কোনো কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করা তো দূরের কথা, প্রাথমিক শিক্ষালয়ের গণ্ডিতে পা না দিয়েও আঙ্গুরা বেগম (৪২) একজন সফল টেম্পোমিস্ত্রি। নাম না ধরে ডেকে তাড়াইল, নান্দাইল, কিশোরগঞ্জের শতাধিক টেম্পোর চালক এবং হেলপার তাঁকে ইঞ্জিনিয়ার আপা বলে ডাকে। এ ডাক শুনে আঙ্গুরা বেগমের মনেও আনন্দ উঁকি দেয়।
আঙ্গুরা বেগমের জন্ম নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বানিয়াগাতি গ্রামে। ১৯৯৮ সালে একই জেলার পূর্বধলা উপজেলার ভেতরগাঁওয়ের টেম্পোমিস্ত্রি নজরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় আঙ্গুরার। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী মিলে ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় কিল্লার মোড়ে নজরুল ইসলাম একটি টেম্পো ওয়ার্কশপে চাকরি নেন। স্বামীর এ কাজ দেখে তাঁর মনে ইচ্ছে জাগে টেম্পোমিস্ত্রি হওয়ার। স্বামীকে ইচ্ছের কথা জানালে এতে সায় দেন তিনি। ১৯৯১ সালে স্বামীর সঙ্গে ওয়ার্কশপে সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন আঙ্গুরা। পড়ালেখা না থাকায় প্রথমে সমস্যা হলেও স্বামীর মুখ থেকে শুনে গাড়ির যন্ত্রাংশের নাম মুখস্থ করতে থাকেন তিনি। এতে কাজও হয়ে যায় দ্রুত। এভাবে ২০০০ সালের শেষের দিকে তিনি হয়ে ওঠেন একজন দক্ষ মিস্ত্রি। গাড়ির ইঞ্জিন, চেসিস, গিয়ারবক্স, স্টিয়ারিং, টেম্পোর বডি এখন আঙ্গুরা বেগমের নখদর্পণে। চোখ বুজে বলে দিতে পারেন গাড়ির সব যন্ত্রাংশের নাম।
শুধু তা-ই নয়, বিকল হয়ে যাওয়া টেম্পোর শব্দ শুনে তিনি বলে দিতে পারেন কোথায় সমস্যা। এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক টেম্পো নিজহাতে সংযোজন করে দিয়েছেন তিনি। অকেজো কত গাড়ি মেরামত করেছেন তার হিসাব মেলানো ভার। একসময় স্বামীর সাহায্যকারী হিসেবে কাজ শুরু করলেও এখন স্বামী তাঁর কাজে সহযোগিতা করেন। অধিকাংশ কাজ একাই করেন আঙ্গুরা বেগম।
২০০২ সালে আত্মীয়তার পরিচয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে বেড়াতে এসে আঙ্গুরা বেগম ও স্বামী নজরুল ইসলাম দেখেন তাড়াইলে অনেক টেম্পো যাতায়াত করলেও এখানে নেই কোনো ওয়ার্কশপ। স্বামী-স্ত্রী মিলে সিদ্ধান্ত নেন তাড়াইলে একটি ওয়ার্কশপ করার। ওই সময় তাড়াইল সদরসংলগ্ন সুতী নদীর তীরে সহিলাটি গ্রামে আবদুল হাকিম মওলানা মার্কেটে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে নজরুল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ চালু করেন। পরে এটি স্থানান্তর করে তাড়াইল বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব পাশে নিয়ে এসে ভাড়াঘরে চালিয়ে যাচ্ছেন কার্যক্রম। এ কাজের আয় থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলার পাশাপাশি তাড়াইল সদরে এক খণ্ড জমি কিনে টিনের ঘর উঠিয়ে বসবাস করছেন। তিন ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে চারজন স্কুলে লেখাপড়া করছে। বড় ছেলে সুমন পড়ালেখার ফাঁকে টেম্পোর কাজ শিখছে।
রাউতি গ্রামের টেম্পোচালক তাজুল ইসলাম (২৬) বলেন, ‘গাড়ির এমন কোনো কাম নাই যা ইঞ্জিনিয়ার আপা করতে না পারেন।’ একই ধরনের কথা বলেছেন টেম্পোচালক আবদুল হেকিমসহ আরও অনেকে। বানাইল গ্রামের ইকবাল হাসান বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার আপাকে দিয়ে আমি একটি টেম্পো বানিয়েছি অনেক দিন আগে।’ রাউতি গ্রামের মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমার নতুন টেম্পোটি ইঞ্জিনিয়ার আপাই বানিয়ে দিয়েছেন।’ তাড়াইল টেম্পো মালিক সমিতির সভাপতি মো. সেলিম মিয়া বলেন, ‘আঙ্গুরা আপাকে নামের চাইতে ইঞ্জিনিয়ার আপা হিসেবে চিনে সবাই।’
আঙ্গুরা বেগমের স্বামী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার নামে ওয়ার্কশপ হলেও এটির যাবতীয় দায়দায়িত্ব আঙ্গুরা বেগমের। এখন আমাকে তাঁর সহকারী ভাবতে ভালো লাগে আমার। সে টেম্পোমিস্ত্রি হওয়ায় আমি উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি গর্ববোধ করি। আমার নামের ওয়ার্কশপটি এখন অলিখিতভাবে “ইঞ্জিনিয়ার আপার ওয়ার্কশপ” হিসেবে সবাই চেনে।’
কথা হলে আঙ্গুরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামীর কারণেই আজ আমি মিস্তিরি হয়েছি। তিনি আমার ওস্তাদ।’ ‘ইঞ্জিনিয়ার আপা’ বলে আপনাকে ডাকে সবাই—এমন কথার জবাবে মুচকি হেসে বলেন, এ ডাক শুনে আনন্দ লাগে। এত সাফল্যের পরও আপনার কোনো ব্যর্থতা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লেহাপড়া নাই, কালা অক্ষর পড়তে জানি না, এইড্যাই আমার জীবনের চরম ব্যর্থতা।’

আবদুস সাত্তার, তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ)