গণতন্ত্রের মূল কথা হলো পরমতসহিষ্ণুতা। আমাদের রাজনীতিতে এই সহিষ্ণুতার সংকট বড়ই প্রকট, যা অনেক সময়ে জাতীয় সংসদেও আছড়ে পড়েছে। যে কারণে বলা হয়ে থাকে, দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বাস্তবে যেটুকু সংকট আছে, তা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সৃষ্টি করা। প্রধান দুটি দল যদি সহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে সংসদে বসে, তাতে সমালোচকেরা অন্তত এ কথাটি বলতে পারবেন না যে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সংকট আছে।

গণতন্ত্রচর্চার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হলো সংসদ। এই সংসদকে কার্যকর করার মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। সে জন্য সরকারির দলের সঙ্গে বিরোধী দলকেও সংসদে উপস্থিত থাকতে হবে। বিরোধী দলের দায়িত্ব হলো সরকারের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরা। আর রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য সরকারের উচিত বিরোধী দলের পরামর্শকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা। সমস্যা হলো, এখানে বিরোধী দলের পরামর্শ গ্রহণ করার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। আর বিরোধী দলও সরকারি দলকে শোধরানোর সুযোগ না দিয়ে এবং কোনো ধরনের গঠনমূলক সমালোচনা না করে সরকারি দলকে আক্রমণ করে। পরস্পরকে হেয় করার প্রবণতা থেকে আমাদের রাজনীতিতে অসহিষ্ণু মনোবৃত্তির প্রকোপ বেড়েছে। সংসদে এ ধরনের রাজনীতিতে দেশ ও মানুষের কথা হারিয়ে যায়। প্রাধান্য পায় ব্যক্তি ও দলের স্বার্থ। এটি গণতন্ত্র অনুমোদন করে না। এ ধরনের নীতি রাজনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং এই ঝুঁকিপূর্ণ রাজনীতি অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

সংসদে সরকারি ও বিরোধী দল যদি সঠিক কাজটি করে, সেটি রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। সরকার যতই সঠিক কাজ করুক না কেন, তাদের কাজে ভুল থাকাটা স্বাভাবিক। বিরোধী দলের কাজ হবে সেটিকে ধরিয়ে দেওয়া। এখন সরকারি ও বিরোধী দলের বিরোধ এতটাই তীব্র যে সরকার ভালো কিছু করলেও বিরোধী দল তার সমালোচনা করে আর বিরোধী দল সুপরামর্শ দিলেও সরকার তা গ্রহণ করে না। বিরোধী দল মনে করে, বর্জনের মধ্য দিয়েই জনসমর্থন বহাল থাকবে এবং ভোট বাড়বে।
স্বৈরতন্ত্রে কতিপয় ব্যক্তি নিজেদের ইচ্ছেমতো দেশ পরিচালনা করেন। এতে জনমতের প্রতিফলন থাকে না। কিন্তু গণতন্ত্রে থাকে জনমতের প্রতিফলন। জনগণ ভোট দিয়ে সাংসদদের সংসদে পাঠায়। সুতরাং মানুষের স্বার্থ এবং তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই দেশের কল্যাণে কাজ করতে হবে। বিরোধী দলের ভালো পরামর্শ সরকারি দল গ্রহণ করবে আর সরকারি দলের ভালো কাজে বিরোধ দলের সমর্থন থাকবে। বিরোধী দল অবশ্যই আক্রমণ করবে। তবে সেটা হবে শৈল্পিক। শৈল্পিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে তাদের সরকারি দলের কাছ থেকে জবাবদিহি আদায় করতে হবে। অর্থাৎ সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের ভূমিকা হবে সংগীতের তাল ও লয়ের মতো। সদস্যরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আসনে বসলে গণতন্ত্র বিপথগামী হবে।

সংসদে একমাত্র মন্ত্রী ছাড়া বাকি সবাই বেসরকারি সদস্য। সুতরাং সরকারি ও বিরোধী দলের সবার উচিত, সরকারের অগণতান্ত্রিক ও জনস্বার্থবিরোধী কাজের সমালোচনা করা। আইন সাংসদদের মূক-বধির করে রাখেনি, আইনের কোথাও বলা নেই যে সংসদে সরকারি দলের সমালোচনা করা যাবে না। বর্তমান সংসদে বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকলেও মন্ত্রীরা কিন্তু রেহাই পাননি। বিভিন্ন সময়ে সরকারি দলের সদস্যরাই তাঁদের প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছেন। সংসদের জন্য এটি কম পাওয়া নয়। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল সংসদে থাকলে মন্ত্রীদের আরও অনেক বেশি করে জবাবদিহির আওতায় আনা যেত।

স্পিকারের বড় দায়িত্ব, কেউ কথা বলতে চাইলে তাঁকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া। সে যে দলেরই হোক। এখানে পক্ষপাতের সুযোগ নেই। কিন্তু বর্তমান সংসদে আমি স্পিকার হিসেবে বিরোধী দলকে যে সুযোগ দিয়েছি, তাঁরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি। তাঁরা সংসদে এসে সরকারকে গালিগালাজ করে চলে গেছেন। এতে তাদের সাংসদেরা তালি দিয়ে বাহবা দিয়েছেন। সংসদের বাইরে তাঁদের কিছু অন্ধ সমর্থক হয়তো বা তালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এতে আমজনতা যে তালি দেয় না, তা আমি হলপ করে বলতে পারি।

বিরোধী দলকে সংসদে আনার জন্য স্পিকার হিসেবে আমি অনেক কৌশলই প্রয়োগ করেছি। কিন্তু কাজে আসেনি। বাস্তবতা হলো, জেগে থাকা মানুষকে কখনো ঘুম থেকে জাগানো যায় না। তাঁরা সংসদে আসেন সদস্যপদ রক্ষার জন্য। আসার পর ওয়াকআউট করার অজুহাত খুঁজতে থাকেন। তখন আমার চেষ্টা থাকে কীভাবে তাঁদের সংসদে রেখে দেওয়া যায়। সে জন্য বিভিন্ন সময়ে তাদের সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়া হয়েছে। এই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এক ঘণ্টা ৫৭ মিনিট বক্তব্য দিয়েছেন। আমি মাইক বন্ধ করিনি। কারণ, আমি জানতাম, মাইক বন্ধ করলে তাঁরা ওয়াকআউট করবেন। যখন স্পিকারের দিক থেকে কোনো অজুহাত পাওয়া না যায়, তখন তাদের সদস্যরা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অশ্লীল ভাষায় বক্তব্য দিতে শুরু করেন। এতে সরকারি দলের সদস্যরাও কেউ কেউ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলেন, কিংবা অসংসদীয় বক্তব্য দিয়ে থাকেন। আর সেই অজুহাতে তাঁরা ওয়াকআউট করে যাচ্ছেন। কেউ নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদ বর্জন করে থাকলে নৈতিকভাবে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত এবং বেতন-ভাতাও নেওয়া উচিত না।

সংসদে স্পিকারের ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার জন্য একসময় সরকার পক্ষ বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগের কথা বলেছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত ছিল না। ধরে নেওয়া যেতে পারে, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ করা হলো। সে অবস্থায় স্পিকার যদি মারা যান, তখন ডেপুটি স্পিকারকে সংসদ চালাতে হবে। আর তখন তিনি যদি সরকারকে সহযোগিতা না করেন, সে ক্ষেত্রে সরকার অচল হয়ে যেতে পারে। তবে সরকারি দলের একজন এবং বিরোধী দলের একজন নিয়ে মোট দুজন ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ করা যেতে পারে। এতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ভারসাম্য থাকবে। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উভয় দলকে মতৈক্যে আসতে হবে। আর এটা করা সম্ভব হলে সংসদ অনেক বেশি কার্যকর হবে।

বর্তমানে যে পদ্ধতির সংসদ, তাতে ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময়ে স্পিকারের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব হয় না। তবে স্পিকারের কর্মকাণ্ডকে নিরপেক্ষ করার জন্য একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। পদ্ধতিটি হবে এমন—স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর পরের নির্বাচনে তাঁর আসনে তিনি ছাড়া অন্য কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। অর্থাৎ পরের নির্বাচনে স্পিকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। তবে পরের দফায় তিনি স্পিকার নির্বাচিত না হলে তার পরের নির্বাচনে ওই আসনটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এতে স্পিকারের ওপর থেকে সরকারি দলের চাপ কমে যাবে। এতে স্পিকারের ভূমিকা অনেকাংশেই নিরপেক্ষ হয়ে উঠবে।

কার্যকর সংসদের অন্যতম একটি শর্ত হলো কার্যকর সংসদীয় কমিটি। কিন্তু আমাদের সংসদীয় রীতিতে মন্ত্রণালয়ের কাছে কমিটির সুপারিশ ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে কারণে কমিটিগুলো আক্ষরিক অর্থে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। সংসদীয় কমিটি মন্ত্রণালয়ের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কাজ করে, মন্ত্রণালয়ের কাজের কঠোর সমালোচনা করে। স্থূল ভাষায় বলতে গেলে মন্ত্রীকে ধোলাই দেয়। কিন্তু সমস্যা হলো আইনত মন্ত্রণালয় কমিটির পরামর্শ আমলে নিতে বাধ্য নয়। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মন্ত্রী পার পেয়ে যেতে পারেন। তবে এটাও ঠিক যে মন্ত্রীর পুরোপুরি পার পাওয়ার সুযোগ সংসদীয় গণতন্ত্রে নেই। কারণ, মন্ত্রণালয়ের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড এবং এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটির আলোচনা-সমালোচনার রেকর্ড সংসদে থেকে যাচ্ছে এবং তা গণমাধ্যমের বদৌলতে দেশের মানুষ জানতে পারছে। সুতরাং কমিটির সুপারিশ আমলে না নিলে সে জন্য মন্ত্রী এবং তাঁর নির্বাহী বিভাগকে যথেষ্ট সমালোচনার চাপ বহন করতে হয়।

বিদ্যমান আইনে সংসদীয় কমিটিকে কার্যকর করার জন্য সরকার আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। যেমন কমিটি যেসব পরামর্শ দেয়, সেগুলো নিয়ে মন্ত্রণালয়ের আলোচনা করা উচিত। এবং গঠনমূলক পরামর্শ অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। এ ছাড়া কমিটির পরামর্শ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সভায় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠকে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সচিবরা যেভাবে বুঝিয়ে থাকেন, মন্ত্রীরা সে অনুযায়ী কাজ করে থাকেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র কেউ কাউকে দেয় না। গণতন্ত্র অর্জন করতে হয়। চর্চার মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের বয়স বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব একটা বেশি নয়। তা সত্ত্বেও আমাদের গণতন্ত্র অনেক বেশি পরিপক্ব। তাই আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় আমি আশাবাদী। আমাদের গণমাধ্যমও এখন অনেক বেশি বিস্তৃত ও স্বাধীন। তাই তাদের গঠনমূলক সমালোচনা এবং সবার সমন্বিত উদ্যোগে সংসদীয় গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছার প্রত্যাশা রইল।

আবদুল হামিদ: স্পিকার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো  (২৩-১১-২০১২) থেকে সংগ্রহীত