হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ নূরুল্লাহ (রহঃ), পিতা-মরহুম মাওলানা কাজী মোহাম্মদ শাহনাওয়াজ, মাতা-মরহুমা মোছাঃ ফায়জুন্নেছা ফাতিমা, তিনি “বায়তুন্নুর” ১০২৮ বেগম রোকেয়া সড়ক, শোলাকিয়া, কিশোরগঞ্জ, বাংলাদেশ এই ঠিকানায় বসবাস করতেন, পৈত্রিক নিবাস “কাজী বাড়ী” গ্রাম ও ডাকঘর- পাঁছদরিল্লা, উপজেলা- নান্দাইল, জেলা-ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ। তিনি ১৪ আগস্ট ১৯৩৯ খ্রিঃ রোজ সোমবার কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার দগদগা গ্রামে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন, ২২ নভেম্বর ২০০৬ খ্রিঃ রোজ বুধবার ঢাকা বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৮ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজা ২৩ নভেম্বর’০৬ খ্রিঃ রোজ বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জ ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় লক্ষাধিক মুসুল্লী অংশগ্রহণ করেন। পৈত্রিক নিবাসে তাঁর প্রতিষ্ঠিত নূরে এলাহী জামে মসজিদ সংলগ্ন “জান্নাতুল খুলদ” কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

তিনি ঢাকা মাদ্রাসা-ই-আলীয়া হতে কামিল ফিকাহ, কামিল হাদিস ও কিশোরগঞ্জ আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসা হতে দাওরায়ে তাফছির এবং গুরুদয়াল সরকারী কলেজ কিশোরগঞ্জ হতে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজী, আরবী, ফারসি, উর্দু ভাষায় পারদর্শি ছিলেন।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিদআতকে পরাভূত করতে আমরণ জিহাদ করেছেন। তাঁর সমগ্র জীবনে চিন্তা চেতনায় সার নির্যাস ছিল “ত্বরীকায়ে রাছুলুল্লাহ (সা:) দর্শন”। জামায়াতে আহলে কোরআন ওয়াচ্ছুন্নাহ প্রন্থী ছিলেন। এ বিষয়ে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে ঢাকায় পুরাতন সংসদ ভবনে ওআইসি আয়োজিত সম্মেলনে বক্তৃতা করেন।
হযরত মাওলানা মুফতি সৈয়দ আমিনুল ইহসান এর নিকট থেকে ১৯৬১ খ্রিঃ দ্বীনি ত্বরিকায় বায়াত হন। ১৯৮৮ খ্রিঃ হযরত মাওলানা আবুল আনছার আবদুল কাহার সিদ্দিকী ফুরফুরা হতে খিলাফত প্রাপ্ত হন।

উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া ঈদগাহ এর ইমাম হিসেবে ১৯৭৫ খ্রিঃ হতে ২০০৩ খ্রিঃ পর্যন- দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ খ্রিঃ হতে ১৯৭৭ খ্রিঃ পর্যন্ত ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ খ্রিঃ হতে ২০০৩ খ্রিঃ পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ বড়বাজার শাহাবুদ্দিন জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ খ্রিঃ হতে ২০০৪ খ্রিঃ পর্যন- কিশোরগঞ্জ হয়বতনগর এ.ইউ. আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও এর পূর্ব সময় ১৯৬৩ খ্রিঃ হতে মুহাদ্দিস এর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ১৯৭২ খ্রিঃ হতে ১৯৭৭ খ্রিঃ পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, শুধুমাত্র হাদিস বিষয়ে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দশ সহস্রাধিক।

তিনি ১৯৬১ খ্রিঃ হতে লিখতে শুরু করেন। আরবীতে ৪১টি, উর্দুতে ২৫টি, ইংরেজীতে ১টি, বাংলায় ৬৫টিসহ সর্বমোট ১৩২টি গ্রন’ রচনা করেন। এর মধ্যে ফাজায়েলে মেছওয়াক, কোরবানী ও আক্বীকার ইতিহাস, ওয়াহী উচ্ছিয়াম (রোজার ওয়াহী), ইসলামের দৃষ্টিতে মুছীবাত, চিকিৎসা ও মৃত্যু, আদর্শ বিবাহ (ইসলাম ও যৌবন বিজ্ঞান), ফাযায়েলে নিয়াতি মাকবূল (ইসলামী দর্শন), ফাযায়েলে দোয়া, স্বপ্নে রাছুলুল্লাহ (দঃ) (নবী দর্শন), আছারুন্নাবী (দঃ) (নবীজীর পত্রাবলী), ফাযায়েল ও মাছায়েলে দরুদ ও ছালাম, তাফছিরে নূরে আল্লাহ, ত্বরীকায়ে রাছুলুল্লাহ (দঃ) (শাজারা), শরীয়ত, এলেম, ঈমান, পবিত্রতা, ত্বরীক্বত, হকীক্বত, মারেফত, বায়আত ও যিকরুল্লাহ), কোরআন পাঠের আদব কায়দা এই গ্রন’গুলো প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য গ্রন’গুলো প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।

সৌদি আরবের জেদ্দা ভিত্তিক “ওজারাতুল ইলাম”র আহুত ১৯৭৭ খ্রিঃ ইসলামী ফিকাহ্ বিষয়ে, ১৯৭৮ খ্রিঃ ইসলামী ইতিহাস বিষয়ে, ১৯৭৯ খ্রিঃ ইসলাম ও অন্যান্য বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে সৌদি আরব সরকার কর্তৃক পুরস্কার হিসেবে অর্থ ও সম্মান অর্জন করেন।

১৯৮১ খ্রিঃ হয়বতনগর এ. ইউ.আলীয়া মাদ্রাসায় এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কামিল, ফিতাহ, তাফছির, আদব বিভাগ ও হেফজুল কোরআন, মোজাব্বির-ই-মাহিব ও বিজ্ঞান বিভাগ চালু করেন। ১৯৭৯ খ্রিঃ কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে প্রথমবারের মতো নরুল উলুম আদর্শ মহিলা মাদ্রাসা ও বালিকা এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৫ খ্রিঃ কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে প্রথমবারের মতো এস.ভি.সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মহিলাদের ঈদের জামাত চালু করেন এবং মহিলাদের জুম্মার নামাজ আদায়ের পক্ষে ফতোয়া দেন। তার পৈত্রিক নিবাস ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার ৬নং রাজগাতী ইউনিয়নের পাঁছদরিল্লা গ্রামে “কাজী বাড়ী” সংলগ্ন তাঁদের পারিবারিক সম্পত্তি দান করে ১৯৮০ খ্রিঃ শাহনাওয়াজ ছফিরিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, ১৯৮৬ খ্রিঃ নূরুল উলুম ফাইজুন্নেছা ফারকুন্দা বালিকা মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং ১৯৮০ খ্রিঃ নূরে এলাহী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও কিশোরগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন স’ানে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, খানক্বাহ, দাতব্য চিকিৎসালয়সহ শতাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

কিশোরগঞ্জের নেতৃত্বস্থানীয় আলেম ও ওলামা মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস’ান নিলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস’ান নিয়ে এক অনুকরণীয় ও সাহসী ভূমিকা রেখে ভাস্বর হয়ে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর পৈত্রিক নিবাস “কাজী বাড়ী” পাক হানাদার বাহিনী আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে কিশোরগঞ্জ আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেলে ‘ইসলাম’ প্রসারের কথা চিন্তা করে তিনি মাদ্রাসাটি খোলার উদ্যোগ নেন এবং সফলকাম হয়ে চালু করে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮১ খ্রিঃ তিনি ফরজ হজ্ব আদায় করেন। এ সময়ে জাবালে রাহমাতে আছরের নামাজে ইমামতি করার সৌভাগ্য হয় তাঁর। এছাড়াও তিনি ১৯৯৪ খ্রিঃ বদলী হজ্ব ও ১৯৯৬ খ্রিঃ রমজানুল মোবারকে বরকতের জন্য হারামাইনে ওমরা, রোজা, তারাবী, তাহাজ্জুদ, এতেকাফ ও আল্লাহর ধ্যানে সময় অতিবাহিত করেন। উল্লেখ্য, সৌদি আরব সফরের সময়ে সৌদি রেডিওতে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়।

হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ নূরুল্লাহ (রহঃ) এর জীবন ও কর্ম নিয়ে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে।