মাছ আর ধান হাওরের প্রাণ’ কথাটি হাওরাঞ্চলের মানুষ একসময় গর্ব করে বলত। প্রায় প্রবাদসম এ কথার সঙ্গে এখন আর বাস্তবতার মিল নেই। হাওরে দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছ উল্লেখযোগ্য হারে পাওয়া যায় না বললেই চলে। মৎস্য অধিদপ্তর ও হাওরাঞ্চলে কর্মরত উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সিলেটের হাওরগুলোতে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। তবে গত প্রায় এক দশকে এসব মাছের মধ্যে প্রায় ৬২ প্রজাতি অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।

বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সিলেটের চার জেলায় চার লাখ ৭০ হাজার ৫৫৬ হেক্টর হাওর-বিল-জলাশয়, এক হাজার ৯৮৯টি বিল এবং এক লাখ ১৬ হাজার ৪২৯টি পুকুর রয়েছে। এসব উৎস থেকে প্রতিবছর এক লাখ ২৩ হাজার ৮৩৫ দশমিক ৩৬ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয়। এক দশক আগে মৎস্য আহরণের পরিমাণ আরও বেশি ছিল বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি এখনই ঠেকাতে না পারলে ভবিষ্যতে হাওরাঞ্চলে কোনো মাছেরই সন্ধান মিলবে না।

সোনালি অতীত: হাওরাঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তিদের ভাষ্য হচ্ছে, ‘মাছের খনি’খ্যাত সিলেটের হাওরগুলোতে ১০ বছর আগে যেসব দেশি প্রজাতির সুস্বাদু মাছ সচরাচর দেখা যেত, এখন তা আর পাওয়া যায় না। নব্বইয়ের দশকে হাওর এলাকায় অসংখ্য দেশি মাছ পাওয়া যেত উল্লেখ করে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বাঘতলা গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব নকুল চৌধুরী বলেন, ‘কিছুদিন আগেও হাওরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে দেশি মাছ মিলত। অথচ এখন মাছের আকাল চলছে। ১০ বছর আগে আমরা যেসব মাছ খেয়েছি, এখন এসব মাছের অধিকাংশই চোখে পড়ে না।’

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরপারের প্রবীণ ব্যক্তি আক্তার মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হাতেগোনা কয়েকটি মাছ ছাড়া হাওরের মাছগুলো দেখেনি। অথচ কিছুদিন আগেও কত কত সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেত।’ হাওরাঞ্চলের মানুষজন জানান, মৌলভীবাজার জেলার হাইল হাওর, হাকালুকি, কাওয়াদীঘি হাওর এবং সুনামগঞ্জের দেখার হাওর, করচা, মাটিয়ান ও শনির হাওরে মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমছে।

বিলুপ্তির পথে ৬২ প্রজাতি: হাওরাঞ্চলের ৬২ প্রজাতির মাছ এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। মৎস্য বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং হাওরাঞ্চলের মানুষজনের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যানুযায়ী অতি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে ১৫ প্রজাতির মাছ। এগুলো হচ্ছে বাঘাড়, পিপলা, তিলা শোল, ঘাউড়া, বাচা, বাটা, নান্দিনা, ঘোড়া মুইখ্যা, পাঙাশ, সরপুঁটি, রিটা, শিশর, মহাশোল, একথুটি ও বামোশ।

বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় রয়েছে ৩০ প্রজাতির মাছ। এগুলো হচ্ছে নাপিত কই/বান্দি, জইয়া, ভোল, কখশা, টেংরা, সেফাটিয়া, রানি, চাকা, গজার, কাশ খাউড়া, কালাবাটা, একঠোঁটা, বাগানবাটা, কালিয়া, ঘইন্যা, শাল বাইম, কুমিরের খিল, গুইজ্জা, চিতল, কানি পাবদা, মধু পাবদা, পাবদা, নেফতানি, ডানকুনি, ঢেলা, বিষতারা, শিলং, গুজি আইড়, ছেপ চেলা ও রায়েক।

হুমকির মুখে রয়েছে অন্তত ১৫ প্রজাতির মাছ। এগুলো হচ্ছে বাঁশপাতা, বাও বাইম, বড় বাইম, নামা চান্দা, লাল চান্দা, চেঙ্গ, টাটকিনি, তারা বাইম, কুঁচিয়া, আইড়, গুলশা টেংরা, ভেদা, ফলি, গাঙ্গ মাগুর ও তিতপুঁটি। তবে আশার কথা হচ্ছে, হাওরাঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় পিপলা/পিলা শোল, ঘোড়া মাছ, একঠোঁটে মাছ পাওয়া না গেলেও সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলোতে এসব মাছ এখনো মিলছে।

বিলুপ্তির কারণ: হাওরবাসী ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরের দেশীয় মাছ বিলুপ্তির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নয়টি কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে—জনসংখ্যার আধিক্য, জলাশয় ভরাট হয়ে মাছের বিচরণক্ষেত্র কমে যাওয়া, নদীতে বাঁধ, মাছের প্রজননের জন্য নির্দিষ্ট জায়গার অভাব, কারেন্ট জালের ব্যবহার, ডিমঅলা মাছ শিকার, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষি বর্জ্য হাওরে মিশে যাওয়া, হাওর ও নদীগুলোর নাব্য হারানো এবং পানির গতির দিক পরিবর্তনের কারণে মাছগুলো বসবাসের জায়গা হারানো। এগুলোর পাশাপাশি হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়ার কারণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে।

সুনির্দিষ্ট কারণগুলোর পাশাপাশি মৎস্য আইন না মেনে মৌসুমের নির্ধারিত সময়ের আগে মাছ শিকারের কারণেও দিন দিন হাওরাঞ্চলের মাছ কমে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, পুকুর, ডোবা ও জলাশয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকটা হুমকির মধ্যে পড়েছে নানা প্রজাতির দেশি মাছ। সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা তুষারকান্তি বর্মণ জানান, জলাশয় ভরাট, সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত মাছের পোনা নিধন ও কোনা জাল ব্যবহারের কারণে দিন দিন দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

অসহায় জেলেসম্প্রদায়: সিলেটের হাওরাঞ্চলে লক্ষাধিক পেশাজীবী জেলের বসবাস। তাঁরা জানিয়েছেন, বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জ জেলার আড়াই শতাধিক গ্রামের কয়েক লক্ষাধিক মানুষ মাছ ধরা এবং বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তবে কয়েক দশক ধরে হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির দিকে চলে যাওয়ায় জেলেসম্প্রদায়ের অনেকেই পুরোনো পেশা ছেড়ে নানা ধরনের পেশায় মনোনিবেশ করছেন।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চানপুর গ্রামের জেলে রবীন্দ্র বর্মণ (৪৫) বলেন, ‘কয়েকটা পুঁটি আর মলা মাছ ছাড়া কুনতা (কিছু) মিলে না। মাছ ধরা না পড়লে আমাদের সংসার কীভাবে চলবে? ভাবতাছি, বাপ-দাদার পেশা ছাইড়া আরেক পেশায় চইলা যাইমুগি।’ শাল্লা উপজেলার ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ী শ্যামসুন্দর দাস (৫১) বলেন, ‘মাছ মাইরা এখন আর জীবন চলে না। হারা দিন জাল বাইয়া নিজেরা খাওয়ার লাগি মাছ-ই পাই না। তাইলে বেচমু কেমনে?’

বিশেষজ্ঞরা কী বলেন: মৎস্য গবেষকেরা হাওরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কমে যাওয়ার জন্য কৃষিজমিতে সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারকে দায়ী করেছেন। তাঁদের মতে, হাওরের নদীনালা ও বিলগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ায় এবং হাওরাঞ্চলগুলোতে নির্বিচারে মাছ ধরার কারণে বিভিন্ন মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, হাওরে প্রচুর পরিমাণে মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরি করা উচিত। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব ইকবাল গুরুত্বপূর্ণ হাওরগুলোকে প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য বানানো উচিত বলে মতামত দেন। তিনি বলেন, হাওরের মাছ সংরক্ষণ এবং এসব মাছের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি মাছের বৈচিত্র্য রক্ষা ও বংশ বৃদ্ধিরও সুযোগ তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া প্রজননের সময় প্রজননক্ষম মাছ না ধরার জন্যও সচেতনতামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা শাখার সহকারী পরিচালক সৈয়দ আজাহার  বলেন, ২০০০ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাওরাঞ্চলের ৫৪ প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে রয়েছে। তবে বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতির সংখ্যা আরও বেড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত থেকে পাহাড়ি ঢলে প্রচুর পরিমাণে বালু এসে জলাশয় ভরাটের কারণে মাছের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হওয়া এবং মশারি, কারেন্ট ও ভিম জাল ব্যবহার অন্যতম কারণ। এসব জাল ব্যবহারের কারণে মাছের ডিম ধারণক্ষমতা হ্রাস, ডিম ফোটার পরই রেণু পোনা নষ্ট কিংবা রেণু পোনা মাছ মারা যাচ্ছে।

হাওরাঞ্চলের মাছ রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বিল পুনঃখনন করা হচ্ছে। তাছাড়া ‘হাওর প্রকল্প’, ‘হাওর কর্মসূচি’ এবং ‘রাজস্ব কার্যক্রম’—এই তিনটি প্রকল্পের অধীনে বিল নার্সারি এবং পোনা অবমুক্তকরণ নিয়মিতভাবে করা হচ্ছে। চলতি বছরে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতি রক্ষায় আরও কিছু প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।

– সুমনকুমার দাশ, সিলেট