গণ্ডগ্রামটির অধিকাংশ মানুষই জুতার কারিগর! পড়াশোনার চল এখানে নেই বললেই চলে। প্রাথমিকের পাট চুকিয়ে মাধ্যমিকে গেছে এমন লোক এখানে খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে বয়সে শিশুদের হাতেখড়ি ওঠে, সে বয়সি শিশুদের জুতার কারিগর বানাতে হাতে তুলে দেওয়া হয় ভোমর (জুতা সেলাইয়ের সুঁইবিশেষ)। কান্দিগ্রামের মানুষগুলো তাই দারিদ্র্য ও অশিক্ষার নিগড়ে বাঁধা পড়েছিল। এটি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়নের পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম।গ্রামের মানুষকে আলোর পথ দেখাতে এগিয়ে আসেন এক তরুণ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝালেন।

শিশুদের নিয়ে এলেন খোলা আকাশের নিচে, গাছতলায়। ব্ল্যাক বোর্ডে অ, আ, ক, খ, লিখে শেখানো শুরু করলেন। ২৫ জন শিশু নিয়ে গাছতলার সেই পাঠশালার যাত্রা শুরু বছর ছয় আগে। আজ সেই পাঠশালায় ছাত্রছাত্রী ১০৮ জন। রোজ দুই ঘণ্টা করে শিশুদের পড়ান সেই তরুণ। শুধু পড়িয়েই ক্ষান্ত হননি। শিশুদের পাঠশালামুখী করতে তাদের হাতে তুলে দেন চকলেট। সবই করেন নিজ খরচায়। নাম তাঁর হূদয়, পুরো নাম মোবারক হোসেন (২৩)। শিশুদের তো বটেই, গ্রামবাসীর হূদয়েও আলাদা ঠাঁই করে নিয়েছেন কান্দিগ্রামের হূদয়।

সাত ভাইবোনের মধ্যে হূদয় চতুর্থ। বড় ভাইদের মতো তাঁকেও জুতার কারিগর বানাতে চেয়েছিলেন মা-বাবা। তা না হয়ে নিজ চেষ্টায় পড়াশোনা করেন। আর্থিক অনটনে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি হূদয়ের। মনে গোপন একটা দুঃখ রয়ে যায়। সেই দুঃখবোধ থেকেই পাঠশালার জন্ম।কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে কুলিয়ারচরের ছয়সূতি বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব সাত কিলোমিটার। ছয়সূতি থেকে ডুমুরকান্দা বাজার সড়ক ধরে সামনে এগোলেই হূদয়ের পাঠশালার দেখা মিলবে। নিজ বাড়ির পাশে গাছতলায় শিশুদের পড়ানোয় মগ্ন দেখা গেল হূদয়কে। তিনি বলছেন, ‘অ-তে অজগর, আ-তে আম, ক-তে কলা, খ-তে খেলা।’ শিশুরাও সুর করে শিক্ষকের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে।

হূদয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কান্দিগ্রাম ও এর লাগোয়া শ্যামাকান্দি, মাইজপাড়া গ্রামের ছেলেমেয়েরাও তাঁর এখানে পড়তে আসে। এখান থেকে অক্ষরজ্ঞান লাভের পর অভিভাবকেরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করান। প্রাথমিক বিদ্যালয় এখান থেকে দুই-আড়াই কিলোমিটার দূরের পথ। শিশুদের ভর্তি করানোর কাজটি তিনি নিজেও করেন। সরকারি ছুটি ও অসুস্থতা ছাড়া সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঠদান চলে এখানে। শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে পাঠশালা। পাঠদান চলে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত। রোজ কম করে হলেও ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী পাঠশালায় আসে।

প্রতিদিন নাম ডাকা, কয়েক মাস অন্তর পরীক্ষা নেওয়া—সবই হয় এখানে। বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা নেন না হূদয়। উল্টো প্রতি বৃহস্পতিবার শিশুদের মধ্যে চকলেট দেন। এসব করতে গিয়ে প্রতি মাসে তাঁর পকেট থেকে সাত-আট শ টাকা বেরিয়ে যায়। ওই টাকা তিনি গৃহশিক্ষকতার কাজ করে জোগান।তরুণ এই শিক্ষকটি শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। সাড়ে চার বছর বয়সী শিক্ষার্থী পান্না বলে, ‘হূদয় স্যার ভালা। চকলেট দেয়। আদর করে। ’ আবেদ ও কেয়া বলে, ‘মেঘ আইলে ভিজে যাই। তখন স্যার স্কুল ছুটি দিয়া দেয়।’

হূদয়ের মা নাহুদা খাতুন বলেন, ‘শুরুতে পাগলামি মনে অইছে। এখন গ্রামের লোকজন ভালোই তো কয়।’স্থানীয় ছয়সূতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলে এলাহী বলেন, ‘কিছু দিন আগে হূদয়কে নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের এক সভায় আলোচনা হয়েছে। ইউএনওর পরামর্শে পাঠশালাটি দেখতে গিয়েছিলাম। সব দেখে ভালো লাগল। তার এই কাজে সমাজের লোকজনের এগিয়ে আসা জরুরি।’গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আবদুল হাসিম বলেন, ‘অশিক্ষিত মানুষ হইল পচা হামুকের (শামুক) মতো। পচা হামুক যেমন আশও (হাঁস) খায় না, তেমনি অশিক্ষিত মানুষ রে কেউ দাম দিতে চায় না। আমরার হূদয় গেরামের পোলাপাইন রে বিদ্যা শিখাইয়াতেছে।’

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘হূদয়ের পাঠশালাটি সম্পর্কে শুনেছি, তবে দেখা হয়নি।’মানুষের হূদয়ে থাকা হূদয়ের কষ্ট অবশ্য অন্য জায়গায়। প্রকৃতির কাছে হার মানতে হয় তাঁকে। কারণ, তাঁর পাঠশালাটি যে গাছতলায়। বৃষ্টিকে আটকানোর সাধ্য যে তাঁর নেই

-Prothom Alo