃত দেহ ছুঁতে কেউ কোনও দিন বাধা দেয়নি। এ-ও বলেন যে, সেদিন যদি তাঁকে দেহ পরীক্ষা করতে দেওয়া হত, তিনি নিশ্চয়ই বলতে পারতেন সে ব্যক্তির সত্যিই মৃত্যু হয়েছিল কি না।

ভাওয়ালের বড় রানি সরযূবালা দেবী বলেন, ঢাকায় আসার প্রায় তিন বছর পর যখন সন্ন্যাসী কলকাতায় তাঁর বাড়িতে আসেন, সরযূবালা তৎক্ষণাৎ তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন। সেই সময় থেকে শুরু করে, ফরিয়াদি যখনই কলকাতায় আসতেন, মাসে নিয়ম করে অন্তত দু-তিন বার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। না, তিনি ফরিয়াদিকে কোর্টে মামলা লড়ার জন্য কোনও টাকাপয়সা দেননি। রানি সরযূবালা ঢাকায় না আসতে পারায়, কলকাতাতেই তাঁর সাক্ষ্য নিচ্ছিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল এন এন সরকার। বার বার রানিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সরকারের ধারণা হয় যে, সরযূবালা যে ফরিয়াদিকে এমন দৃঢ় ভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন, তার প্রধান কারণ— তৃতীয় রানির দত্তকপুত্র নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর ঘোর আপত্তি ছিল। প্রথম রানি চেয়েছিলেন, ছোট জা তাঁর ভাই-এর ছেলেকে দত্তক নিন, তৃতীয় রানি তাতে রাজি হননি। সেখান থেকেই তাঁদের তীব্র মনান্তর। …এন এন সরকারের যুক্তি অনুযায়ী এই সময় থেকেই প্রথম রানি অভিযুক্তের পক্ষে চলে যাওয়া মনস্থ করেন। সরযূবালা এই সমস্ত যুক্তি অস্বীকার করেন, বলেন যে তিনি ফরিয়াদিকে ১৯২৯-এর বহু আগেই চিনতে পেরেছিলেন, এবং তাঁর বিশ্বাসের কথা বহু জায়গায় বলেও বেড়িয়েছেন। এমনকী সরকারের কাছেও ফরিয়াদির প্রতি তাঁর মনোভাব অজানা থাকেনি।

ঠিক কোন্‌ পরিস্থিতিতে তাঁর কলকাতার বাড়িতে ফরিয়াদির সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে সে বিষয়েও সরযূবালার দিকে অজস্র প্রশ্নবাণ নিক্ষিপ্ত হয়। সন্ন্যাসীকে দেখার আগেই কি সরযূবালা মন ঠিক করে ফেলেছিলেন?

প্রশ্ন: ওঁকে দেখার আগেই কি আপনি আপনার ভাই শৈলেন্দ্র মতিলালের কাছ থেকে কোনও খবর পেয়েছিলেন, এই যেমন— কুমার বেঁচে আছেন বা এই ধরনের কিছু?
উত্তর: আমার ভাই একটা মামলার সূত্রে ঢাকা গিয়েছিল। ফিরে আসার পর জানতে চাইলাম, কী দেখলে বল। সে বলল, ‘দেখলাম, একদম সেই এক লোক।’

প্রশ্ন: আপনি স্বচক্ষে তাঁকে দেখবার কত দিন আগে আপনার ভাই-এর কাছ থেকে এ কথা শুনেছিলেন?
উত্তর: ঠিক মনে নেই, দুই বা আড়াই বছর আগে হবে।

প্রশ্ন: যখন ভাই-এর কাছে এ কথা শুনেছিলেন, সেই সময়ে আপনার মনে কুমারের মৃত্যু বিষয়ে সন্দেহ জাগার আর কোনও কারণ ঘটেছিল কি?
উত্তর: ভাই যা বলছিল, তাই শুনছিলাম, তার বেশি কিছু নয়।

প্রশ্ন: ‘শুনছিলাম’ বলে যদি আপনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চান, আমি কিন্তু কোর্টে পিটিশন দাখিল করতে বাধ্য হব। আর এক বার জিজ্ঞাসা করছি— আপনার ভাই-এর কাছ থেকে শোনার পর আপনার কি কোনও রকম সন্দেহ হয়েছিল?
উত্তর: লোকটিকে না দেখা পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

প্রশ্ন: আপনার কি এ কথা কখনও মনে হয়েছিল যে আপনার ভাই-এর ভুল হয়ে থাকতে পারে?
উত্তর: আমার ভাই তাকে দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই ফিরে আসে। আমি তাকে যতক্ষণ না দেখছিলাম আমার পক্ষে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব ছিল না।

প্রশ্ন: যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি এই প্রশ্নের উত্তর না দিচ্ছেন, আমাকে এই প্রশ্ন বার বার করেই যেতে হবে। আপনাকে আরও এক বার জিজ্ঞাসা করছি— আপনার ভাই-এর তথ্য যে ঠিক এ বিষয়ে আপনার মনে কি কোনও সন্দেহ ছিল?
উত্তর: ভাই আমার কাছে মিথ্যা কথা বলে না।

স্পষ্টতই, স্যর এন এন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন যে, ফরিয়াদিই যে দ্বিতীয় কুমার, সরযূবালা আগে থেকেই এ বিষয়ে তাঁর মন ঠিক করে ফেলেছিলেন। সুতরাং কুমারকে প্রথম দর্শনেই তিনি চিনতে পেরেছিলেন, সরযূবালার এই সাক্ষ্য খুব একটা মূল্যবান নয়।

এই সময়ে আর এক জন আত্মীয়া সাক্ষ্য দিলেন যে তিনি ফরিয়াদিকে দেখেই চিনেছিলেন— কুমারের মাসি কমলকামিনী দেবী। তিনি বললেন, দার্জিলিং-এ কুমারের সেই ‘মৃত্যু’র পর তিনি যখন বিভাবতী দেবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কী করে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হল, দ্বিতীয় রানি তাঁকে কেঁদে বলেন, শেষ সময়ে তাঁকে স্বামীকে দেখার অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তাঁকে বলা হয়েছিল যে কুমারকে শেষ দেখা দেখতে নানা গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসছেন, সেই সময়ে তাঁর পক্ষে বৈঠকখানায় যাওয়া শোভা পায় না। ফরিয়াদির ঢাকায় আগমনের পর কমলকামিনী যখন আবার বিভাবতীর সঙ্গে দেখা করতে যান, দ্বিতীয় রানি তাঁর কাছে জানতে চান, কী করে তিনি কুমারকে চিনলেন। কমলকুমারী বলেন, রানি সত্যভামা কী ভাবে দ্বিতীয় কুমারকে চিনতে পারেন, তার পর কেমন করে সত্যভামার মৃত্যুর পর কুমার তাঁর শেষকৃত্য করেন। এই ব্যক্তিই যে কুমার রমেন্দ্র কারওর মনেই তা নিয়ে কোনও সন্দেহের জায়গা ছিল না।

ফরিয়াদির নিজের কথাঃ

ফরিয়াদির পক্ষে কথা বলতে একের পর এক সাক্ষী আসতে শুরু করেছে, বলছে কেমন করে দ্বিতীয় কুমারকে তারা চিনতে পারে। এ দিকে সবার মনে মনেই এক প্রশ্ন, এক উত্তেজনা, কখন ওই ব্যক্তি নিজে এসে সাক্ষীর জায়গায় দাঁড়াবে। বহু প্রতীক্ষার পর শেষ অবধি সেই দিনটি এল। ১৯৩৩-এর ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় ভাগে, প্রত্যেক দিন পান্নালাল বসুর কোর্টরুম কানায় কানায় ভরে যেত কৌতূহলী জনতার ভিড়ে। কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ বলে যে ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁকে জেরা করা হচ্ছে!

উকিলদের পরামর্শ অনুযায়ী নিজের কথা বলতে শুরু করেন ফরিয়াদি। তাঁর— অর্থাৎ দ্বিতীয় কুমারের বাল্যকাল আর যৌবনের কথা। তাঁর হাত আর পা ছিল দেহের বাকি অংশের তুলনায় ছোট। ঠিক তাঁর মায়ের বা ভাইদের বা বোনদের বা ভাগ্নে-ভাগ্নীদের মতোই। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতোই তাঁর চুল ছিল লালচে, আর চোখ ছিল খয়েরি। বাঁ হাতের বাহুতে ছিল আঁচড়ের দাগ, এক বার রাজবাড়ির চিড়িয়াখানার একটি বাঘ তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় তার নখ কুমারের হাতে বসে যায়। পায়েও একটা দাগ ছিল, তৃতীয় কুমারের বিয়ের সময়ে একটা গাড়ি তাঁর পায়ের উপর দিয়ে চলে যায় বলে।

তার পর শুরু হয় দার্জিলিং যাত্রার গল্প, বার বার শুনে শুনে যে গল্প ইতিমধ্যে প্রায় সকলেরই জানা হয়ে গেছে। অসুখে পড়েছিলেন তিনি, সেই ১৯০৯-এর ৮ই মে-তে কোনও এক সময়ে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছিলেন। দার্জিলিং আসার পর মোটামুটি দু সপ্তাহ মতো তাঁর শরীর ভালই ছিল। তার পর এক রাতে পেট ফাঁপা থেকে অসুস্থতার শুরু। ‘‘সেই রাতেই আমি আশু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। পরের দিন এক সাহেব ডাক্তার আসেন। ওষুধ দেন। আমি খেয়ে নিই। তিন দিনের দিন আবার সেই একই ওষুধ খাই। কিছুই লাভ হয়নি। সেই রাতে আটটা থেকে ন’টার মধ্যে আশু ডাক্তার আমাকে একটা গ্লাসে করে কিছু ওষুধ দেন। তাতেও কিছু হয় না। ওষুধটা খেতেই বুক জ্বালা শুরু হল, বমি হল, সারা শরীরে ভীষণ অস্থিরতা। ওষুধ খাওয়ার প্রায় তিন চার ঘন্টা পর থেকে এই সবের আরম্ভ। চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু সেই রাতে কোনও ডাক্তার এল না,.. পরের দিন রক্ত পায়খানা আরম্ভ হল, বার বার। দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। তার পর এক সময়ে জ্ঞানও হারিয়ে ফেললাম।’’

জ্ঞান ফিরে আসে যখন, পাহাড়ের ওপর এক জঙ্গলের মধ্যে টিনের চালের তলায় তিনি শোওয়া, তাঁকে ঘিরে তিন চার জন সন্ন্যাসী। তখনও তিনি ভারী দুর্বল, সাধুরা তাঁকে কোনও কথা বলতে বারণ করে। ওদের সঙ্গে তিনি দু’সপ্তাহ মতো ছিলেন। তাদেরই সঙ্গে তিনি গেলেন বেনারস, সেখানে তারা চার মাস মতো সময় কাটায়। সেখান থেকে, কাশ্মীরের অমরনাথ। অমরনাথেই তাঁর গুরু ধর্মদাস তাঁকে মন্ত্র দেন। আগের জীবনে তিনি কে ছিলেন, কোথা থেকেই বা এসেছিলেন, এ সব কিছু তখনও অবধি তাঁর মনে পড়েনি। মন্ত্র পাওয়ার পরে আবছা আবছা অতীত জীবনের কথা মনে পড়তে শুরু করে। গুরুকে যখন তিনি এ কথা জানান, তিনি বলেন ধৈর্য ধরতে, ঠিক সময়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন।

পরের কয়েক বছরে ওই সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তিনি সারা উত্তর ভারত আর নেপাল চষে ফেলেন। ব্রহছত্রে থাকার সময়ে তাঁর হঠাৎ মনে হয়, তিনি এসেছিলেন ঢাকা থেকে। ধর্মদাস তাঁকে ঢাকা যেতে বলেন, পরিবারকে খুঁজতে বলেন, পরিবারের সঙ্গেই থাকতে চান কি না, সে বিষয়ে মন স্থির করতে বলেন। এ-ও বলেন যে, থাকতে না চাইলে তিনি ফিরে আসতেই পারেন হরিদ্বারে, গুরুর কাছে।

অসম থেকে তিনি ঢাকার ট্রেন ধরলেন। শহরে পৌঁছে তিনি যান বুড়িগঙ্গার দিকে, সেখানে থাকেন মাস তিনেক। সেখানে অনেক লোক আসত, তাঁর সঙ্গে কথা বলত। তারা বাংলায় কথা বলত, তিনি কিন্তু সব সময়েই হিন্দিতে উত্তর দিতেন, কেননা গুরু বলে দিয়েছিলেন একদম নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিজের পরিচয় প্রকাশ না করতে।

তারপর— জয়দেবপুরে যাওয়ার কথা। অতুলপ্রসাদ রায়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন সেখানে, তাঁকে তিনি চিনতে পারলেও নিজের পরিচয় তাঁকে তিনি দেননি। রাজবাড়িতে পৌঁছনোর পর যেন বন্যার মতো সব পূর্বস্মৃতি ফিরে আসতে থাকে। সব কিছু পরিচিত লাগতে শুরু করে। জ্যোতির্ময়ীর বাড়িতে গিয়ে কী ভাবে ঠাকুমা, বোনেরা, তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়, সেই বিবরণ দেন তিনি। তখনও কিন্তু তিনি হিন্দিতেই কথা বলছেন, জ্যোতির্ময়ীও হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর পরিচয়।

বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে ফরিয়াদির সঙ্গে এই সওয়াল-জবাবই মকদ্দমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ— এরই ওপর নির্ভর করবে জজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এ এন চৌধুরির অন্যতম প্রধান কৌশল ছিল— ফরিয়াদিকে কুমারের পূর্ব জীবন বিষয়ে খুব বেশি কিছু জিজ্ঞেস না করা। সন্ন্যাসী ঢাকায় প্রথম বার আবির্ভূত হওয়ার পর বারো বছর কেটে গেছে, এর মধ্যে সকলেই অনেক সময় পেয়েছে সন্ন্যাসীকে ভাল করে দ্বিতীয় কুমারের জীবনবৃত্তান্ত শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার।… চৌধুরি তাই ঠিক করলেন যে ফরিয়াদি যে ধরনের পরিচয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, সেই ধরনটা বিষয়ে প্রশ্ন করবেন। দেখা দরকার যে, এই যে ব্যক্তিটি সাক্ষীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান, সে কি সত্যিই এক জন বাঙালি জমিদার হতে পারে?

ইনি কি বাংলা বা ইংরেজি ছাপার অক্ষর পড়তে পারেন? না। হাতের লেখা? না, শুধু নিজের সইটুকু ছাড়া। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই কিন্তু ইনি নিজের নাম দস্তখত করতে পারেন। খবরের কাগজ পড়েন? না। অমৃতবাজার পত্রিকার নাম শুনেছেন কখনও? না। ইনি কি জানেন যে কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ অমৃতবাজার পত্রিকা রাখতেন নিয়ম করে? ফরিয়াদির উত্তর, সম্ভবত কুমারের নামে যে কাগজ রাখা হত সেরেস্তার কর্মচারীরাই সেটা পড়ত, কুমার পড়তেন না। অনুচররা অনেক সময় ইংরেজি কাগজে কোনও খবর পড়ে বাংলায় তাঁকে বলে দিতেন। তাঁর কি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে যাওয়ার দিনগুলো মনে পড়ে? হ্যাঁ। তাঁর তখন বারো বছর বয়স। তখন কোন ক্লাসে পড়তেন তিনি, মনে আছে? না। স্কুলে সবচেয়ে নিচু ক্লাস কোনটা ছিল জানেন? না। ক্লাস এইট হতে পারে কি? হতেও পারে। তিনি জানেন না, ক্লাস এইট কাকে বলে। শ্যামাচরণ মাস্টারকে কি তাঁর মনে পড়ে? হ্যাঁ। তাঁর নাম ছিল শ্যামাচরণ গুহ। তিনি কি পাটিগণিত জানেন? না। স্কুলে পড়েছেন, এমন কোনও বাংলা বা ইংরেজি বই-এর নাম বলতে পারেন? না। তিনি কখনও কোনও বই পড়েননি। সবসময়েই জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার যাওয়া আসা দেখতেন। স্কুলে অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলতে, চা বিস্কুট খেতেই তাঁর সময় চলে যেত। স্কুলে কি স্লেট বা কাগজ নিয়ে যেতেন সঙ্গে? হ্যাঁ। তাতে লিখতেন? না। অঁচড়ও কাটতেন না? কাগজে আঁচড় কাটবেন? কেন? তিনি কি বাঘ?…

অন্য পথে চলল জিজ্ঞাসাবাদ। ফরিয়াদি কি ওই কাগজে তাঁর সইগুলো চিনতে পারছেন? কোনও কোনওটা ঠিক আছে, কয়েকটা পরিষ্কার জুয়াচুরি। শশাঙ্ক ঘোষ, ঢাকার সরকারি উকিল, চিঠিগুলো আদালতে পড়ে শোনান— স্ত্রী বিভাবতীকে লেখা কুমারের চিঠি। ফরিয়াদির জবাব, সব জুয়াচুরি, ও সব চিঠি তিনি জন্মে লেখেননি।

ফরিয়াদির কি কখনও সিফিলিস হয়েছিল? হ্যাঁ, দার্জিলিং যাওয়ার চার পাঁচ বছর আগে।… তাঁর ডান হাতের বাহুর দাগটা কি বাঘের আঁচড়ের? হ্যাঁ। বেড়ালের আঁচড়ও তো হতে পারে? না। তিনি কি জানেন যে বাঘের বেড়ালের আঁচড়ের দাগে কোনও তফাত নেই? না, জানেন না। তিনি কেবল জানেন যে বাঘের সব ক’টা নখ তাঁর হাতে বসে যায়। বাঘের থাবায় ঠিক ক’টা নখ থাকে? তিনি জানেন না।

দার্জিলিং-এ যে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তিনি ছিলেন, তারা বাঙালি ছিল কি না তিনি বলতে পারেন না। তিনি তাদের সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলতেন, তারা কথা বলত হিন্দিতে, কিন্তু তিনি সেই সময়ে বাংলা আর হিন্দির পার্থক্য ঠিকমতো বুঝতেন না।…

ইংরেজি-বাংলা জ্ঞানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে একটা সময়ে এ এন চৌধুরি নিজেই একটু ঝামেলায় পড়েছিলেন। ফরিয়াদিকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে অনেক দিনের যোগাভ্যাসের কারণেই কি তাঁর নাক ভোঁতা? ফরিয়াদি উত্তর দেওয়ার আগেই বি সি চ্যাটার্জি লাফিয়ে উঠে জজকে বলেন, চৌধুরির নিজেরই ব্যবহৃত ‘ভোঁতা’ শব্দটি খেয়াল করতে। চৌধুরি সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংশোধন করে নেন। ‘‘আসলে ‘ভোঁতা’ নয়, আমি ‘মোটা’ বলতে চেয়েছিলাম।’’ চৌধুরি এ-ও বলতে পারতেন যে তাঁর মতো ইংরেজি-নবিশ বাবুর বাংলা জ্ঞান যতই কম হোক, বাঙালি জমিদারের পরিচয় জাল করা পাঞ্জাবি চাষার সঙ্গে তার তুলনা চলে না।…

বিভাবতী দেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে সওয়াল করায় ফরিয়াদি জানান যে, তাঁর স্ত্রীর শরীরের এমন এমন চিহ্নের কথা তিনি বলতে পারেন যেগুলো স্বামী ছাড়া আর কারওর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যেমন, বিভাবতীর ‘গোপন অঙ্গের’ এক পাশে ফোঁড়া হয়েছিল, তার একটি দাগ থেকে গেছে। বিয়ের আগে থেকেই রয়েছে ওই দাগ। এ এন চৌধুরি পুরনো স্মৃতি নিয়ে ফরিয়াদিকে বেশি না ঘাঁটিয়ে অন্যান্য যে যে প্রশ্ন করলেন, প্রায় সব ক’টার উত্তরই ফরিয়াদি দিলেন। কেবল একটি প্রশ্ন ছাড়া। বিভাবতী দেবীর বোনের স্বামীর নাম তিনি বলতে পারলেন না। ঠিক উত্তরের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, এমন সময়ে চৌধুরি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘সাক্ষীকে উত্তরগুলি সব ভাল করে শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ শুনে বি সি চ্যাটার্জি রাগে একেবারে ফেটে পড়লেন,‘‘আমার সততা সম্পর্কে উনি এতটুকুও বাঁকা ইঙ্গিত করলে কিন্তু রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যাবে।’ দুই ব্যারিস্টারই তাঁদের দুজনের জীবনের শ্রেষ্ঠ মামলাটি লড়তে লড়তে যা কাণ্ড বাধাচ্ছিলেন, সামলাতে গিয়ে পান্নালাল বসুর একেবারে জেরবার অবস্থা।…

এই মকদ্দমায় কুমারের আত্মীয়দের মধ্যে ফরিয়াদির পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন রাজকুমারী জ্যোতির্ময়ী দেবী, কুমারের বড় দিদি। পর্দানশীন জ্যোতির্ময়ী আদালতে না আসার জন্য আপিল করেন। ফলত, ১৯৩৪ সালের গ্রীষ্মে ঢাকায় পান্নালাল বসুর আদালত তিনটি সপ্তাহ ধরে প্রত্যহ জ্যোতির্ময়ী দেবীর বাড়িতেই বসে।

বি সি চ্যাটার্জি জ্যোতির্ময়ীর কাছে জানতে চান ভাওয়াল রাজ-পরিবারের ইতিহাস, কুমারদের ছেলেবেলার কথা। জ্যোতির্ময়ী দেবী বলেন, রাজবাড়ির ছোটদের শিক্ষার জন্য গৃহশিক্ষক আসতেন। তিনি নিজেই ষোলো বছর বয়সে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান হওয়া অবধি গৃহশিক্ষকের কাছে পড়েছেন। তিনি বাংলা পড়তে লিখতে জানেন, সামান্য ইংরেজিও জানেন। কিন্তু তাঁর ভাইরা, বিশেষত ছোট দু’ভাই, একেবারেই কোনও শিক্ষা পায়নি। কেননা, যখনই কোনও শিক্ষক তাদের জোর করে বসানোর চেষ্টা করত, পিতামহী সত্যভামা দেবী প্রবল আপত্তি করতেন। সত্যভামা দেবী তাঁর পৌত্রদের বিষয়ে একেবারে স্নেহান্ধ ছিলেন, বলতেন ওরা লেখাপড়া শিখে দিগ্‌গজ না হলেও কোনও ক্ষতি নেই। কুমারদের যদিও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পাঠানো হত, পড়ায় তাদের মোটেও কোনও মন ছিল না, আর বাবার মৃত্যুর পর সেটুকু নামকাওয়াস্তে শিক্ষাদানের ব্যাপারটাও আর রইল না। জ্যোতির্ময়ী এ-ও বলেন, তাঁরা সব ভাইবোনই খানিক হিন্দি বলতে পারেন কারণ অনেক হিন্দুস্তানি চাকর তাঁদের বাড়িতে ছিল। জ্যোতির্ময়ী এবং তাঁর বড় দিদি ইন্দুময়ী শহুরে ভদ্র শিক্ষিত বাংলায় কথা বললেও ছোট দু ভাই-এর কথাবার্তা না কি ছিল একদম ‘ছোটলোকদের মতো’।…

স্ত্রী বিভাবতীকে লেখা কুমারের যে সব চিঠি আদালতে পেশ করা হয়েছিল, সেগুলো জ্যোতির্ময়ী খুঁটিয়ে দেখে বলেন, ওগুলো রমেন্দ্র-র লেখা হতেই পারে না। রমেন্দ্র কোনও দিন তাঁর স্ত্রীকে চিঠি লেখেননি। সত্যি কথা বলতে কি, রমেন্দ্র লিখতেই জানতেন না। সরকারি কারণে যদি কোনও কাজের চিঠি লেখার দরকার হতো, লিখিয়ে নেওয়া চিঠির তলায় কুমার দস্তখত করে দিতেন।…

জ্যোতির্ময়ীর চোখ ছিল কটা, ফরিয়াদির মতোই। বাঙালিদের মধ্যে অমন কটা চোখ খুব বেশি দেখা যেত না, এটা ছিল ভাওয়াল কুমারদের পারিবারিক বৈশিষ্ট্য। তাঁরও হাত পা কুমারের মতোই ছোট ছোট, এ-ও পারিবারিক ধাঁচ। কবজির কাছে রুক্ষ চামড়া, সে-ও পরিবারের সকলের বৈশিষ্ট্য। রমেন্দ্র ও রবীন্দ্র, দুই ভাই-এর মতো তাঁরও গায়ের রং ভীষণ ফর্সা, প্রায় সাহেবদের মতো। তাঁর এবং তাঁর দু ভাই-এর চুলের রং ছিল খয়েরি।…

এ এন চৌধুরি জ্যোতির্ময়ী দেবীকে আবার তাঁর দিক থেকে জেরা করলেন। এটাই ছিল বোধ হয় কঠোরতম পর্ব। সরকারি মত অনুযায়ী, জ্যোতির্ময়ী দেবীই ভণ্ড সাধুকে খাড়া করার পেছনে প্রধান চক্রান্তকারী, সুতরাং তাঁকে ভাঙতে পারলেই মামলার নিষ্পত্তি। যদিও জ্যোতির্ময়ী দেবীর নিজের বাড়িতেই প্রশ্নোত্তরের এই পর্ব সমাধা হয়, জুলাই মাসের দারুণ গরমের সঙ্গে তীব্র প্রশ্নোত্তর মিলিয়ে অবস্থা শেষে এমন দাঁড়ায় যে, সাক্ষী একদিন অচেতন হয়েই পড়ে গেলেন। সেদিনকার মতো শুনানিও গেল বন্ধ হয়ে।

১৯৩৬-এর ২৪ অগস্ট। ঢাকায় পান্নালাল বসুর আদালতের সামনে লোক যেন ভেঙে পড়ছে। বহু লোক দাঁড়িয়ে আগের রাত থেকেই। কলকাতার কাগজগুলোও গন্ধে গন্ধে চলে এসেছে, এই মামলা যে একটি অসাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনা, সে আর তাদের বুঝতে বাকি থাকেনি। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ আর ‘বসুমতী’ তাদের রিপোর্টারদের জানিয়ে রেখেছে, যে মুহূর্তে আদালতের রায় বেরোবে, একেবারে তক্ষুনি তার করে কলকাতায় জানাতে। দুটি কাগজই এই উপলক্ষে তাদের বিশেষ সান্ধ্য সংস্করণ প্রকাশ করে— বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম।

ঘোষিত হল বিচারক পান্নালাল বসুর ঐতিহাসিক রায়। ৫২৫ পাতার রায়ের চূড়ান্ত বক্তব্য, ‘‘ফরিয়াদিই রমেন্দ্র নারায়ণ রায়, ভাওয়ালের প্রয়াত রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র।’’

এ দিকে, এই মামলার পরই পান্নালাল বসুর জীবনে এল এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, সরকারি চাকরি থেকে তিনি অবসর নেওয়া মনস্থ করলেন। বসুর এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভাওয়াল মকদ্দমার প্রত্যক্ষ অবদান কতটা, তা অবশ্য নির্ধারণ করা খুব সহজ নয়। এটা ঠিক, ঢাকা আদালতে দেওয়া তাঁর রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদী পক্ষ যে হাইকোর্টে আপিল করবেই এ বিষয়ে তিনি একেবারে নিশ্চিত ছিলেন। এ বিষয়েও বসু নিশ্চিত ছিলেন যে এই মকদ্দমায় তিনি যে ভাবে সরকারি আমলাদের ভূমিকার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছিলেন, তাও সরকারের পছন্দ হওয়ার কথা নয়।

বসুর অনুমানই ঠিক। হাইকোর্টে আপিল করলেন বিবাদী পক্ষ,— রানি বিভাবতী দেবী ও তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। আপিল শুনলেন তিন বিচারককে নিয়ে গঠিত একটি ‘স্পেশাল বেঞ্চ’— এল ডব্লিউ জে কস্টেলো, সি সি বিশ্বাস ও আর এফ লজ। লণ্ডনের ব্যারিস্টার কস্টেলো কলকাতা হাইকোর্টে এসেছিলেন ১৯২৬-এ। লজ ছিলেন আই সি এস, জেলার বিচার বিভাগে চাকরি করতে করতেই হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে তাঁর নিয়োগ। চারুচন্দ্র বিশ্বাস ছিলেন একেবারে খাঁটি ভারতীয় সন্তান, এ দেশেই তাঁর জন্ম ও কর্ম। এ এন চৌধুরি বা বি সি চ্যাটার্জির থেকে সি সি বিশ্বাসের পার্থক্য এই জায়গাটায়, তিনি কখনওই বিদেশে পড়াশোনা করেননি। ইংরেজি ও আইনশাস্ত্রের তুখোড় ছাত্র বিশ্বাস ১৯১০-এ হাইকোর্টে উকিল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কেবল আইন-দুনিয়াতেই নয়, সেকালের কলকাতার সমাজেও তাঁর একটি অতি বিশিষ্ট স্থান ছিল।

এই তিন জাঁদরেল বিচারকের সামনে চলল ভাওয়াল মামলার পুনর্বিচার, ১৯৩৮-এর ১৪ নভেম্বর থেকে ১৯৩৯-এর ১৪ অগস্ট, মোট ১৬৪ দিন ধরে।

বিবাদী পক্ষের উকিল এ এন চৌধুরি যে ভাবে তাঁর যুক্তিজাল বিস্তার করেন, তার মূল বক্তব্য দাঁড়ায়— পান্নালাল বসুর বিচারের একটি বিরাট ভুল এই যে, তিনি প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছিলেন সন্ন্যাসী ও দ্বিতীয় কুমার অভিন্ন ব্যক্তি। এবং সেই অভিন্নতার ধারণাটি সামনে রেখেই বসু অন্যান্য সব তথ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করেছেন। অথচ এই মামলার প্রেক্ষিতে, সন্ন্যাসী ও দ্বিতীয় কুমারের অভিন্নতার বিষয়টিই কিন্তু প্রধান প্রমাণসাপেক্ষ বিষয় হওয়া উচিত ছিল।

চৌধুরির এই যুক্তি মান্য বলে মনে করলেন না জাস্টিস চারুচন্দ্র বিশ্বাস। তাঁর মতে, বসুর বিচার-পদ্ধতি বুঝতেই চৌধুরি ভুল করছেন। জাস্টিস লজ অবশ্য সি সি বিশ্বাসের সঙ্গে দ্বিমত হলেন। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হল জাস্টিস কস্টেলোর বিচারে। কস্টেলো তথা হাইকোর্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন ২৯ অগস্ট, ১৯৪০: ‘‘ঢাকার ফার্স্ট অ্যাডিশনাল জজের রায় যে পাল্টানো দরকার, আপিলকারীরা তথ্য-সহযোগে এমন কথা প্রতিষ্ঠা করতে অসমর্থ হয়েছেন।’’

দ্বিতীয় পর্যায়েও জয়ী হলেন ফরিয়াদি ভাওয়ালের রহস্যময় সন্ন্যাসী।

হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত জেনে ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার প্রতিবাদী পক্ষ বেশ মুষড়ে পড়ে। সরকারি আমলাদের খুব আশা ছিল যে হাইকোর্টের জজমশাইরা ঢাকা আদালতের রায় ঠিকই উল্টে দেবেন। সি সি বিশ্বাস যে পান্নালাল বসুর রায় সমর্থন করবেন, আর লজ যে তা মানবেন না, এও এক রকম প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের শেষ দিকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ করলে এক জন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকও মানবেন যে দুটি রায়ই মোটের উপর প্রত্যাশিত ছিল। প্রশ্ন হলো— কস্টেলো কেন অমন সিদ্ধান্ত নিলেন? সেটা কিন্তু এখনও ভাওয়াল মামলার অন্যতম অজানা রহস্য হয়ে আছে। কস্টেলো ইংল্যাণ্ডের দিকে রওনা হওয়ার আগে যে বিশ্বাস তাঁকে বেশ কিছুটা প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু লজও তো তাঁকে যা বলার বলেছিলেন। অথচ শেষ অবধি পান্নালাল বসুর অনুসন্ধানের ফলাফলকে কস্টেলো যে ভাবে সমর্থন করলেন, তাতে লজও একেবারে আশ্চর্য না হয়ে পারেননি।

এ দিকে হাই কোর্টের সিদ্ধান্তে একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। তাঁর আপিল যে ধোপে টিঁকবে না, এ তিনি একেবারেই ভাবতে পারেননি। ১৯৪১-এর গোড়ায়, অর্থাৎ হাইকোর্ট-পর্বের ঠিক কয়েক মাসের মধ্যেই, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।

ইতিমধ্যে কলকাতা শহরে পৌঁছে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাওয়া।… আরও অনেক সম্পন্ন কলকতাবাসীর সঙ্গে ভূতপূর্ব সন্ন্যাসী ঠাকুরও (দুই আদালতের রায়ে ইতিমধ্যেই যিনি ভাওয়াল-কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায় বলে প্রতিষ্ঠিত) শহর ছাড়লেন। এই সময়টায় তাঁর দেখভাল করতেন রানি সরযূবালা। হাইকোর্টে আপিলের সময় থেকেই ফরিয়াদির বিচার-সংক্রান্ত সব রকম আর্থিক ভার, সব ব্যবস্থাপনার ভার প্রথম রানি হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত ধর্মভীরু, কলকাতার কালীঘাটে আর পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তিনি অনেক দানধ্যান করেছিলেন। রিপন ষ্ট্রিটে তাঁর বাড়ির পর্দার আড়াল থেকেই তিনি উকিল অ্যাটর্নির সঙ্গে ক্রমাগত আলাপ-আলোচনা করতেন, নিজের মতামত পেশ করতেন। ১৯৪২ সালে সেই বড় রানি চলে গেলেন কাশী, সঙ্গে গেলেন তাঁর সহোদর, আর দেবর রমেন্দ্র।

এই সময় অবধিও, ঢাকা কোর্টের ডিক্রি কিন্তু ফরিয়াদির পক্ষে জারি করা হয়নি, কেননা হাইকোর্টে তার মধ্যেই বিভাবতীর তরফ থেকে আপিল জারি করা হয়ে গেছে। আপিল বাতিল হল ১৯৪১-এর ফেব্রুয়ারিতে। রমেন্দ্রনারায়ণ ইতিমধ্যে দুই লক্ষ টাকার সিকিউরিটি ডিপোজিটের পরিবর্তে তাঁর ভাওয়াল জমিদারির ভাগ থেকে টাকা তোলার অনুমতি পেয়ে গেছেন।

১৯৪১-এর মে মাসে হাইকোর্টে তাঁর জিত হওয়ার পর ভাওয়ালের এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তিই এল তাঁর দখলে। সম্পত্তির দেখভালের ভার অবশ্য তখনও সেই কোর্ট অব ওয়ার্ডের ওপরেই, রমেন্দ্রনারায়ণ কেবল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে একজনকে নিযুক্ত করলেন তাঁর তরফে সম্পত্তির অংশ দেখাশোনা করার জন্য। বস্তুত, এ বিষয়ে সব রকম আইনি বাধা পার হওয়া গিয়েছে কি না, তা নিয়ে তাঁরা তখনও নিশ্চিত হতে পারেননি।

রানি বিভাবতী হার মানলেন না। তিনি চাইলেন, আরও একবার আপিল করতে— এ বার লণ্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে। প্রিভি কাউন্সিল সেই আমলের ব্রিটিশ ভারতের সর্বোচ্চ ও শেষ আদালত। হাইকোর্টে মামলার শুনানি চলার সময়েই বিভাবতী ও তাঁর ভাই-এর পরিবারের বিরুদ্ধে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো প্রবল আক্রমণ শুরু করে। আসলে, ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা-নাট্যের খলনায়কের ভূমিকায় বসানো হয় তাঁদের। এমনকী ল্যান্সডাউন রোডের বাইরে মাঝেমধ্যে ছোটখাটো ভিড় জমে যেত, বেশির ভাগ সময়েই ঢাকা থেকে কলকাতায় আসা লোকজনের ভিড়। এই জমায়েতে লোকজন গান গেয়ে, চেঁচিয়ে, যত রকম ভাবে সম্ভব অকথ্য গালাগালি বর্ষণ করত তাঁদের প্রতি। তাঁরা যদি কোনও উৎসব বাড়িতে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতেন, লোকে আঙুল দেখিয়ে বলাবলি করত, ‘দেখছ, এরাই ভাওয়ালের রাজকুমারকে বিষ খাইয়ে মারার তাল করছিল!’’ অবশ্য বিভাবতীদের একটা ছোট বন্ধুগোষ্ঠীও ছিল, এই সুকঠিন সময়ে যাঁরা তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ছিলেন কিছু উকিল, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম পি বি চক্রবর্তী। ঢাকা থেকেও মাঝে মাঝে কিছু লোকজন আসত রানির কাছে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য পৌঁছতে। এদের মধ্যে ছিলেন আশুতোষ দাশগুপ্ত, রানির প্রতি যাঁর ছিল অসীম আনুগত্য। বাস্তবিক, এতটাই অদ্ভুত হাবভাব ছিল তাঁর যে, রানির সঙ্গে তাঁকে জড়িয়ে সমানেই কানাঘুষো আর হাসাহাসি হতো। সত্যেন্দ্র ব্যানার্জির বৃত্তের বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষও এই পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। জমিদার এবং আইনসভার সদস্য, শরদিন্দু মুখার্জি তো একেবারে নিশ্চিত ছিলেন যে ভাওয়ালের সাধু ‘ভণ্ড’ ছাড়া কিছু না। আদালতে তিনি এই মর্মে সাক্ষ্যও দিয়েছিলেন।

ব্যানার্জি পরিবারের উপর শরদিন্দু মুখার্জি যে কতটা বিশ্বাস রাখেন, তার আরও গভীর প্রমাণ মিলল ১৯৩৭-এ, যখন সতেন্দ্র ব্যানার্জির ছেলের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়। অনেকেই শরদিন্দুবাবুকে এই সম্বন্ধ না করতে পরামর্শ দিয়েছিল। ওই পরিবারের ভাগ্যাকাশ অন্ধকার, সমাজে ওরা একঘরে, এ সব কথা লোকজন তাঁকে সমানেই বলতে থাকে। শরদিন্দুবাবু কিন্তু অবিচলিত ভাবে উত্তর দিতেন যে, এই বিবাহের সূত্রেই হয়তো ব্যানার্জি পরিবারের বিরুদ্ধে এই অকারণ সামাজিক বয়কট শেষ হবে।

প্রিভি কাউন্সিলে আপিলের জন্য রানি বিভাবতী যদিও খুবই উন্মুখ ছিলেন, বোর্ড অব রেভিনিউ-এর খুব একটা উৎসাহ ছিল না। এ এন চৌধুরি নাকি হাইকোর্টের ফলাফলে এতটাই হতাশ হয়েছিলেন যে তিনি আদালত থেকে সোজা নদীর পারে চলে আসেন, তাঁর কাগজপত্র সব ফেলে দেন ভাগীরথীর জলে। ভেবেছিলেন, মক্কেলদের মানই যখন তিনি রাখতে পারেননি, তখন ও পক্ষের আপিলের সঙ্গে তাঁর আর নিজেকে সংযুক্ত রাখা সঙ্গত নয়। পি বি চক্রবর্তী, যিনি হাইকোর্টে চৌধুরিকে সহায়তা করেছিলেন, তিনি অবশ্য অন্য পথে ভাবছিলেন। ফরিয়াদি পক্ষের বয়ান এতই শক্তপোক্ত যে প্রিভি কাউন্সিলে আর এক বার চেষ্টা করা উচিত, এই ছিল তাঁর মত। বিভাবতীর দিক দিয়ে তো আগ্রহ ছিল পুরোমাত্রায়।

ইতিমধ্যে একটা ঘটনা নিশ্চয় সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কুমার রমেন্দ্র যদিও বা তাঁর সম্পত্তির অধিকার ফিরে পান, বিভাবতীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আর জোড়া লাগবার নয়। সুতরাং দেবরের জন্য সম্পূর্ণ নতুন সংসার তৈরির ব্যবস্থা শুরু করলেন সরযূবালা। ১৯৪২-৪৩-এ তিনি আবার কুমারের বিয়ে দিলেন ধারা মুখার্জির সঙ্গে। কলকাতা থেকে জাপানি বোমার ভয়ে ঠিক একই ভাবে উত্তরে পালিয়ে আসা একটি পরিবারের মেয়ে ধারার বয়স তখন তিরিশের কোঠায়। বিয়ে হয় কাশীতে, বেশ ধূমধামের সঙ্গে। (পাঠককে এখানে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান আইন অনুসারে তখনও পর্যন্ত হিন্দু পুরুষ এক স্ত্রী থাকতেই দ্বিতীয় বার বিবাহ করতে পারতেন।)

….জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা ক্রমে থিতিয়ে এল, কলকাতার যে সব বড়লোক বা মধ্যবিত্ত চাকুরে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আবার ফিরে এলেন শহরে। ফিরলেন রমেন্দ্র নারায়ণও, সঙ্গে তাঁর নতুন স্ত্রী। স্ত্রী থাকতেন বিবেকানন্দ রোডের একটি বাড়িতে, বাড়িটি রানি সরযূবালার। রমেন্দ্রনারায়ণ নিজে থাকতেন ধর্মতলা ষ্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে। দুঃখের কথা, তাঁর এই সময়কার জীবন সম্পর্কে প্রায় কোনও কিছুই জানা যায় না।

প্রিভি কাউন্সিলঃ

রানি বিভাবতী ভেবেছিলেন, প্রিভি কাউন্সিলে তাঁর পক্ষ হয়ে লড়বেন ফণিভূষণ চক্রবর্তী। এ দিকে ১৯৪৫-এর গোড়াতেই পি বি চক্রবর্তী কলকাতা হাইকোর্টের জজ হিসাবে নিযুক্ত হলেন। চক্রবর্তী যখন বিভাবতীর ব্রিফ নিয়ে ইংল্যাণ্ডের দিকে রওনা হবেন, তখনই এল এই নির্দেশ। বিভাবতীর কাছে এ এক অভাবিত দুঃসংবাদ। এই মামলায় তাঁকে যেন একের পর এক দুর্নিয়তি তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। বিভাবতী এ বার পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা গভীর চক্রান্তের ছায়া দেখতে শুরু করলেন। ঢাকার মামলায় ফরিয়াদি পক্ষের উকিল হিসেবে মামলার নাড়ি-নক্ষত্র জানতেন শশাঙ্ককুমার ঘোষ, তাঁর ছেলে পঙ্কজকুমার ঘোষ এবার রওনা হলেন লণ্ডনের পথে। তাঁর কাজ অবশ্য অন্য— মামলার শুনানিতে সহায়তা করা। প্রিভি কাউন্সিলের সামনে পিটিশন উপস্থাপন করার ভার সাধারণত থাকত কিংস কাউন্সেল পদাধিকারী আইনজীবীর ওপরে। এই মামলায় সেই ভার পেলেন ডব্লিউ ডব্লিউ কে পেজ। কলকাতা হাইকোর্টে বহু বছর ব্যারিস্টার হিসেবে কাজ করে পেজ তখন সবে দেশে ফিরেছেন, আর যোগ দিয়েছেন কিংস কাউন্সেল হিসেবে।

অভিযুক্ত রমেন্দ্রনারায়ণের পক্ষে অবশ্য ছিলেন এক জন অতি সুবাগ্মী উকিল। ডি এন প্রিট তখন এক দিকে বিশিষ্ট বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা, অন্য দিকে ব্যারিস্টার হিসেবেও তাঁর প্র্যাকটিস দারুণ। ১৯৩৫ থেকে তিনি লেবার দলের সাংসদ, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি তাঁর সহানুভূতিও বেশ প্রকাশ্য। এক কালে তিনিই প্রিভি কাউন্সিলে বিপ্লবী কিশোরী লালের মামলা লড়েছিলেন। পরে, ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর, জমিদাররা তাঁকে কেবলই ধরাধরি করতেন তাঁদের হয়ে জমিদারি উচ্ছেদ আইনের বিরুদ্ধে মামলা লড়ার জন্য। রাজনৈতিক কারণেই কখনও তিনি তাতে রাজি হননি। বরং ১৯৫০-এ যখন পূর্ব পাকিস্তানের সরকার তাঁকে জমিদারি উচ্ছেদ আইনের সপক্ষে লড়তে বলে, তখন তাঁর উত্তর ছিল— ‘‘With pleasure, and success.’’ (উল্লেখ্য, এই আইনেই ভাওয়ালের জমিদারিটিও চিরতরে বিলুপ্ত হয়)। ১৯৫০-এ কোনও ফি ছাড়া ভারতের সুপ্রিম কোর্টে তিনি তেলেঙ্গানার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের হয়েও লড়েন, ১৯৫৮ সালে লড়েন কেরলের কমিউনিস্ট সরকারের বিতর্কিত শিক্ষা বিলের পক্ষে।

….প্রিভি কাউন্সিলের সামনে মূল সমস্যা দাঁড়াল, আপিল স্বীকার করা হবে কি হবে না। প্রিট জোর দিয়ে বললেন, পিটিশনার বিভাবতী দেবী যে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছেন, সেগুলি সবই তথ্য-সংক্রান্ত প্রশ্ন, এবং নিম্নতর দুই আদালতই যখন সেই সব তথ্যের ভিত্তিতে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, সে ক্ষেত্রে প্রিভি কাউন্সিল আবার ওই একই তথ্য যাচাই শুরু করতে পারে না। পেজ উল্টে যুক্তি দিলেন যে, কিছু তথ্যে যে বড় রকমের গলদ থেকে গেছে, এবং নিম্নতর দুই আদালত যে সেগুলি যথাযথ ভাবে বিচার করেনি— এমন সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। দুই পক্ষের যুক্তি শোনার পর পিটিশনার বিভাবতী দেবীকে আপিলের বিশেষ সুযোগ দিতে প্রিভি কাউন্সিল রাজি হল।

…উইলিয়াম পেজ বললেন, সত্যেন্দ্রনাথ মৈত্র এবং ১৯০৯-এর মে মাসে লুইস জুবিলি স্যানিটারিয়ামে যে অধ্যাপকেরা ছিলেন, তাঁদের সবার সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করে ঢাকা কোর্টের ট্রায়াল জজ খুব ভুল করেছিলেন। অথচ ৮ মে তারিখে যে কুমারের সত্যিই মৃত্যু হয়েছিল, সে কথা প্রমাণ করতে কিন্তু তাঁদের এই সাক্ষ্যই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে ব্যক্তি ওই মৃত্যুসংবাদটির প্রকৃত বাহক, অর্থাৎ স্যানিটারিয়ামে যে ব্যক্তি খবরটা প্রথম পৌঁছে দেয়, কোর্টে তাকে হাজির করা যায়নি। কেবল তাই নয়, সে যে কে, তা-ও আর পরে বোঝা যায়নি। ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ বাড়িটি থেকেই যে সে খবরটা বহন করে এনেছিল, সেটাও ছিল নিছকই অনুমান। অর্থাৎ মৈত্র ও তাঁর দলের সাক্ষ্য বলতে যা কিছু, সবেরই ভিত্তি ছিল একটি উড়ো কথা। ‘কুমার মারা গেছেন’ বলে সেই সন্ধেতে খবর ছড়িয়েছিল ঠিকই, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া সে মৃত্যুর কথাটা তো ধোপেই টিঁকতে পারে না!

পেজ এ-ও বললেন যে ট্রায়াল জজ ডক্টর অ্যাণ্ড্রু ক্যাডির মেডিক্যাল রিপোর্টের তথ্যকে খারিজ করেও বড় ভুল করেছেন। সেই রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা ছিল যে কুমারের চোখ ছিল ছাই রঙের। অর্থাৎ ক্যাডির মতে আলোচ্য ব্যক্তির চোখ নিশ্চয়ই খয়েরি ছিল না। অথচ, বিতর্কিত চরিত্রটির চোখের রং কিন্তু পরিষ্কার খয়েরি! জজ কিন্তু এত বড় একটা সূত্রকে আমল না দিয়ে উল্টে এই সিদ্ধান্তই করেছিলেন যে কুমারের চোখও খয়েরি ছিল।

তৃতীয়ত, পেজ বলেন যে কুমারের হাতে পায়ে বেশ কিছু দগদগে ক্ষতের দাগ ছিল, সিফিলিসের তৃতীয় স্টেজে পৌঁছলে যে রকম ক্ষত হয়, তেমন। ট্রায়াল জজ কিন্তু মাত্র তিনটি ক্ষতের দাগ পেয়েছিলেন ফরিয়াদির কনুই-এর কাছে। আর সেই দেখেই সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে ফরিয়দি এক জন পুরনো সিফিলিটিক ব্যক্তি। এ দিকে সিফিলিস যদি তার তৃতীয় স্টেজে পৌঁছয়, তা আর কোনও দিন সারে না বলেই কোর্টে দাখিল-করা এক্সপার্টের রিপোর্ট বলছে। অর্থাৎ কুমারের যে ধরনের সিফিলিসের শারীরিক চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়, তাতে এমনকী বারো বছর পরেও তাঁর পক্ষে এক জন পরিষ্কার ত্বকের মানুষ হিসেবে ফিরে আসা অসম্ভব।

চতুর্থত, পেজ এও কাউন্সিলকে মনে করিয়ে দেন যে তিনি যা যা বলছেন, হাইকোর্টের এক জজও সেই প্রতিটি কথাই বলেছিলেন। অর্থাৎ সেখানেও তাঁর প্রদত্ত যুক্তির কোনও সদুত্তর মেলেনি। একদম শেষে পেজ একটা ‘টেকনিক্যাল পয়েন্ট’ তোলেন। বিভাবতী দেবী তাঁর স্বামীর তথাকথিত মৃত্যুর পর জমিদারির কিছু অংশের মালিকানা পেয়েছিলেন, কিন্তু যে অধিকার-বলে তিনি এই সম্পত্তির উত্তরাধিকার পান, তা ছিল তাঁর স্বামীর অধিকারের পরিপন্থী (adverse to his right)। অর্থাৎ তাঁর স্বামী এখন ফিরে এলেও বিভাবতীর অধীনে যে সম্পত্তি, তাতে এখন আর তাঁর কোনও দাবি থাকতে পারে না।

প্রিট পরে পেজের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন: ‘ইনি এমন একজন আইনবিদ যাঁর সম্পর্কে আমি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করি।’ বহু বছর কলকাতায় আইন প্র্যাকটিসের ফলে পেজ যেমন করে ভারতীয় সমাজ, বিশেষত বাংলাদেশের সমাজ, চিনেছিলেন, প্রিট নিজে মোটেই তেমন করে চিনতেন না। আবার তার সঙ্গে, ‘কেমন করে একটা মামলা চালাতে হয়, সে বিষয়ে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান ও প্রশ্নাতীত ক্ষমতা। পক্ষেই হোক আর বিপক্ষেই হোক, তাঁর সঙ্গে কোনও একটা মামলায় জড়িত থাকাটাই ছিল একটা আলাদা আনন্দের ব্যাপার।’

প্রিট অবশ্য যুক্তি দেন যে মৈত্র ও তাঁর দলের প্রমাণাদি স্বীকার করে ট্রায়াল জজ ঠিকই করেছিলেন, এবং সমস্ত তথ্যপ্রমাণ দেখার পর জজ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাতেও কোনও ভুল ছিল না। সাধারণত যেখানে আগের দুই আদালত একই মত দিয়েছে, প্রিভি কাউন্সিল সেখানে তথ্যপ্রমাণ আবার বিশদ ভাবে বিচার করে না। এ ক্ষেত্রেও সেই সাধারণ নিয়ম অনুসরণ না করার কোনও বোধগম্য কারণ থাকতে পারে না।…

লর্ড থ্যাঙ্কারটনের রায়ঃ

আঠাশ দিন ধরে চলল মামলার শুনানি। প্রিভি কাউন্সিলের মাপকাঠিতে বিচার করলে এটি অবশ্যই একটি অস্বাভাবিক রকমের বড় মামলা। ১৯৪৬-এর ৩০ জুলাই, লর্ড থ্যাঙ্কারটন তাঁর রায় দিতে উঠলেন। লর্ড দ্যু পার্ক এবং স্যর মাধবন নায়ারও তাঁর রায়ের সঙ্গে একমত।

প্রথমত, থ্যাঙ্কারটন বললেন যে ট্রায়াল জজ এবং হাইকোর্টের জজরা ফরিয়াদিকে পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রিভি কাউন্সিলের বোর্ডের সেই সুযোগ ছিল না।…

তিনি এ-ও বললেন, ‘‘কোনও দেশের নিজস্ব আচার, আচরণ বা সংস্কার যে মামলায় ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকে, যে মামলার প্রকৃত গুরুত্ব একমাত্র সেই দেশের আদালতের পক্ষেই ভাল ভাবে বোঝা সম্ভব, বোর্ড কখনওই সে বিষয়ে নিজের সাধারণ ব্যবহার-রীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করে না।’’ বিশেষত, থ্যাঙ্কারটনের মতে, ‘‘এর মতো এত অসাধারণ জটিল ও বিশালাকার মামলা সহজে দেখা যায় না।’’

ফরিয়াদিই কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায়, আগের সিদ্ধান্তের মর্ম ছিল এই। আপিলকারীর আপত্তি তিন জায়গায়: এক, মৈত্র ও তাঁর দলের সাক্ষ্যের অগ্রহণযোগ্যতা; দুই, ডাক্তার ক্যাডির রিপোর্টে পাওয়া কুমারের চোখের রং-এর বিষয়; এবং তিন, ফরিয়াদির দেহে সিফিলিসের দাগ-সংক্রান্ত প্রশ্নাদি।

মৈত্র ও তাঁর দলের সাক্ষ্য বিষয়ে, থ্যাঙ্কারটন জানান যে— ….‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এ যে ব্যক্তি সংবাদ নিয়ে এসেছিল, সে যে কোনও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেই প্রেরিত হয়েছিল, এ কথা অনুমান করে নিয়ে ট্রায়াল জজ ভুল করেননি। এ অনুমান ঠিক ছিল, না ভুল ছিল, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন, এবং প্রিভি কাউন্সিল যেহেতু আবার নতুন করে তথ্যপ্রমাণ ঘাঁটতে চায় না, সেই প্রশ্ন বিচার করার মতো অবস্থাতেও তারা নেই।

দ্বিতীয় বক্তব্য, কুমারের চোখ বিষয়ে ক্যাডি ‘ছাইরঙা’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। এবং সেই রিপোর্টে বয়ানকেই চূড়ান্ত ধরা হোক, এই হল আপিলকারীর বক্তব্য। কিন্তু, ‘‘এই বক্তব্য দাঁড়ায় না। কেননা কুমারের চোখের রং বিষয়ে স্ববিরোধী মন্তব্য পাওয়া যায়। কালীপ্রসন্ন বিদ্যাসাগর কুমারকে অনেক দিন ধরে চিনতেন, এবং ১৯১০-এর ৬ মার্চ ইনসিওরেন্স কোম্পানিকে তিনি যে অ্যাফিডেভিট দেন, তাতে কিন্তু কুমারের চোখ খয়েরিই বলা ছিল। উপরন্তু, অন্যতম সাক্ষী গিরিশচন্দ্র সেন বলেছেন যে ডাক্তার ক্যাডি তাঁকেই জিজ্ঞেস করেন যে কুমারের দেহে কোনও বিশেষ নির্দেশক চিহ্ন ছিল কি না, তাতে তিনিই ডাক্তারকে জানান, কুমারের চোখ ছিল ‘ছাইরঙা’, অর্থাৎ ‘কটা’।…

তৃতীয় বক্তব্য ছিল, ফরিয়াদির দেহের ক্ষতচিহ্নগুলো দেখে তাঁর সিফিলিস সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না। ‘‘কিন্তু ফরিয়াদির বাঁ হাতে কনুই-এ একটি ও ডান হাতের কনুই-এ দুটি ক্ষতচিহ্ন ছিল, এটুকুই যথেষ্ট। ঠিকই, যে পরিমাণ ক্ষত কুমারের ছিল বলে জানা যায়, তার তুলনায় এগুলো কম বলেই মনে হয়। কিন্তু মহামান্য বিচারপতির কাছে এই প্রমাণও যথেষ্ট যে, অন্তত এই চিহ্নগুলো দ্বিতীয় কুমারের দেহের অবশিষ্ট ক্ষত বলে মনে করা যেতেই পারে।’’…

আপিল বাতিল হয়ে গেল।

সংক্ষেপে, প্রিভি কাউন্সিলের বিচারক মণ্ডলীর সিদ্ধান্ত — প্রথমত, ভারতবর্ষের দুইটি আদালত যে মামলার ক্ষেত্রে একই রায় দিয়েছে, — পুরোপুরি আইন মেনে চলতে হলে— অত্যন্ত বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া প্রিভি কাউন্সিল সেই মামলার সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ আবার তৃতীয় বারের জন্য পরীক্ষা করতে বসতে পারে না। এবং, মান্য বিচারপতিদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই মামলাকে তেমন একটি অত্যন্ত বিশেষ ক্ষেত্র বলা চলতে পারে না। কেন প্রিভি কাউন্সিলকে তার সাধারণ নিয়মরীতি ভেঙে এই মামলার ক্ষেত্রে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে, আপিলকারী মোটেই তেমন কোনও যুক্তি দাঁড় করাতে পারেননি।

দ্বিতীয়ত, ১৯০৮-এর লিমিটেশন আইন (নয়), ধারা ১৪৪ অনুযায়ী স্বামী মৃত ধরে নিয়ে বিভাবতী দেবীকে তাঁর স্বামীর অধিকারের পরিপন্থী অধিকার হিসেবে সম্পত্তি দেওয়া হয়েছিল। মান্য বিচারপতিরা বললেন যে, যখন একজন হিন্দু মহিলা ভুলবশত স্বামীর মৃত্যু হয়েছে ধরে নিয়ে কোনও সম্পত্তি পান, কোনও যুক্তিতেই তাঁর সেই অধিকার সমর্থনীয় নয়।

তৃতীয়ত, মৈত্র এবং তাঁর দলের দেওয়া সাক্ষ্য স্বীকৃতিযোগ্য কি না, এই মর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছিল। ১৮৭২-এর প্রমাণ-সংক্রান্ত আইন ১-এর ৩, ৫৯, ৬০ আর ১১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী মহামান্য বিচারকরা সাব্যস্ত করলেন যে, হ্যাঁ, তাঁদের সাক্ষ্য স্বীকৃতিযোগ্যই।

সুতরাং, প্রিভি কাউন্সিলে তোলা আপিল নাকচ হয়ে গেল।

জাতীয়তাবাদের গোপন ইতিহাসঃ

ঔপনিবেশিক রাজত্ব যে শেষ হয়ে আসছে, তার ইঙ্গিত কি তখনই একটু একটু করে ফুটে উঠছিল? বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ সমাপ্ত, কত তাড়াতাড়ি ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব, সে বিষয়েও আলাপ-আলোচনা আরম্ভ হয়ে গেছে, ভারতের রাজনৈতিক নেতারা নয়া দিল্লির অফিসে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করছেন। ব্রিটিশ এলিটরাও কি ভাবছিলেন, ভারতীয়দের নিজেদের হাতেই এ বার তবে ভারতীয় সমস্যার সমাধান হোক? প্রিভি কাউন্সিলের এই একটিমাত্র রায়ের থেকেই যদি আমরা গোটা সময়টার ইতিহাসের সূত্র খুঁজে বার করার চেষ্টা করি, সেটা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সুতরাং— প্রিভি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ ঢাকা আদালতের ট্রায়াল জজের এ বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে, লণ্ডনের বিচারপতিরা সেই অধিকারে মোটেও হস্তক্ষেপ করবেন না — লর্ড থ্যাঙ্কারটনের সেই রায়ের গুরুত্ব বিষয়ে আমাদের বিরাট কোনও একটা দাবি করা উচিত হবে না। ঢাকার পূর্বতন জজসাহেব হেণ্ডারসন, যিনি পরে কলকাতা হাইকোর্টের জজ হয়েছিলেন, তিনিও খেয়াল করেছিলেন ব্যাপারটার অভিনবত্ব যে, ‘‘এ ক্ষেত্রে যদিও আইনবিধির তেমন কোনও নির্দেশ ছিল না, এবং দুই আদালত যেখানে একই কথা বলেছে, প্রিভি কাউন্সিল সাধারণ ভাবে সেখানে সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আপত্তি করে না, — লণ্ডনের বিচারপতিরা কিন্তু তাও ওই বিধবা মহিলাকে আপিল করার বিশেষ অনুমতি দিয়েছিলেন।’’ হেণ্ডারসনের সিদ্ধান্ত— ‘‘যদিও শেষে নিজেদের চালু প্রথা থেকে বিচ্যুত হওয়ার প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেন নি, মাননীয় বিচারপতিদের বিচারের রায় থেকে বোঝা যায় যে, আসলে লজসাহেবের সঙ্গেই তাঁরা একমত ছিলেন।’’ অর্থাৎ, প্রিভি কাউন্সিল প্রকৃতপক্ষে নিম্নতর আদালতগুলির রায় উল্টে দিতে পারলেই খুশি হত, নেহাত প্রথানুযায়ী এমনটা করা যায় না বলেই সেটা ঘটেনি — এই ভাবেই হেণ্ডারসন থ্যাঙ্কারটনের বিচারের ব্যাখ্যা করেছিলেন। এই ব্যাখ্যার সঙ্গে আমরা অনেকেই একমত না-ও হতে পারি। আবার, অনেকে আবার এ যুক্তিও দিতেই পারেন যে, আসলে রাজনৈতিক আবহাওয়ার বদলটা খেয়াল করেই বিচারকরা চলতি ধারা থেকে বিচ্যুত হওয়া উচিত কাজ বলে মনে করেননি। কে বলতে পারে, কোনটা সত্যি! হয়তো তাঁদের মাথায় এই সব রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার মোটেও কোনও জায়গা ছিল না! হয়তো তাঁরা শুধু আইনের মারপ্যাঁচ নিয়েই ভাবিত ছিলেন। হয়তো!

একটা ব্যাপারে কিন্তু অনিশ্চয়তার কোনও জায়গা নেই। সেটা হল— পান্নালাল বসু আর চারুচন্দ্র বিশ্বাসের আইনভাবনা বা রাজনীতি-ভাবনার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠছিল এক ধরনের জাতীয়তাবাদী ভাবধারা। আলোচনা, ভাবনা, কখনও ক1_80খনও এমনকী প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়েও ভারতীয়দের এক প্রজন্ম তখন সমানে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে তুলছেন। এঁরা সেই প্রজন্মেরই প্রতিনিধি। ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এই রকম মানুষ তখন হামেশাই চোখে পড়ত। নানা ধরনের বৃত্তিতে নিযুক্ত নারী পুরুষ তাঁরা সব— শিক্ষক, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, আমলা, এমনকী সৈনিক বা পুলিশ। সিভিল সার্ভেন্টদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত। ইভনিং পার্টির উত্তপ্ত আলোচনায় দু-চার পাত্র হুইস্কি পানের পর ভারতীয় ব্যুরোক্র্যাটরা নাকি তাঁদের ব্রিটিশ সহকর্মীদের রীতিমতো খ্যাপাতে শুরু করতেন, বলতেন— সাম্রাজ্যবাদের অপরাধের দায় থেকে তাঁরাও কিন্তু কোনও ভাবে মুক্ত নন। একজনকে উল্টে জিজ্ঞাসা করা হয়, এত অত্যাচারী যে শাসন, তার অধীনে তিনি নিজে কেন তা হলে চাকরি করেন? তাঁর উত্তর, ‘সে কেবল তোমাদের আস্তে আস্তে সরিয়ে দেবার জন্যই।’ আসলে ১৯৩০ সালের আগে যেসব ভারতীয় ঔপনিবেশিক প্রশাসনের উচ্চ পদগুলিতে যোগ দিয়েছিলেন— সৈন্যবাহিনীও তার মধ্যে পড়ে— তাঁদের অধিকাংশই আসতেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে। অর্থাৎ, আধুনিক পাশ্চাত্য ভাবধারা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিমাণে তাঁদের মধ্যে চারিয়ে গিয়েছিল, এবং তারই ওপর ভর দিয়ে তাঁরা তৈরি করে তুলছিলেন একটা নতুন ধরনের আধুনিক-জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক চরিত্রবৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্যকে বরণ করেও তার বিরোধিতা করার মধ্যে তাঁরা কোনও অস্বস্তি বা গ্লানির কারণ খুঁজে পেতেন না। আবার দেশের মানুষের থেকে এই শ্রেণী মানুষের বহুযোজন দূরত্বের সুবাদে যে সাধারণ মানুষ তাঁদের অভিহিত করতেন ‘ব্রাউন সাহেব’ নামে, তাতেও এঁদের কোনও হেলদোল ছিল না। এ ভাবেই তৈরি হয়ে উঠেছিল এক ধরনের নতুন ‘আধুনিক জাতীয়তাবাদী’ সাংস্কৃতিক সত্তা। ‘‘চাকরিতে থেকেও কখনও ব্রিটিশ সহকর্মীদের সঙ্গে এঁরা সম্পূর্ণ মিশে যেতে পারেননি,’’ এক ভারতীয় আই সি এস-এর এক সদস্য এ ভাবেই ব্যাখ্যা করেন সেই পরিবর্তনশীল সময়টাকে। ভারতীয় সদস্যরা ‘‘বরং তাঁদের নিজস্ব জাতীয় সত্তা আঁকড়ে থাকতেন, আর যতই সার্ভিসে তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকত, ততই সেই সত্তাকে যেন আরও বেশি করে জাহির করতেন।… দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে যেতেন তাঁরা, যে স্বাধীনতার আন্দোলনে তাঁদের যোগ দেওয়ার আর কোনও উপায়ই ছিল না।’’ জাতীয়তাবাদী নেতাদের প্রতি তাঁদের ছিল বিশেষ শ্রদ্ধা, যদিও আন্দোলনের ধরনে হয়তো তত একটা আস্থা ছিল না।… শেষ পর্যন্ত যখন স্বাধীনতা এল, তাঁরা খুশি হয়েছিলেন।’’

দেশের বিচারব্যবস্থার মধ্যেই সম্ভবত এই ব্যাপারটা ছিল সবচেয়ে স্পষ্ট। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের বেশির ভাগই ছিলেন পেশায় আইনজীবী। আইনজীবীরা সহজেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ দিতে পারতেন, তার কারণ তাঁদের পেশার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল স্বাধীনতা, তাঁদের সরকারের গোলামি করতে হত না। যদিও পেশাগত কারণে তাঁদের সবসময়েই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকতে হত, অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে থাকতে হত। আইনের ধারা অধ্যয়ন, মামলার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি সাজানো, ইতিহাস ঘেঁটে যুক্তি-তর্ক করা, রায় দেওয়া, সব কটি কাজের মধ্য দিয়েই ভারতীয় আইনজ্ঞ ও বিচারকরা আধুনিক ব্রিটিশ আইনের মূল নীতিগুলিকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মতে, আলোক-যুগের যে সর্বজনীন যুক্তিবাদ, ব্রিটিশ বিচার-ব্যবস্থার মধ্যেই তার সর্বোৎকৃষ্ট মূল্যবোধগুলি বিধৃত রয়েছে। ভারতীয় সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁরা সেই সর্বজনীন নীতিগুলি পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতেন, ব্যবহার করতেন, বিশদ করতেন।

তাঁদের কাছে এটাই ছিল একটা মস্ত জাতীয়তাবাদী লড়াই-এর জায়গা,— আধুনিক রাষ্ট্রের উপযোগী আধুনিক আইন কাঠামো নির্মাণ করা, যার ভর থাকবে যুক্তিবাদ আর আধুনিকতার সর্বজনীন সূত্রের ওপর, কিন্তু আবার একই সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতার সঙ্গেও তার সামঞ্জস্য থাকবে। ১৯৩০-এর মধ্যেই এই বিশেষ প্রজন্মের জাতীয়তাবাদীরা ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, একমাত্র তাঁদের দ্বারাই এ কাজ সম্ভব। বস্তুত, এ দেশে ঔপনিবেশিক আমলারা যত দিন থাকবে, তত দিন প্রকৃত ভারতীয় রাষ্ট্র ও তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান কাঠামো তৈরি করা যাবে না বলেই তাঁরা বিশ্বাস করতেন।

পান্নালাল বসু ও চারুচন্দ্র বিশ্বাসের বিচার খুঁটিয়ে পড়লে জাতীয়তাবাদের এই ভাবধারারই প্রচুর চিহ্ন মেলে। তাই, সিনিয়র আই সি এস অফিসারদের সাক্ষ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের নিজেদের বিশ্বাসকে চালিত হতে দেননি, বিদেশি সাক্ষীদের প্রতি তাঁদের তীব্র বিদ্বেষ লুকিয়ে রাখেননি, তীক্ষ্ণ বিচারে তাঁদের পর্যুদস্ত করেছেন, বিদেশি অফিসার বা আমলাদের ঘনিষ্ঠ যে সব ভারতীয়, তাদের প্রতিও এই বিচারকদ্বয়ের ঘৃণা গোপন থাকেনি। আরও গভীরতর স্তরে, এই বিচারকদের ভাবনার মধ্যে একটা স্পষ্ট অবস্থানও লক্ষ করা সম্ভব, যে অবস্থান বলে— ভারতীয় সংস্কৃতি বা সমাজ তোমাদের থেকে অনেক আলাদা, তাই এক জন ইউরোপীয়ের পক্ষে কখনওই একজন ভারতীয়ের মতো করে সেগুলো বুঝতে পারা সম্ভব না। যেমন, কোন্‌ সাক্ষী কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেটাও কিন্তু বিদেশিদের পক্ষে সবসময় বোঝা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, এইখানে তৈরি হয়ে উঠছে জাতীয় জীবনের একেবারে নিজস্ব ক্ষেত্র— ‘inner domain’ — যেখানে ঔপনিবেশিকের প্রবেশের অধিকারই জাতীয়তাবাদ স্বীকার করে না। এই ‘নিজস্ব ক্ষেত্র’র মধ্যে পড়ে ভাষা, ধর্ম, পরিবার, মহিলা, অাধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি।…

ধরে নেওয়াই যায় যে, ভাওয়াল মামলা যদি আর দশ বছর আগেও হত, কোনও ভারতীয় বিচারকই বিদেশি শাসনযন্ত্রের সামনে একটা প্রেস্টিজ বাঁচানোর লড়াই লড়ার কথা হয়তো ভাবতেন না। এমনকী পান্নালাল বসুর মতো কেউ যদি দশ বছর আগেকার মানহানির মামলার গতি দেখে সাব্যস্তও করতেন যে, হাইকোর্ট বিচার উল্টে দেবে, তাও প্রকাশ্য প্রতিবাদ আসত কি না সন্দেহ। আসলে, বিংশ শতকের ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাসে এক দশক অনেকটা বড় সময়। ভাওয়াল মামলার ইতিহাস বলে, ১৯২০ আর ’৩০-এর মধ্যে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলির ভেতর থেকেই ঔপনিবেশিক শাসনকে ভেঙে ফেলার কাজটা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল।…

আবার একই সঙ্গে, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতি জাতীয়তাবাদের এই আক্রমণ থেকেই উঠে আসে আর একটা কথা। জাতীয়তাবাদ কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ও তার সর্বজনীনতার নীতি থেকে কখনও বিচ্যুত হয়নি। বরং ভাবা হত যে, ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের এই সীমাহীন ক্ষমতার দর্পিত চেহারার কারণ আসলে আছে তার উৎসে, — যতই আধুনিক হোক, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি তো বিদেশি আক্রমণ থেকেই। সত্যিকারের আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে এই আক্রমণ-ভিত্তিক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কখনওই সমার্থক হতে পারে না। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে যখন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক যুঝছেন ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে, পান্নালাল বসু ও সি সি বিশ্বাসের মতো সম্ভ্রান্ত উকিল আর বিচারকরা তখন একই সঙ্গে প্রবল প্রতাপে তুলে ধরছেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবি, যে দাবি আসলে আদ্যন্ত একটি ‘আধুনিক’ ভাবনা বই কিছু নয়।

এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ফরিয়াদির পক্ষে যে সব বিখ্যাত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী এ মামলা লড়ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বি সি চ্যাটার্জি, অতুল গুপ্ত, বঙ্কিম মুখার্জি, জে সি গুপ্ত। উল্টো দিকে বিবাদী পক্ষে যাঁরা লড়ছিলেন,— স্যর এন এন সরকার, স্যর বিনোদ মিটার, স্যর বি এল মিটার, এবং অবশ্যই এ এন চৌধুরি, পি বি চক্রবর্তী, পি বি মুখার্জি— তাঁরা কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারের কাছের মানুষ বলেই সমাজে পরিচিত ছিলেন। সাধারণ ভাবেও ভাওয়াল মামলা সম্পর্কে চালু ধারণা— এ মামলা সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের যুদ্ধ। আইনজীবীদের এই বিভাজন দেখলে সেই সাধারণ ধারণাটাই একটি অন্য দিক দিয়ে সমর্থিত হয়।

নিম্নবর্গের ভূমিকা বিষয়ে কয়েকটি কথাঃ

আর সাধারণ মানুষ? এই গোটা উপাখ্যানের মধ্যে তাদের জায়গা ঠিক কোথায়? মামলা চলার সময়ে তাদের অনেককেই আমরা দেখেছি— দুই পক্ষে সাক্ষী হিসেবে অন্তত হাজার কয়েক কৃষক আদালতে উপস্থিত হয়েছিল। তাদের কয়েক জনের বক্তব্য ছিল বেশ চমকপ্রদ। যেমন, একজনের মতে, ফরিয়াদি যে রাজকুমার, তা নিয়ে তার কোনও সন্দেহই ছিল না, কেননা তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে গিয়ে সে দেখে, দ্বিতীয় কুমারের পায়ে যেমনটি ছিল, ঠিক তেমনই এই ব্যক্তির পায়েও গোড়ালির কাছে চামড়া খানিক ওঠা-ওঠা। পায়ের গোড়ালির কাছে ওঠা-ওঠা চামড়া, এ যেন ভাওয়াল পরিবারের কুমার আর তাদের বোনদের বিশেষ একটা পারিবারিক বৈশিষ্ট্য।

কিংবা ধরা যাক সেই শোলা কারিগরের দেওয়া সাক্ষ্যের কথা। নলগোলার রাজবাড়িতে তাকে একটা ঘরে বন্ধ করে রেখে শাসানো হয়েছিল, সন্ন্যাসীর সঙ্গে দ্বিতীয় কুমারের কোথাও কোনও মিল নেই, এই কথা লেখা একটা কাগজে যদি সে সই না করে, আর কোনও দিন কোনও বরাত সে পাবে না। ভাওয়াল মামলার সমস্ত কাগজপত্র দেখার পর অবশ্য সন্দেহের বিশেষ জায়গা থাকে না যে, ওই অঞ্চলের চাষিদের মধ্যে একটা বিরাট অংশই একদম নিশ্চিত ছিল যে আসামীই রাজকুমার। কিছুটা রাজপরিবারের প্রতি ঐতিহ্যগত বিশ্বস্ততার কারণে, আর কিছুটা কোর্ট অব ওয়ার্ডের প্রতি বিরাগবশত, বহু মানুষই তাদের অন্তরের এই বিশ্বাসকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে গিয়ে অনেক দূর কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল। সাধু যখন প্রথম জয়দেবপুরে এলেন, খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন তখন সবে শুরু হয়েছে। প্রায় সব হিন্দু আর মুসলমান নেতারা তখন একযোগে একটা বড় ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের মঞ্চ গড়ে তুলছেন। আর এরই মধ্যে জয়দেবপুরের সাধু যেন সাধারণ মানুষের ব্রিটিশ-বিরোধিতা আর জাতীয় আবেগের একটা বিশেষ উপলক্ষ হয়ে উঠলেন। এক দিকে ইসলামের উপর ব্রিটিশ আক্রমণের নিন্দা, অন্য দিকে গাঁধীজীর ব্রিটিশ-প্রতিষ্ঠান বয়কটের স্বপ্নাতুর আহ্বান, — এর মধ্যেই নিহিত ছিল একটা অস্পষ্ট ইউটোপিয়ান ‘সু-রাজে’র আদর্শ, — যেখানে রাজা প্রজাকে বিপদে আপদে রক্ষা করে চলবেন, আর তার বদলে প্রজা রাজাকে দেবে তার চির-অানুগত্য। এই সময়ে, সন্ন্যাসী হিসেবে নির্বাসিত রাজার এই কাহিনী ছিল বিশেষ রকম সময়োচিত, ইউটোপিয়ান আদর্শের একেবারে যোগ্য আধার।

এর পরই আসে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পূর্ব বাংলায় যখন জমিদারি প্রথা বিলোপ চেয়ে প্রজা আন্দোলন আরম্ভ হল, কিংবা যখন ঢাকায় একের পর এক দাঙ্গার ফলে ওই সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, তখনও কিন্তু ভাওয়াল সন্ন্যাসীকে নিয়ে সাধারণ মানুষের অাবেগে ভাঁটা পড়েনি — কী ভাবে সম্ভব হল এটা? কেবল ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা শুনানির কাগজপত্র থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। একটা খুব দরকারি কথা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, — ভাওয়ালের সন্ন্যাসী কুমার কিন্তু এমন এক জমিদার, যিনি কখনও গদিতে বসারই অনুমতি পাননি। তিনি রাজা ছিলেন, রাজত্ব করতেই পারতেন, কিন্তু কোনও দিন তিনি তা করে উঠতে পারেননি। ফলত, একেবারেই বিস্ময়কর নয় যে সত্যিকারের জমিদারদের বিরুদ্ধে মানুষের যত ক্ষোভ, নিজেদের দুর্দশা নিয়ে চাষিদের যত বঞ্চনাবোধ, এ সবের সঙ্গে সন্ন্যাসী কুমারের প্রতি সাধারম মানুষের সহানুভূতির কোনও বিরোধ ছিল না, কেননা তিনিও তো ছিলেন অন্যায়ের শিকার! সেই অর্থে, দ্বিতীয় কুমারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দাবি, আর জমিদারি প্রথা বিলোপের আন্দোলন, — এ দুই লক্ষ্যের মধ্যে যথেষ্ট সঙ্গতি ছিল।

ভাওয়াল জমিদারির বেশির ভাগ প্রজাই ছিল মুসলমান। আবার তালুকদাররা বেশির ভাগই হিন্দু। এই মামলার নথিপত্র থেকে তা সত্ত্বেও মনে হয় না যে ১৯৩০ আর ’৪০-এর দশকের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাওয়া অভিযুক্তের সমর্থক কিংবা বিরোধীদের খুব একটা প্রভাবিত করতে পেরেছিল। ফরিয়াদির সমর্থনে সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির হয়েছিল অসংখ্য মুসলমান প্রজা, তাদের মধ্যে ছিলেন প্রজা আন্দোলনের নেতারাও। কুমারের সমর্থনে ডজন ডজন পুস্তিকা লিখেছিলেন মুসলমান লেখকরা, মুসলমান কবিরা গান বেঁধেছিলেন তাকে নিয়ে। পুব বাংলায় সুরাজ আর সামাজিক নীতিবোধের প্রকাশ চলত যে ভাষায়, তাতে কোনও হিন্দু মুসলমান ভেদ ছিল না। দুই সমাজেই অবাধে চলত এক শব্দ, এক ধরনের ধর্মীয় অনুষঙ্গ।

আধুনিকতা বা প্রগতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে অবশ্য বলতেই হবে, ভাওয়াস সন্ন্যাসীর মামলা নিয়ে যে গণসাহিত্য রচিত হচ্ছিল, সেগুলো ছিল ভয়ানক রকমের রক্ষণশীল। মজার মজার ছড়া আর কথার ভেতর থেকে স্পষ্ট বেরিয়ে আসত শিক্ষিত শ্রেণীর বিরুদ্ধ জমে থাকা সংস্কার। শিক্ষিত মানুষেরা না কি স্বভাবতই বিলাসপ্রিয়, অহঙ্কারী, পানাসক্ত, ব্যভিচারী আর অধার্মিক। ঐতিহ্য অনুসরণ করে মহিলাদের যে একদম পুরোনো জীবনযাপনে আবদ্ধ রাখা উচিত, এই রকম একটা দৃঢ় বক্তব্যও বেরিয়ে আসে এ সবের থেকে। ‘শিক্ষিত ভদ্রমহিলা’ নিয়ে রীতিমতো শাণিত আক্রমণাত্মক কথাবার্তা চলত এ প্রসঙ্গে। আশ্চর্য নয় একেবারেই, — ঊনবিংশ বা বিংশ শতকের সামাজিক ইতিহাস চর্চা করেছেন যাঁরা, তাঁরা বলেন অন্যান্য ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের ঠিক এই মনোভাবেরই প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার এটাই যে, ভাওয়াল মামলার সূত্রে এই সব কথাবার্তা মিলেমিশে থাকত প্রবল সামন্ততন্ত্রবিরোধী বা উপনিবেশবিরোধী আলোচনার সঙ্গে, প্রায়শই একটামাত্র popular text-এর মধ্যেই সব কয়টি প্রবণতাকে একই সঙ্গে চোখে পড়ত।

পান্নালাল বসু, চারুচন্দ্র বিশ্বাস ও রোনাল্ড ফ্রান্সিস লজ, মহিলা বিষয়ে এঁদেরও স্বভাবতই নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বসু ও বিশ্বাস, দুজনেই প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী মানুষ। বাংলার জাতীয়তাবাদী সমাজ-সংস্কারক নেতারা একশো বছর ধরে মহিলাদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য যে প্রয়াস করে গিয়েছেন, সেই আন্দোলনের ভাবধারা দিয়েই প্রভাবিত ছিল বসু বা বিশ্বাসের নারী-বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি।

সুতরাং, অভিযুক্ত রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের আইনগত অধিকার সমর্থন করলেও নিঃসন্দেহে তাঁরা দুজনেই কুমারদের জীবনযাত্রা গভীরভাবে অপছন্দ করতেন। যে অবক্ষয়ী সমাজ বা রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিনিধি ছিলেন কুমাররা, তাকে এঁরা আদ্যন্ত ঘৃণা করতেন। মনে করতেন, এই মানুষগুলো কেবল ঔপনিবেশিক অতীত জীবনের অংশমাত্র, দেশের ভবিষ্যৎ আধুনিক সমাজে যাদের কোনও স্থান থাকতে পারে না। তাঁরা এও মনে করতেন যে জমিদারি জীবনযাত্রায় মহিলাদের উপর যে নিরন্তর অত্যাচার চলে, এবং রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে স্বামীর মৃত্যুর পরে বিধবাদের উপর চলে যে সামাজিক নির্যাতন, এ সবেরই শিকার ছিলেন বিভাবতী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখার প্রভাবে গড়ে উঠেছিল যে প্রজন্মগুলির মানসিকতা— বসু ও বিশ্বাস ছিলেন তারই অংশ। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, মহিলাদের প্রতি এই সামাজিক নির্দয়তার দ্রুত বিনাশ প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে আর তাঁদের এই নির্যাতনের শিকার হতে না হয়।

নারী-সম্পর্কিত বিষয়ে বসু আর বিশ্বাসের মতামত আবার বিশেষ ভাবে প্রভাবিত ছিল শ্রেণীচেতনা দিয়ে। তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারতেন না যে জ্যোতির্ময়ী দেবী মিথ্যে কথা বলতে পারেন। কিন্তু আবার সহজেই ধরে নিতে পারতেন যে, ধাত্রী জগৎমোহিনী যেহেতু তুলনায় নিম্নতর শ্রেণীর, সুতরাং সে যদিও ব্রাহ্মণ বিধবা বলে নিজের পরিচয় দিয়েছে, আসলে সে নিচু জাত বা নিম্নশ্রেণীর মুসলমান।… বলা হয়ে থাকে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা যে পরিবর্তিত হিন্দু সমাজের স্বপ্ন দেখতেন, তা ছিল ভীষণ ভাবেই এক ব্রাহ্মণ্য সমাজ। সে ক্ষেত্রে, বসু আর বিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গি সেই মানসিকতাকে বেশ ঠিকঠাক ভাবেই প্রতিফলিত করত বলে মনে করা যেতে পারে। …

চূড়ান্ত পর্বঃ

প্রিভি কাউন্সিলের রায় বেরনোর পর দিন খবর পৌঁছল কলকাতায়। সে দিনটা ছিল ১৯৪৬-এর ৩১শে জুলাই। কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় শেষ পর্যন্ত তিনটি কোর্টে নিজের পরিচয় প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন। পর দিন যখন খবরটা শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গেল, তাঁর ধর্মতলা ষ্ট্রিটের বাড়িতে তখন শয়ে শয়ে লোকের ভিড়। সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানাতে চায়। সেই দিন সন্ধেতেই, কুমার যাচ্ছিলেন কর্নওয়ালিস ষ্ট্রিটের ওপর ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পুজো দিতে। ঠিক রাস্তায় বেরনোর সময়ে, তাঁর হৃৎযন্ত্র গেল বন্ধ হয়ে। কুমার অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। বয়স তখন তাঁর তেষট্টি। পর দিন হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ডে ছোট্ট মৃত্যু-সংবাদ বের হল— ‘‘তাঁর শরীর কিছু দিন ধরেই ভাল যাচ্ছিল না। হেমোটিসিসে আক্রান্ত হয়ে ১ অগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

প্রিভি কাউন্সিলের রায় জেনে বহু লোক তাঁর বাড়িতে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু-সংবাদ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। জানা গিয়েছে যে, বন্ধুবান্ধব ও প্রজাদের সঙ্গে দেখা করতে এ মাসের মাঝামাঝি জয়দেবপুর যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন কুমার।’’

এ দিকে জয়দেবপুরে জমিদারির আমলারা পড়লেন মুশকিলে। হাইকোর্টের অর্ডার অনুযায়ী, যতদিন না প্রিভি কাউন্সিলের আপিলের চূড়ান্ত ফল জানা যায়, কুমারের পাওয়ার অব অ্যাটর্নিসহ ম্যানেজার পি কে ঘোষ জমিদারিতে কুমারের অংশটুকুর দেখভাল করবেন, এই ছিল বন্দোবস্ত। মাসে কুমার হাতে পাবেন ১১০০ টাকা, তাঁর আয়ের বাকিটা জমা হবে ব্যাঙ্কে। হাইকোর্টের রায়ের পর দুবছর কেটে গিয়েছে, অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে ১ লক্ষ ৭৪ হাজার ৮৭৩ টাকা ৬ আনা ৩ পয়সা। কুমারের মৃত্যুতে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অবসান হল, ম্যানেজারের হাতে অ্যাকাউন্টের আর কোনও ভার রইল না, এ দিকে কুমার নিজে উত্তরাধিকার হিসেবেও কাউকে মনোনীত করে যাননি।

১৯৩৬ সালের ১০ অগস্ট, ভাওয়াল জমিদারির ম্যানেজার কলকাতার ধারা দেবীর কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম পেলেন: ‘’Husband died Saturday third August Sradh on Tuesday thirteenth Please arrange Jaidebpur Brahmin feeding with Madhab’s bhog distributing poors chiragur four annas each thirteenth positively in cooperation with all.” ম্যানেজার তাড়াতাড়ি ফিরতি তার করে জানালেন যে তিনি স্বর্গীয় কুমারের তহবিল থেকে টাকা নিতে অপারগ, এবং তাই ব্রাহ্মণভোজন বা কাঙালিভোজন, কোনওটাই তাঁর পক্ষে ১৩ অগস্টে করে ওঠা সম্ভব নয়।

কুমারের শ্রাদ্ধ হল কলকাতায়, ১৩ অগস্ট, ১৯৪৬। সাঁইত্রিশ বছরের মধ্যে তাঁর দুই নম্বর শ্রাদ্ধ। তিন দিন পর কলকাতা শহর ডুবল তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দাঙ্গার বীভৎসতায়। ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’— পরের চার দিনে নিহত হল প্রায় ৪০০০ মানুষ। শহরের দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলের প্রায় কেন্দ্রে কুমারের ধর্মতলা ষ্ট্রিটের বাড়ি, আর প্রান্ত এলাকায় মানিকতলায় ধারা দেবীর বাড়ি।…

ধারা দেবী অবশ্য জয়দেবপুরে ব্রাহ্মণ, সেরেস্তার কর্মচারী, আর দরিদ্রসাধারণকে খাওয়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরতে রাজি হলেন না। মাসের শেষে কুমারের এক মাসের শ্রাদ্ধ করার জন্য উকিল প্রফুল্ল মুখুটিকে টাকাপয়সা দিয়ে জয়দেবপুরে পাঠালেন। সেরেস্তার ম্যানেজার পি কে ঘোষ তাঁকে লিখলেন, ‘‘কাল ২ সেপ্টেম্বর রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের এক মাসের কাজ উপলক্ষে আপনার কথামতো জয়দেবপুরে ব্রাহ্মণভোজনের ব্যবস্থাপনায় প্রফুল্লবাবুকে সাহায্য করা হচ্ছে।’’

রানি বিভাবতী আর যে কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন, পুরো সময়টা জুড়েই অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতেন যে, যদিও পৃথিবীর সব আদালতের রায়েই তিনি পরাজিত, সবার উপরের বিচারকের বিচারে কিন্তু তাঁর হার হয়নি। বহু বছর আগেই যাঁর মৃত্যু হয়েছে, তাঁর পরিচয় ভাঁড়িয়ে যে ব্যক্তি চলেছিল দেবীর পুজো দিতে, দেবী তাঁকে সমুচিত শাস্তি দিয়েছেন। বিভাবতী দেবী না কি প্রিভি কাউন্সিলের রায়ে আশ্চর্য হন নি। কাশীর জ্যোতিষীরা তাঁকে বলেছিল যে তিনি হারবেন। কিন্তু তার সঙ্গে তারা এ-ও বলেছিল যে ওই ব্যক্তি কোনও দিন সম্পত্তিভোগ করতে পারবে না। জ্যোতিষীদের গণনাই ঠিক বলে প্রমাণিত হল।

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইস্ট বেঙ্গল এস্টেটস অ্যাকুইজিশন অ্যাণ্ড টেনান্সি অ্যাক্ট পাশ করল পূর্ব পাকিস্তান সরকার। এই আইনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হল। জমিদারদের বদলে এখন থেকে কৃষকপ্রজার সঙ্গে রাষ্ট্রের সরাসরি সম্পর্ক। জমিদারি বিলোপের ফলে স্থির হল যে, এখন থেকে জমিদার মাত্র তেত্রিশ একর জমি নিজের অধিকারে রাখতে পারবেন। অবশিষ্ট জমির উপর তাঁর আর কোনও অধিকার থাকবে না। সে জন্য অবশ্য ক্ষতিপূরণ মিলবে সরকার থেকে। বহু জমিদার এই আইনের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হলেন, দাবি করলেন যে এই আইন ‘রাইট অব প্রপার্টি’ বা নাগরিকের সম্পত্তির অধিকারের বিরোধী। জমিদারদের কাছে লর্ড কর্নওয়ালিস যে প্রতিজ্ঞা করেন, এ আইন তারও বিরুদ্ধে। আমরা আগেই বলেছি, ভাওয়াল কুমারের হয়ে মামলা লড়েছিলেন যে ডি এন প্রিট, তিনিই এই সময়ে ঢাকায় আসেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ হয়ে জমিদারদের মোকাবিলা করতে।

প্রিভি কাউন্সিলের রায় বেরনোর পর কিছু দিনের জন্য তৃতীয় রানি আনন্দকুমারীর দত্তকপুত্র রামনারায়ণ রায় তাঁর অংশের জমিদারির মালিক হয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে যখন জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হল, একেবারে সরাসরি নিজস্ব অংশটুকু বাদ দিয়ে জমিদারির বাকি অংশের অধিকার তাঁকে ছেড়ে দিতে হল। সেই বছরেরই মাঝামাঝি, মাকে1_80 সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে এলেন কলকাতায়।

জমিদারিতে রমেন্দ্র নারায়ণের যে অংশ ছিল, সেট্‌লমেন্ট-এর সময়ে কোর্ট অব ওয়ার্ডস মৃত কুমারের অন্যতমা রানি হিসেবে বিভাবতী দেবীর প্রাপ্য ধার্য করল আট লক্ষেরও কিছু বেশি টাকা। উকিলরা রানিকে বোঝালেন, এ তাঁরই টাকা, আপিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেবল এই টাকা কোর্ট অব ওয়ার্ডস তাদের নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু বিভাবতী তা মানলেন না, তাঁর যুক্তি— ‘‘ওরা তো ওই মৃত ব্যক্তির বিধবা ভেবেই আমাকে এই টাকা দিতে চাইছে! সে ক্ষেত্রে ও টাকা নিলে তো এত দিন পর্যন্ত যেটাকে আমি মিথ্যে বলে জেনে এসেছি, সেটাকেই এখন আবার স্বীকার করে নিতে হয়!’’ টাকা তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন।

ভাওয়াল সন্ন্যাসীর এই আশ্চর্য কাহিনির মধ্যে থেকে যদি কোনও একজন মূল নায়ককে বেছে নিতে হয়, তিনি বিচারক পান্নালাল বসু, ঢাকা আদালতের সাবঅরডিনেট জজ। তাঁর রায়ের ওপরেই ভিত্তি করে উচ্চতর আদালতের বিচারকরা এ মামলার পুনর্বিচার করেন। একটা আশ্চর্য রহস্য সমাধানের প্রবল ইচ্ছা তো বটেই, তা ছাড়াও বসুর এই বিচারের মধ্যে ছিল অনেক অতিরিক্ত অনুপ্রেরণা। তিনি সেই জাতীয়তাবাদী প্রজন্মের বিচারক, বিদেশি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাঁরা তাঁদের দৃষ্টিকে সচেতন ভাবে আলাদা করতে চেয়েছিলেন, বিদেশি সরকারের নথিপত্রকেও যাঁরা প্রবল সন্দেহের চোখে দেখতেন। পূর্ব জীবনে দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন বসু। তাঁর চাকরি জীবনের এই শেষ মামলাটিতে তাঁর সেই দর্শনবোধও দারুণ ভাবে কাজে লেগে যায়। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা প্রমাণ করে যে, মানুষের আত্ম-পরিচয় আসলে অর্থহীন, আকস্মিক। মানুষ যা বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করতে চায়, তাকেই বলে ‘পরিচয়’। পান্নালাল বসু বাংলাদেশের এক বিস্মৃত নায়ক। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত উচ্চশিক্ষিত জাতীয়তাবাদী ‘এলিটে’র প্রতিনিধি তিনি।

উত্তরকথাঃ

জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে এখন বাংলাদেশের গাজিপুর জেলার সরকারি অফিস। যে বড় দালানে জমিদারির সাহেব অতিথিরা এসে বসতেন, সেখানে এখন বসে গাজিপুরের ডেপুটি কমিশনারের অফিস। রাজবিলাসের একতলায় কুমারদের বৈঠকখানায় এখন পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট। ওপরে রানিদের ঘরগুলোতে বসেন গাজিপুরের যত হাকিমরা। মেঝের মার্বেল আর নেই, এখন সেখানে সাধারণ সিমেন্টের আস্তরণ। বড় বড় পুরনো ভারী কাঠের দরজাগুলো শুধু এখনও রাজকীয় মহিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে। …আর দাঁড়িয়ে রাজবাড়ির বিশালাকার লোহার সিংদরজা। দরজার সামনে আগে ছিল পোলো খেলার মাঠ, যেখানে এক দিন হাজার মানুষের সামনে হাতির পিঠে জয়দেবপুরের সাধুর ঐতিহাসিক আবির্ভাব ঘটে। সেই মাঠ এখন ফুটবল স্টেডিয়াম।

ছুটির দিনে কোর্ট কাছারি যখন ঝাঁপে ঢাকা, আজও দলে দলে কৌতূহলী মানুষ এসে দর্শন করে রাজবাড়ি। সরকারি অফিসের কর্মচারীরা যত্ন ও ধৈর্য সহকারে তাদের ঘুরিয়ে দেখায়। সেই বিখ্যাত মামলার কাহিনি শোনায়। রানি বিভাবতী আসলে তলে তলে ডাক্তারের সঙ্গে প্রেম করছিলেন— তারা বলে। ওই যে পুকুরটা এখন নোংরা আর কচুরিপানায় ঢাকা, তারই ধারে ছিল ডাক্তারের বাড়ি। প্রতি দিন সকালে, ডাক্তার এসে দাঁড়াতেন বাড়ির ছাদে। আর রানি দাঁড়াতেন রাজবিলাসের ওপরের বারান্দায়। দুজনের মধ্যে চলত সঙ্কেত বিনিময়। সম্পত্তির লোভে একসঙ্গে ফন্দি এঁটে তাঁরা কুমারকে বিষ খাওয়ান। মানুষের কল্পনায় কিন্তু আশ্চর্য ভাবে এ গল্পের বিশাল ভৌগোলিক বিস্তার কমে গেছে, একেবারে তাদের চেনা চৌহদ্দিতে এখন সে গল্পের পটভূমি। অতিথিরা যে গল্প এখন শোনে, সে গল্পের কুমারের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিলাই নদীর পারে যে শ্মশান, সেইখানে— সে জায়গা এখান থেকে — ওই দিকে, মাইল খানেক মতো হবে! সে ছিল এক ঝড়ের রাত, শ্মশানে হঠাৎ কী করে যেন কুমারের দেহ উধাও হয়ে যায়! পরিচিত গল্প, বার বার বলা, বার বার শোনা। কোনও কোনও বয়স্ক অতিথি হয়তো বলে ওঠেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ গল্প তো চেনা চেনা, — একটা যাত্রা হয়েছিল না একবার? না কি যাত্রা নয়, কলকাতার কোনও ফিল্ম?

বুড়িগঙ্গার ধারে ঢাকার নলগোলায় ভাওয়াল জমিদারির বাড়ি থেকে পুরনো কালের নবাবদের প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল বেশি দূর নয়। আহসান মঞ্জিল এখন মিউজিয়ম। আর নলগোলার বাড়ি এখন জবরদখলকারীদের আস্তানা। একদিকের কড়িকাঠ তার ভাঙা, বাকি অংশটা গুদাম, পাঁজা পাঁজা পাটের বস্তার স্তূপ জমিয়ে রাখা। এখানেও একটি মাত্র বৃহদাকার কাঠের দরজা জমিদার বাড়ির অতীত ঐশ্বর্যের শেষ চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আজকের ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। যে অঞ্চলের ওপর এই মহানগরী গড়ে উঠেছে, আগে সেই সব জায়গা ছিল ভাওয়াল জমিদারির অন্তর্গত— বেশি দিন আগের কথা নয়। সোনারগাঁও হোটেল থেকে মগবাজার রোড ধরে উত্তরে ময়মনসিংহ হাইওয়ের দিকে গেলে রাস্তার দু দিকে দেখা যায় নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, বসবাসের নতুন সব অঞ্চল, এ সবই যে জমিতে গড়ে উঠেছে, মাত্র কয়েক দশক আগেই সেই সব এলাকা ছিল ভাওয়ালের রানির তরফে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীন। অর্থাৎ— উন্নয়নের ফল সেখানে আর যে-ই পেয়ে থাকুক, ভাওয়ালের রানিরা অন্তত পাননি।

কলকাতায় ১৯ নম্বর ল্যান্সডাউন রোডও এখন বিশাল বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। সেই পোর্টিকো আর কৃষ্ণচূড়ার বাড়ির আজ আর চিহ্নমাত্র নেই। সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির নাতিনাতনিরা থাকেন পাশেই একটা গলিতে। কিন্তু মহামূল্যবান সম্পত্তির মতো বিভাবতী দেবীর স্মৃতিকে তাঁরা সর্বদা আঁকড়ে আছেন। তিনি প্রায় ওই পরিবারের কুলমাতার সমান। তাঁরা বলেন, সাদা থান পরা, ব্রাহ্মণ বিধবার ছোট করে ছাঁটা চুলেও বিভাবতী দেবী ছিলেন সম্রাজ্ঞীর মতো। তাঁর স্নেহ, যত্ন বা মর্যাদা বোধের কোনও তুলনা মেলা ভার।

উত্তরাধিকার-সূত্রে ব্যানার্জি পরিবার আরও একটা জিনিস লালন করে চলেছে। সেটা হল, ভাওয়াল মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিটির ‘আসল’ পরিচয় কাহিনি। তাঁরা আজও বিশ্বাস করেন যে ওই ব্যক্তি আসলে জয়দেবপুরের আস্তাবলের সহিসের ছেলে। আর তাই গোটা রাজবাড়ির ইতিহাস তার নখদর্পণে। আসল রহস্য তার পিতৃ-পরিচয়ের মধ্যে। আগেকার দিনে সব জমিদার বাড়িতেই যেমন ঘটত, এখানেও তাই, এই ব্যক্তির বাবা স্বয়ং রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ। এর থেকেই বোঝা যায় কেন দ্বিতীয় কুমারের সঙ্গে ওই ব্যক্তির শারীরিক সাদৃশ্য এত বেশি। দার্জিলিং-এ দ্বিতীয় কুমারের মৃত্যু আর তার পর রহস্যময় ব্যক্তিটির আবির্ভাব, দুইটি বিষয়কে একত্র গেঁথে নিটোল গল্প তৈরির এ আর এক নমুনা।

দার্জিলিং-এর ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ বাড়িটি এখনও একটি অতি দর্শনীয় স্থান। ভারি সুন্দর সেই বাড়ি এখন মেটার্নিটি কেয়ারের কেন্দ্র, বাড়ির মালিক স্বয়ং সরকার। বাড়ির সামনে বিরাট একটা ফলকে লেখা, এখানে দেহত্যাগ করেছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। দার্জিলিং শহরে কোথাও আর আজ কেউ ভাওয়ালের দ্বিতীয় কুমারের কথা জানে না।

সুত্রঃ আ প্রিন্সলি ইম্পস্টর:
দ্য কুমার অব ভাওয়াল অ্যাণ্ড দ্য সিক্রেট হিষ্ট্রি অব  ইণ্ডিয়ান ন্যাশনালিজম,
পার্মানেন্ট ব্ল্যাক থেকে সংকলিত।

সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা,  ৫ আশ্বিন ১৪০৯ রবিবার ২২ সেপ্টেম্বর ২০০২