মনিরউদ্দীন ইউসুফ ১৯১৯ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি তাঁর নানার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল থানার জাওয়ার নামক গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন ।তাঁর নানা ছিলেন জাওয়ারের জমিদার আবদুল হাকিম খান চৌধুরী ।কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফের পৈত্তৃক বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের সদর থানার অন্তর্গত বৌ্লাই গ্রামে ।বৌ্লাইয়ে তাঁর পরিবার এক প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবার হিসেবে পরিচিত ।জানা যায় কবি ইউসুফের পূর্ব পুরুষগন বাগদাদ থেকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে দিল্লিতে আসেন এবং সেখানকার দরবারে ‘আমীর’ হিসেবে যোগদান করেন ।

পরবর্তীতে তাঁর এক পৌ্ত্রকে সুবা-বাংলার কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে অবস্হান করার নির্দেশ দান করা হয় ।তাঁর নাম ছিল শেখ করিম খান যিনি করিম খান আমীরুল বহর নামে পরিচিত ।অর্থাৎ ওই এলাকার নৌ বাহিনীর কর্তৃত্বভার তাঁকে দেয়া হয় ।আরো জানা যায়, সম্রাট আকবরের সাথে ঈসা খাঁর যে সন্ধি-চুক্তি হয়,তাঁরই ধারাবাহিকতায় করিম খাঁর এই নিযুক্তি ।মনিরউদ্দীন ইউসুফের পিতা মিজবাহ উদ্দীন আহমদ এবং মাতা সানজিদা খাতুন ।মনিরউদ্দীন ইউসুফের শিক্ষাজীবন শুরু হয় তাঁর নানার বাড়ি জাওয়ারের প্রাথমিক স্কুলে ।এরপর তাঁর যখন এগারো বছর বয়স তখন মনিরউদ্দিন চলে আসেন আধা শহর-আধা গ্রাম কিশোরগঞ্জে। সেখানে দু’বছর পড়ার পর চলে যান ময়মনসিংহ শহরের জেলা স্কুলে ।

সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন ।এরপর ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই.এ.পাশ করেন ।পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স ক্লাসে ভর্তি হন।অনার্সের শেষ বৎসর অর্থাৎ তৃতীয় বৎসর পড়াশুনা আশানুরুপ  না হওয়ায় হটাৎ সিদ্ধন্ত নেন এ বৎসর পরীক্ষা না দিয়ে পরের বছর পরীক্ষা দিবেন ।তাই চলে যান দেশের বাড়িতে ।সেখানে কিছু দিন থেকে চলে যান কলিকাতা হয়ে বোম্বাই ।এ বিষয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাকে রাজী করানো হয়েছিল ।তিনি জানতেন এ বিষয়ে আম্মায় হতে পারেন তাঁর সাহায্যকারী ।বহু বৎসর আগে এই আম্মাকে এবং নানাকে ধরেই তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে রেহাই পেয়েছিলেন ।এরপর তিনি দিল্লি,আগ্রা থেকে কয়েক মাস পর পিতার অসুস্হ্তার খবর শুনে দেশে ফিরে আসেন ।তাঁর ফিরে আসার পর কিছু দিনের মধ্যেই পিতার ইন্তেকাল হয় ।স্বাভাবিক ভাবে পিতা-মাতার প্রথম সন্তান হিসেবে তাঁর উপর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে ।প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় আর ফিরে যাওয়া হলোনা ।ভাই বোনদের বিয়ে দেয়া হলো নিজে বিয়ে করলেন ।

শুরু হলো সংসার জীবন ।কর্মজীবনের প্রথম দিকে তিনি সাংবাদিকতায় যোগ দেন ।প্রথম দিকে Pakistan Observer এবং পরবর্তীতে দৈনিক সংবাদে কিছুদিন কাজ করেন ।এর অনেক পর সাংবাদিক বন্ধু এবং ছেলেবেলার সাথী সৈয়দ নুরুদ্দিনের আমন্ত্রনে তিনি কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে যোগদান করেন।তিনি কর্পোরেশনের জনসংযোগ বিভাগে মাসিক ‘কৃষি সমাচার’নামক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন ।তিনি ছিলেন এই প্রত্রিকাটির প্রতিষ্ঠানিক সম্পাদক ।১৯৭৯ সালে চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার সময় তিনি এই দায়িত্বেই কর্তব্যরত ছিলেন।কিশোরগঞ্জের কৃতী সন্তান মনির উদ্দিন ইউসুফ তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন ।তিনি একাধারে বাংলা,ইংরেজী,উর্দূ,ফারসী ও আরবী ভাষা জানতেন ।

ইরানের মহাকবি ফেরদৌসী রচিত মহাকাব্য ‘শাহনামা’ সম্পূর্ন বাংলায় অনুবাদ করে তিনি এই উপমহাদেশের সুপরিচিত হয়ে উঠেন ।তাঁর একাজের স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘মরনোত্বর একুশে পদকে’ ভূষিত করে ।‘শাহনামা’ ছাড়াও অন্য যে সব গ্রন্হ তিনি বিদেশি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন তাঁর মধ্যে ‘রুমীর মসনবী’ ‘ইকবালের কাব্য সঞ্চয়্ন’ ‘দীওয়ান-ই-গালিব’ উল্লেখযোগ্য ।তাঁর মৌ্লিক কাজের সংখ্যাও কম নয় ।তিনি বেশ কয়েকটা প্রবন্ধের বই লিখেছেন যাদের বেশির ভাগই ইসলাম এবং ইসলামের ইতিহাস সংক্রান্ত ।এসব বই পড়লে তাঁকে ইসলামী দার্শনিকও বলা যেতে পারে ।‘আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’ ‘কারবালা একটি সামাজিক ঘূর্নাবর্ত’ ‘সংস্কৃতি চর্চা’ ‘বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব’ ‘নবমূ্ল্যায়নে রবীন্দ্রনাথ’ ‘বাংলা সাহিত্যে সূ্ফি প্রভাব’ উল্লেখযোগ্য ।তাঁর আরেকটি গবেষনাধর্মী কাজ হলো ‘উর্দূ সাহিত্যের ইতিহাস’ ।

এছাড়া ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘ছোটদের ইসলাম পরিচয়’ ‘ছোটদের রসুল চরিত্র’ ‘মহাকবি ফেরদৌসী’ ‘চল যাই ছড়ার দেশে’ ইত্যাদি ।এছাড়া তিনি ‘হযরত আয়েশা’ এবং ‘হযরত ফাতেমা’ নামে দুটো জীবনী গ্রন্হও রচনা করেন ।

মনিরউদ্দীন ইউসুফের মৌ্লিক কবিতার মধ্যে ‘এক ঝাঁক পায়রা’ ‘বেতস পাতা জলের ধারা’ ‘রাত্রি নয় কলাপি ময়ূর নয়’ ‘মনিরউদ্দীন ইউসুফের অগ্রন্হিও কবিতা’ উল্লেখযোগ্য ।ছাত্র জীবনে তাঁর একটি কবিতার বই বের হয়েছিল যার নাম ‘উপায়ন’ ।তাঁর এই কবিতাগুলোর মধ্যে একটি বই বাংলা গজলে পূর্ন ।জাতীয় কবি নজরুলের পর গজলে এমন কাজ বাংলায় আর হয়নি ।কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ উপন্যাস এবং নাটকও লিখেছেন ।উপন্যাস গুলোর নাম ‘ঝড়ের সাথে শেষে’ ‘পনসের কাঁটা’ এবং ‘ওর বয়স যখন এগারো’ ।তাঁর শেষ দুটো উপন্যাসের  পটভূমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ এবং সাধীনতা পরবর্তী ঘটনা  চিত্র ।

 

মনিরউদ্দীন ইউসুফ একুশে পদক ছাড়াও আরো যে সব পুরস্কার পেয়েছেন সেগুলো হলো গভর্নর স্বর্নপদক (১৯৬৮),হাবিব ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮),বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৮) এবং আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫) ।

 

তিনি অনুবাদ এবং মৌ্লিক লেখার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধতর করেছেন ।কবি ইউসুফ ১৯৮৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ৬৮ বৎসর বয়সে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তিনি কিশোরগঞ্জের একজন কৃতি সন্তান ।