ক্যান্সার নামের ঘাতকব্যাধি তার শরীরে বাসা বেঁধেছে-প্রথম দেখায় কেউ তা বুঝতে পারবে না। দেশের পপ সঙ্গীতের ‘গুরু’ আজম খান নিত্যদিনের মতোই স্বাভাবিক কাজ করে যাচ্ছেন।

সকাল সাড়ে ১১টায় উত্তর কমলাপুরে শিল্পীর বাসায় গিয়ে দেখা গেল ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুল মতিনকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে হাঁটাহাঁটি করছেন তিনি। হঠাৎ দেখে সবল-স্বাভাবিক মনে হলেও, এক ধরণের বিষন্নতা তার চোখে-মুখে।

আজম খান মুখ গহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত ।

প্রায় আধ ঘন্টা কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি জানালেন, প্রতিদিনের মতো নিয়ম করে মঙ্গলবার সকালেও বাজারে গিয়েছিলেন। কিনেছেন টমেটো, শসা, আলু, মুরগীর মাংস, আরো কত কি।

চিকিৎসার জন্য বুধবার সিঙ্গাপুর যাবেন, সেজন্য লন্ড্রি থেকে জামা-কাপড় পরিস্কার করিয়ে এনেছেন। এরই মধ্যে চিকিৎসার বিষয়ে ছেলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাও সেরে নেন।

চিকিৎসার জন্য তার সঙ্গে যাবেন একমাত্র ছেলে হৃদয় খান। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে তাকে।

এখন তার শরীরের অবস্থা সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মোটামুটি ভালো।”

“পাঁচ-ছয় মাস আগে হঠাৎ খেয়াল করি জিহ্বার নিচে একটি মাংসপিণ্ড জমা হয়েছে। প্রথমে বিষয়টি অত গুরুত্ব দেইনি। পরে ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছেন মুখ গহ্বরে ক্যান্সার হয়েছে।” বলে চলেন আজম খান।

তিনি বলেন, “মাংসপিণ্ডটির কারণে গলায় চুলকায়। কথা বলতেও অসুবিধা হয়।”

গত ২১ জুন ডা. সজল আশফাকের কাছে গেলে তার বায়োপসি করানো হয়। আর এতেই ধরা পড়ে রোগটি। এরপর স্কয়ার হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে এমআরআই করা হলে পিইটি টেস্টের পরামর্শ দেন তিনি।

“এই চিকিৎসা আমাদের দেশে সম্ভব নয়। এ জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হচ্ছে।” বলেন তিনি।

ইতোমধ্যে চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করায় মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই লাখ টাকা দিয়েছেন বলে জানান আজম খানের শুভাকাক্সক্ষী এরশাদুল হক টিংকু।

টিংকু জানান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন।

“সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাই।” এভাবেই লেখাপড়া বঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা জানালেন আজম খান।

দেশ নিয়ে তার ভাবনা, “চাই সুখী-সমৃদ্ধ এবং আধুনিক একটি বাংলাদেশ।”

“আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। কেবল দেশের জন্য কাজ করে যেতে চাই।”

মুক্তিযোদ্ধা আজম খান বলেন, “দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, করবো। মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”

তার গানে তরুণেরা আজো উত্তাল হয়ে ওঠে। ‘গুরু’, ‘গুরু’ ধ্বনিত হয় চারিদিকে। সেই তরুণদের সম্পর্কে তিনি বলেন, “তরুণেরা তাদের মেধাকে দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারলে সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।”

নবীন সঙ্গীত শিল্পীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, “নতুন শিল্পীরা অনেক ভালো কাজ করছে। তাদেরকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারাই হবে সবার জন্য চ্যালেঞ্জ।”

১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্র”য়ারি রাজধানীর আজিমপুরে জন্ম আজম খানের। চার ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।

নরসিংদী জেলার নয়াদিয়া স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকার টিএন্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন গুণী এই শিল্পী।

পরে সনদপত্র হারিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। সেই আক্ষেপ আজো যায় না আজম খানের। তবে গর্ব হয় বাবা সরকারি কর্মকর্তা আফতাব উদ্দিন খানকে নিয়ে।

তিনি বলেন, “বাবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে গোল্ড মেডেল পেয়েছেন।”

তার দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় মেয়ে ইমা খান, ছোট মেয়ে রিমা খান এবং ছেলে হৃদয় খান। এই নিয়ে তার সংসার।

নিজের জীবনযাপন সম্পর্কে তিনি বলেন, “প্রতিদিন সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠি। এরপর হাঁটাহাঁটি করি, নিয়মিত বাজারে যাই, বিশ্রাম নেই। এই তো।”

তবে রোগ ধরা পড়ার পর থেকে খুব একটা বাইরে যান না তিনি।

‘৬৯ এর গণআন্দোলন, ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় গান গেয়েছেন ।

এ পর্যন্ত তার প্রায় ১৭টি গানের একক অ্যালবাম বের হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য মিশ্র অ্যালবামে গান গেয়েছেন তিনি।

‘নীলনয়না’ নামে তার সবশেষ একক অ্যালবাম বের হয় গত রোজার ঈদে।

মূলত ১৯৭২ সালে বিটিভিতে ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না’ এবং ‘চার কালেমা স্বাক্ষী দেবে’ এ গান দুটোর মাধ্যমে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর থেকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

আশির দশকে তার গাওয়া ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা…” দেশ মাতায়।

তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে, “আসি আসি বলে তুমি”, “আমি যারে চাইরে”, “আলাল ও দুলাল”, “বাংলাদেশ” প্রভৃতি।