বোরো মৌসুমে ধান চাষে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেচ। পর্যাপ্ত সেচ না হলে ধানের উৎপাদন ভালো হয় না। পানির স্বল্পতা, বিদ্যুৎ-বিভ্রাট এসব কারণে অনেক কৃষককেই সেচ নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সেই দুর্ভোগ লাঘবে এগিয়ে এসেছেন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।
গবেষকদের দাবি, তাঁদের উদ্ভাবিত শুকনো বা অ্যারোবিক পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষে প্রচলিত সেচের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পানি কম লাগে। চারটি জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এই শুকনো পদ্ধতিতে বোরো চাষে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন কৃষকেরা। সারা দেশে এই পদ্ধতিতে চাষ হলে বছরে কোটি কোটি টাকার জ্বালানি সাশ্রয় হতে পারে।
গবেষকদের সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান ‘বোরো ধানে শুকনো পদ্ধতির উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) গবেষণা প্রকল্পটির অর্থায়ন করে। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প সম্প্রসারণে আর্থিক সহায়তা করে ডেনমার্কের সংস্থা ডানিডা।
প্রকল্পে গবেষণা সহকার হিসেবে কাজ করছেন মো. হাফিজুর রহমান। প্রকল্পের অধীনে পিএইচডি গবেষক মো. এখলাস উদ্দিন ও মো. মেহেদী মাসুদসহ ১৭ জন এমএস শিক্ষার্থী কাজ করছেন। গবেষণা শুরুর পর এ বছরই প্রথম প্রকল্পের অধীনে দিনাজপুর সদর, রাজশাহীর বিজয়নগর, নেত্রকোনার নারান্দিয়া ও টাঙ্গাইলের নরকোনায় পরীক্ষামূলকভাবে মাঠ পর্যায়ে শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করা হয়।
প্রধান গবেষক মশিউর রহমান বলেন, বোরো ধান চাষে প্রতিবছর ভূগর্ভ থেকে বিপুল পানি তুলতে প্রচুর বিদ্যুৎ বা জ্বালানি লাগে। বিদ্যুৎ-ঘাটতির কারণে সেচ নিয়ে কৃষকদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অথচ কম পানিতে চাষ সম্ভব হলে বিদ্যুৎ-ঘাটতি থাকলেও ধান উৎপাদনে সমস্যা হবে না। এই উপলব্ধি থেকে তিনি সর্বপ্রথম গবেষণা শুরু করেন।
মশিউর রহমান বলেন, অ্যারোবিক পদ্ধতিতে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতির প্রায় দ্বিগুণ পানি সাশ্রয় হয়। তিনি বলেন, শুকনো পদ্ধতিতে ব্রিধান-২৯ জাতের ধান চাষে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিনা ধান-৬, ব্রিধান-৪৭ ও ব্রিধান-২৮ জাতের চাষ করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের জন্য জো অবস্থায় জমি তৈরি করে শুকনা জমিতে প্রাইমিং (নির্দিষ্ট সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখা) করা ধানের বীজ নির্দিষ্ট দূরত্বে রোপণ করা হয়। এ জন্য প্রচলিত পদ্ধতির মতো জমি আলাদাভাবে কাদা করার প্রয়োজন পড়ে না। এ পদ্ধতিতে আলাদাভাবে বীজতলা করারও প্রয়োজন পড়ে না। একই জমিতে বীজ থেকে চারা, চারা থেকে ধান হয়। এ পদ্ধতিতে বীজ রোপণ থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত খুব অল্প পরিমাণ সেচ লাগে। থোড় আসার সময় থেকে বীজ পুষ্ট হওয়ার সময় পর্যন্ত জমিতে সামান্য পানি রাখা ভালো। তিনি বলেন, যেসব জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হয়েছে, সেসব জেলার শত ভাগ কৃষকই নতুন এই শুকনো পদ্ধতিতে চাষের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন।
মাঠ পর্যায়ে সর্বস্তরের কৃষকদের মধ্যে এই পদ্ধতি বিস্তারে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন মশিউর রহমান।
দিনাজপুরের সদর উপজেলার কৃষক নূরুল আমিন ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষক গোলাম খায়ের বলেন, তাঁরা শুকনো পদ্ধতিতে খুবই লাভবান হয়েছেন। এ পদ্ধতিতে পানি ও বিদ্যুতের খরচ খুব কম হয়েছে। বীজতলা করার ঝামেলা না থাকায় শ্রমিক খরচও অনেক কমে গেছে। একরপ্রতি পাঁচ মণ ধান বেশিও পেয়েছেন বলে জানান নূরুল আমিন। একরপ্রতি কমপক্ষে চার হাজার টাকা করে ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে।
গোদাগাড়ী উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এলাকার প্রায় সব কৃষক নতুন উদ্ভাবিত শুকনো চাষাবাদ পদ্ধতিতে ব্যাপক সুফল পেয়েছেন।’
গবেষণা সহকারী মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, ‘আমরা দিনাজপুরে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ সেচ খরচ কমাতে সফল হয়েছি। সারা দেশে এ পদ্ধতির সম্প্রসারণ করলে প্রতিবছর দেশের দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকার ডিজেল ও বিদ্যুতের সাশ্রয় সম্ভব হবে।’

লেখকঃ মো. শরীফুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়