দূর্গম ভাটি এলাকা ইটনা, রাজধানী বা প্রধান শহর থেকে ইটনার যাতায়াতের পথ দুটো, একটি ট্রেনে চেপে ঢাকা থেকে ভৈরব, তারপর লঞ্চে আকাবাকা মেঘনার শাখা প্রশাখা ধরে দীর্ঘ নয় ঘন্টার অবিশ্রান্ত মোটর বোটের ক্লান্তিহীন ঘেংগানী আর সুকানীর টুং টাং সিগনাল শুনতে শুনতে ইটনার উপকূল। অথবা বাসে বা ট্রেনে চেপে বড় শহর  কিশোরগঞ্জ তারপর একরামপুর থেকে রিকশাযোগে চামড়ার ঘাট/বালুখলা, তারপর নিজের ইচ্ছা। নৌকা অথবা পদব্রজ। বা ছোট মোটর বোটে ইটনা-সাঝ সন্ধ্যায়। রাজধানীতে যাতায়াতের জন্য সবার কাছে ইটনা-ভৈরব-ঢাকা জনপ্রিয়, কিন্তু রাজধানী মুখী যাত্রীদের সংখ্যা খুব বেশী নয়, বেশীর ভাগই কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ মুখী। সেজন্য “চামড়ার ঘাট” এর ভুমিকা অনেকটা GateWay To Everywhere.

পড়াশুনা/মামলা মোকদ্দমা/আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে/নানাবাড়ীতে সকল কাজের জন্যই আমার দাড় ছিলো চামটারঘাট/বালুখলার ঘাট। বাড়ি থেকে রওয়ানা দেবার পর, চামড়াঘাট অবধি মনে হতো বাড়ির আঙ্গিনাতেই  আছি। আবার শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে, বাড়ির স্বাদ পাওয়া যেতো না চামড়াঘাট অবধি। যেখান থেকেই বাড়ির দিকে রওনা হতাম, হাজারো যান্ত্রীক মাধ্যম এড়িয়ে চামড়াঘাটের মুক্ত শীতল বাতাসে আমার গ্রামের শোদা গন্ধের জন্য উদ্গ্রীব থাকতাম সবসময়। শহরের যান্ত্রিক ধোয়া/কোলাহল ছেড়ে চামড়ার ঘাট যেনো আমায় হাত ছানি দিয়ে ডাকতো, আমার শ্যামল, শীতল নীরব ছায়ার গ্রাম ইটনায়। তাই একরামপুর-চামড়াঘাটের সড়ক ভ্রমনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম প্রান ভরে। মনে হতো ভীষন ভাবে স্বর্গীয় আমার কাছে।

শৈশব কৈশরে কতবার যে চামড়াঘাট/বালুখলা যাতায়াত করেছি ইয়ত্তা নেই, অনেক স্মৃতি বিজরিত। কখনো অভিবাবক এর সাথে, কখনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে, কখনো বা একা। জীবনের দুঃখের সময়, আনন্দের সময় , উল্লাসের সময়- কখনো ভ্রমনকে এ সড়ক ভ্রমনের মতই নিয়েছি। কখনো অভিযাত্রী ভেবেছি নিজেকে দুর্গম অভিযাত্রায়, সময়ে অসময়ে এ সড়কে নিজেকে ভেবেছি অনেকটা অকালতত্ত্বজ্ঞানী।

সাধারনতঃ বাড়ি থেকে বা শহরের আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি থেকে যে দিকেই রওনা দিতাম, যাত্রার আগে ভাগে ভূরিভোজন করতে হতো, মা/আত্মীয় স্বজনদের শংকা ছিল ক্ষুধার্ত হলে পথিমধ্যে আজে বাজে কিছু খেলে ডায়রিয়া/কলেরার আশংকা। লোকজন ঠাট্টা করে বলতো যত ভাল ভাবেই খাওনা কেনো, চামড়ার রাস্তার ঝাকুনিতে পেটের খাবার হজম হয়ে যাবে  আধ ঘন্টায়। আমি আজে বাজে খাবারে অভস্ত্য বরাবরই, ডায়রিয়া/কলেরা পরের ব্যাপার।

এখানে কিশোরগঞ্জের একরামপুর –চামড়াঘাটের  রাস্তার বর্ননা দেয়া অত্যাবশ্যক, একরামপুর থেকে সাড়ে তিন মাইল ঢালু পাকা সড়ক, তারপর নারকেল গাছের শীতল ছায়ায় বাক এড়িয়ে ছোটশহর করিমগঞ্জ। রিকশাওয়ালারা সাধারনতঃ এখানে চালক বদল করে অথবা যাত্রী খোঁজা, বা জল খাবার খায় সস্তা দোকানে। এ সুযোগে যাত্রীরাও সাড়া দেয় প্রকৃ্তির ডাকে, অথবা জলখাবার। করিমগঞ্জ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাক ঘেসে আরম্ভ হয় ইটের রাস্তা, অসম্ভব ঝাকুনি আধ ঘন্টা আগে ভাড়ি কিছু যদি হজম প্রক্রিয়ায় থাকে তবে উর্ধচাপে বমির আকারে বেরিয়ে আসা মোটেও কঠিন নয়।

অবিশ্রান্ত ঝাকুনি কোমর পেটের উপর দীর্ঘ পয়তাল্লিশ মিনিট এর আজাবের  পর ছোট একটি মাঠ ঘেষে একটা মক্তব/পাঠশালার পর শেষ হয় ইটের রাস্তা- হাফ ছেড়ে বাঁচা যায় কোনরকম, তারপর আসে মাটির রাস্তা এবরো থেবরো, খানাখন্দ, তবুও অনেক ভালো সে ইটের রাস্তার চেয়ে, অন্ততঃ সেই কলজে বেড়িয়ে আসা ঝাকুনি নয়। আবারো ছোট একটা বাকের পর রাস্তা উর্দ্ধগামী হয়, গোটা কয়েক মুদি দোকান,  সাইকেল/রিক্সা মেরামতের দোকানের এর পর ছোট একটা ব্রীজ, রিকশা থেকে নেমে চালককে সাহায্য করতে হয় পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ব্রিজে উঠতে, রিক্সা ব্রিজে উঠলে আবার রিক্সায় চাপার পালা, দ্রুত গতিতে ঢালু সড়কে নিচে নামতে থাকে রিক্সা নিজে নিজেই, চালক কে প্রায় অর্দ্ধেক মাইল প্যাডেলে চাপ দিতে হয় না।তারপর মাইল দুয়েক পরে আসে শাকুয়ার ঘাট। মোটামোটি একটা ছোট জনবসতি। খাড়া একটা ছোট বাক পেড়িয়ে আবার আসে এ সড়কের সবচেয়ে বড় ব্রীজ, রিক্সা থেকে নামার পালা, চালককে সাহায্যের হাত আবার ঢালু পেড়িয়ে নীচের দিকে কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে সুপারি বন পেরিয়ে ন্যায়ামত পুর কে বাম দিকে ফেলে রেখে খোলা দিগন্তের মাঝ ধরে চামড়াঘাট মুখী-এখান থেকেই ষ্পর্শ পাওয়া যায় নদীর হিমেল বাতাস, গোটা দশেক ছোট কালভার্ট পেড়িয়ে উপরের দিকে উঠে একটা বাড়ির একদম আঙিনার মাঝদিয়ে নিম্নমুখী হতেই দেখা যায় চামটার ঘাট। আহ! আমার প্রিয় সেই চামড়ার ঘাট! সাথে সাথে ভেসে উঠে আমার গ্রামের বাড়ির আঙিনা, আমার শৈশবের স্মৃতি আরো কত কি।

যখন থেকে এ রাস্তায় যাতায়াত শুরু করেছি, উপলব্ধি করতে শিখেছি অনেক কিছু।নিজেকে ভাবতে শিখেছি সাবলম্বি। বরাবরের মতো অনেক কিছু নিরীক্ষা করেছি খুটিয়ে খুটিয়ে, এ রাস্তায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হতো ঋতু পরিবর্তন এর সাথে সাথে, বসন্তে ছিলো এ রাস্তার এক রুপ, শীতে আরেক, বর্ষায় আরেক। ঋতু পরিবর্তন এবং রাস্তার পরিবর্তনে  আমার দৃষ্টির ও পরিবর্তন হতো অনেক। কিন্তু আমি সবসময় চাইতাম, সকল অবস্থাতেই আমি যেন রাস্তার ধারের সকল চরিত্র গুলোর সুখ দুঃখের অংশীদ্বারিত্বের সমান ভাগ নিতে পারি। কেনো যেন রাস্তার ধারের সচরাচরের মুখ গুলোর অনুপস্থিতি সহজ ভাবে মেনে নিতে পারতাম না।

আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরা এ রাস্তার নিয়মিত যাত্রী ছিলো বলে আমরা মোটামোটি ভাবে রিক্সাওয়ালা থেকে আরম্ভ করে রাস্তার ধারের মুখগুলো, দোকানদার, নৌকারমাঝি পর্যন্ত সবার কাছে পরিচিত এবং জনপ্রিয় ছিলাম,- কারন বোধকরি ওদের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, অথবা ওদের জীবনের হাসি, কষ্টের সামিল হওয়ার  ক্ষমতা। এ রাস্তায় যাতায়াতের সময় নতুন পুরাতন অনেক চরিত্রের সাথেই পরিচয় হতো কিন্তু কিছু কিছু চরিত্র ছিলো স্থায়ী, মনে হতো ওরা খুব কাছের যদিও ছিলো অনেক দূরের।

কিশোরগঞ্জ-চামড়া সড়কের প্বার্শের মহান, মহৎ চরিত্র গুলো আমার স্মৃতিপটে এভাবে ভেসে উঠে, এভাবে জীবন্ত হয়ে উঠে, যেনো-জীবনের অন্তহীন, বিরতিহীন দীর্ঘ সেলুলয়েডের ফিতা।

একরামপুর এর রেলক্রসিং পেরুতেই ঢালু রাস্তা ধরতো রিক্সা, গতি মন্থর হওয়ার পরপরই হাতের ডানদিকে একটা খাড়ির উপরে বাশ দিয়ে বানানো মাচার উপরে বসে থাকতো একটা মেয়ে। পাশকেটে যাওয়া সকল রিক্সার যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে ও এতসুন্দর হাসতো, আজো ভূলতে পারিনা। হাজারো মন খারাপ থাকলে ওর হাসি নিমিষে আমায় ভুলিয়ে দিত সব যাতনা। বয়সের জন্যই হোক আর আমার স্বভাব সুলভ ব্যাক্ত্বিতের জন্যই হোক ওর হাসিতে আমার প্রতিক্রিয়ার কোন বহিপ্রকাশ ঘটাতাম না। কিন্তু ওর হাসিটা আমার চোখে লেগে থাকতো অনেক ক্ষন। জানিনা কজন ওর হাসির মর্ম উদ্ধার করতে পারতো, কিন্তু ওর হাসিটা বোধ করি ছিলো সকাল থেকে সন্ধ্যাবধি বিরতিহীন, হাসির সাথে সাথে ও ডান কিংবা বা হাতটা কোনরকম ভাবে উপরে উঠিয়ে বিদায় সম্বোধন জানাতো, ওর হাতের বিদায় সম্বোধন টা আমার রিক্সার পিছনে লেগে থাকতো অনেকক্ষন। কি যেন বলতে চাইতো ও অষ্পস্ট । মাথায় থাকতো কাপড় কানের দু পাশে গোজা। যদি আধুলি শিকি থাকতো চলন্ত রিক্সা থেকে ছুড়ে দিতাম ওর সামনে বিছানো কাপড়ে।

মা এর সাথে মাঝে মাঝে ভ্রমন সঙ্গী হতাম এ রাস্তায়, একদিন যাচ্ছি, চোখে পড়লো সেই মেয়েটা অনেক দূর থেকে রিতিমত বসা থেকে দাঁড়াবার উপক্রম করে ওর সাধ্যমত দুহাত উপরের দিকে উঠিয়ে অসষ্পট ভাষায়  গলা ফাটিয়ে কি যেন বলতে চাইছে আমাদের রিক্সার দিকে। ততক্ষনে আমদের রিক্সাটা প্রায় ওর কাছাকাছি। মা বললেন “এই রিক্সা থামাও থামাও” রিক্সা থামলো, এই প্রথম বারের মতো  স্থির ভাবে দেখতে পেলাম সেই সুহাসিনীকে, মাকে দেখে গদ্গদ ভাবে একবারে বলতে চাইলো অনেককিছু –মর্ম উদ্ধার করতে পারলাম না। দেখলাম ওর চোখে অনেক আনন্দ, বেদনা, অনুযোগ, অভিযোগ, কিন্তু সেই চিরাচরিত হাসির রেখাটা হাজারো দুঃখের মাঝে ছিলো ম্রিয়মান। মা স্বাভাবিক ভাবে চিরচেনার মতো, যেনো উনি ওর মনের ভাষা সব বুঝে্ন‌ বলে যেতে লাগলেন –“আমি ভালো”, “তুই কেমন আছিস”, “সবকিছু তোর কেমন চলছে”, “সামনের ঈদে তোকে একটা সুন্দর কাপড় কেনে দেব”, ইত্যাদি, ইত্যাদি। মা আমার দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বললেন “ও আমার বড় ছেলে, ওর জন্য দোয়া করিস”। ও আমার দিকে তাকালো, আমিও ভালভাবে তাকালাম ওর দিকে প্রথমবারের মতো। বেশ বুঝতে পারলাম, এ সড়কে যাতায়াতে মা কে ও ভালোভাবেই চেনে, হয়তো মা এর কাছ থেকে আমার মতো খুচরা না পেয়ে টাকা দুএক পায় বরাবর, হয়তো বা মা রিক্সা থামিয়ে ওর সাথে কথা বলেন, মিনিট পাচেক ওর কুশলাদি জিজ্ঞাস করেন, যা হয়তো ওর জন্য অনেক কিছু। বোধকরি টাকা দুয়েক মা গুজে দিলেন ওর হাতে, দেখলাম অনেক কষ্টে হাতের আংগুল গুলো মেলে টাকাগুলো নিলো ও, চোখে মুখে সেই কি বিরাট কৃতজ্ঞতার হাসি, দেখলাম ওর কোমর থেকে পা অবধি পংগু, হাটতে পারে না, হয়তো কেউ বা সকালে ওকে বসিয়ে দেয় মাঁচার উপর, আবার সন্ধ্যায় নিয়ে যায়। আমরা রিক্সায় উঠলাম মা বললেন “ঠিক আছে, আসি তা হলে রে” রিক্সার পিছনের ফাক দিয়ে দেখলাম মুখে সেই হাসি, সেই অদ্ভুত ভাবে হাত নেড়ে বিদায়,   রিক্সা চলতে থাকল, মা  বলতে থাকলেন – ওকে আমি ডাকি “ল্যাংরী” আদর করে, ও মনে কিছু করে না। আমার  মানসপটে আজও দারুন ভাবে ছাপ মেরে গেথে রইলো চামড়া সড়ক পাশের সেই সদাহাসিনী, সুহাসিনী নাম অজানা “ ল্যাংরী”।

* লেখাটি ১৯৯৬-১৯৯৭ সালের কোন এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস শহরের একটি কফি শপে বসে লেখা