কিছুদিন আগে বিবিসি-র এক জরিপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপে। আমি ও সমমনা অনেক ক’জন অনেক কাল ধরেই তাঁকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে অভিহিত করে আসছি। আমরা তখন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখের কথা ভুলে যাইনি। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে যে-মানুষটি দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক কার্যক্রম, ত্যাগ, আন্দোলন এবং চূড়ান্ত পর্বে মুক্তিসংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দিয়ে একটা বিশাল জনগোষ্ঠির জন্য একটা মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ এনে দিতে পারেন, সর্বশ্রেষ্ঠের শিরোপা তাঁরই প্রাপ্য। বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্রষ্টা হবার কৃতিত্বের পাশে অন্য যে-কোন মহৎ মানুষের মহান কীর্তি ম্লান হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু একাজটিই করেছেন এবং এর মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন জাতির জনক, গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।আমরা জানি যে-কোন একক ব্যক্তি তার একার চেষ্টার পরাধীনতা বা ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে একটা নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেন না। বহু সময় জুড়ে সেই সংগ্রাম চলে, বহু মানুষ সেই সংগ্রামে অংশ নেয়, বহু লোক তাতে আত্মাহুতি দেয়। তবু একথাও আমরা জানি যে, যে ইতিহাসের কোনো কোনো পর্বে কোথাও কোথাও একক ব্যক্তি এত বড় ভূমিকা পালন করেন, তাঁর অবদান এত কেন্দ্রীয় ও চূড়ান্ত হয়ে ওঠে এবং তাঁর কর্মকান্ড এত ফলপ্রসূ হয় যে মানুষ স্বত:প্রণোদিত হযে তাঁর মাথায় জাতির পিতার শিরোপা পরিয়ে দেয়।

যে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল তার অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর আমরা একটা মেকি স্বাধীনতা পেয়েছিলাম বটে, কিন্তু দ্রুত মোহভঙ্গের পর ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত বাঙালির সংগ্রামী তৎপরায় শেখ মুজিবের ভূমিকা ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর রূপ ধারণ করে শেষ পর্যন্ত সর্বপ্লাী হয়ে স্বৈরাচারী পাকিস্তানের এই অঞ্চলের ভিতকে সম্পূর্ণ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্র।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের কতিপয় উচ্চ বিন্দুকে আমি এইভাবে চিহ্নিত করি। ছয়দফা আন্দোলনের যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে, যে-আন্দোলনকে বলা হয় বাঙালির ম্যাগনা কার্টা, তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সংহত করতে বিশেষ সাহায্য করেন। তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা তিনি ঊনসত্তর ও গড়ে তোলেন এবং আমাদের চিত্তে স্বাধীনতার আকাঙ্খা ও স্বাধীনতা অর্জনের সংকল্পকে তুঙ্গে নিয়ে যান, বজ্রকঠোর করে তোলেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত, পাকিস্তানি অবরোধকারী জল্লাদ বাহিনী কর্তৃক গণহত্যাযজ্ঞ শুরু হবার পূর্ব নাগাদ, বঙ্গবন্ধু ছিলেন এদেশের মানুষের মুকুটবিহীন সম্রাট। সমগ্র জাতির ম্যান্ডেট পাওয়া, সর্বক্ষমতাপ্রাপ্ত, একক প্রতিনিধি শেখ মুজিবের প্রতিটি নির্দেশ তখন সকল বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। প্রতিবাদী কোটি কোটি মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল, হাতে ছিল লাঠি, কোদাল, লাঙল, বেলচা, মুখে ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান, কিন্তু একটি মানুষও উচ্ছুঙ্খল হয়নি। বিশ্ব-ইতিহাসে এরকম ঘটনার নজির খুব বেশি নেই। ২৮ মার্চ তারিখে লন্ডনের ‘দি অবজার্ভর’ পত্রিকায় তখনকার বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সাংবাদিক সিরিল ডান লিখেছিলেন:

“Althrough it has taken Sheikh Mujibur Rahman more than twenty years to bring his life to its present stunning climax, the liberation of his homeland East Pakistan from its status as a colony o West Pakistan has always been his aim. Whatever may be said against him he is not a political opportunist.”

এসব প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে পড়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার যে অতুলনীয় আহ্বান জানিয়েছিলেন তার কথা। যার যা আছে তাই নিয়ে তিনি দেশের সব মানুষকে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন। তাঁর ওই ভাষণের মধ্যে ছিল সাহস, প্রজ্ঞা, দূরদুষ্টি ও দেশবাসীর প্রতি গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতিতে মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হবার দিক নির্দেশনা। বঙ্গব্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে সর্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবিচল আস্থার কারণে সরারদেশের মানুষ তাঁর প্রতিটি নির্দেশ আক্ষরিকভাবে পালন করেছে, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়েছে, ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, গ্রামে-গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, যুদ্ধাহতদের সেবাশুশ্রুষা করেছে, গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য খবর সংগ্রহ করেছে, তাদেরকে শত্রুর ঘাঁটির সন্ধান দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ভূমিকা প্রসঙ্গে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ তারিখে তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টিও উল্লেখ করতে হয়। ২৫ মার্চ বিকালের দিকেই তিনি জানতে পারেন যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এবং পাকবাহিনী আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার নির্দেশ দেন, কিন্তু নিজে তাঁর বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে পালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখক রবার্ট পেইন তাঁর ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে লিখেছেন: “মাঝরাত নাগাদ তিনি (বঙ্গবন্ধু) বুঝতে পারলেন যে ঘটনা প্রবাহ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, আর দূর থেকে চিতকারের আওয়াজ ভেসে আসছে। তখনও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ সম্পর্কে কিছু জানতেন না। কিন্তু তিনি জানতেন যে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর ব্যারাকগুলি ও রাজারবাগ পুলিশদপ্তর আক্রান্ত হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর ঘাঁটিগুলি নিশ্চিহ্ন করে দিতে বদ্ধপরিকর। তাই সে-রাতেই, ২৬ মার্চে, তিনি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। সর্বত্র বেতার যোগে পাঠাবার জন্য তিনি নিম্নোক্ত বাণীটি সেন্ট্রাল টেলিফোন অফিসে জনৈক বন্ধুকে ডিক্টেশন দেন।”

রবা্র্ট পেইন লিখেছেন, বাণীটি ছিল নিম্নরূপ: “পাকিস্তান সামরিক বাহিনী মাঝরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। প্রতিরোধ করবার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য শক্তি সঞ্চয় করুন।”

বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ওই ঔয়্যারলেসের মাধ্যমে তাঁর সহকর্মীদের কাছে পৌছেঁ যায়। এ প্রসঙ্গে জেনারেল ওসমানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার সালিকের একটি বই-এর উল্লেখ করে বলেছেন যে ২৫ মার্চ রাতে (ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী তখন ২৬ মার্চ শুরু হয়ে গেছে) ব্রিগেডিয়ার সালিক যখন টিক্কা খানের সঙ্গে বসে ছিলেন তখন ওয়্যারলেসে ভেসে আসছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা।

১৯৭১-এর ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার কন্ঠেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘোষণা প্রচারিত হয়। ইংরেজিতে সে ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ:
“On behalf of our great national leader, the supreme commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, I hereby proclaim the independence of Bangladesh. The government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of 7.5 million people of Bangladesh and the government people of the independent sovereign state of Bangladesh which is legally and constitutionally formed and worthy of being reconginized by all the governments of the world. May Allah help us. Joi Bangla.”

জিয়র কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত এই ঘোষণাটি সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিকামী বহু মানুষকে, বিশেষভাবে বাঙালি বাহিনীর বহু সদস্যকে প্রবলভবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এর জন্য প্রাপ্য সম্মান ও প্রশংসা জিয়ার রহমানকে দিতেই হবে। তবে ইতিহাস বিকৃত করে এই ঘোঝণা তিনি ২৬ মার্চ প্রদান করেছিলেন তা প্রতিষ্ঠিত করার অবচেষ্টা অতিশয় ঘৃণ্য। কী পরিস্থিতিতে জিয়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন তাও সবার জানা। তাছাড়া ১৯৭৫-এর মধ্য-আগষ্ট পরবর্তী সময়ে তিনি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির হয়ে কাজ করেন, যেভাবে রাজাকারদের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেন, যেখাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজে লিপ্ত হন, যেভাবে নিজের প্রাণ রক্ষাকারী কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলান, কয়েক শত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে হত্যা করেন, তাতে করে জিয়া নিজেই তাঁর একদা সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনকে ধুলায় লুটিয়ে দেন, আর তার ফলেই বাংলাদেশের কোটি মানুষের চোখে তিনি আজ একজন অতিশয় ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট প্রাণী ব্যতীত আর কিছু নন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের যে প্রবাসী সরকার গঠিত হয় তার রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দিন আহমেদ এবঙ বঙ্গবন্ধুর কতিপয় ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বঙ্গবন্ধুর নামেই তখন সরকার পরিচালনা করেন। জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর ওই সরকারের অধীনেই একজন সেক্টর কমান্ডার হিসাবে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও তখনও বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদানকারী মূল শক্তি। সফল মুক্তিযুদ্ধের শেষে মুক্ত স্বদেশে ফিরে এসে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন দেশ পুনর্গঠনের কাজে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির সামনে স্তুপিকৃত পর্বতপ্রমাণ সমস্যাদির সমাধানে তিনি অসামান্য দুরদর্শিতা, দৃঢ়তা ও সাহসের পরিচয় দেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর আহ্বানে রণক্ষেত্র থেকে সদস্য প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যদের অস্ত্র সমর্পণ, অচিন্তনীয় স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ভূখন্ড ত্যাগ এবং আবারো অচিন্তনীয় স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য একটি আধুনিক প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, জনকল্যাণমুখী সংবিধান প্রণয়ন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র নব্বই দিনের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহৃত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশে কি ঘটেছে তার কথা স্মরণ করলেই এ ঘটনার বিশাল তাৎপর্য হবে।

বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বড় সাফল্য স্বাধীনতার নয় মাসের মধ্যে দেশকে একটি চমৎকার আধুনিক সংবিধান উপহার দেয়া। সংবিধান প্রণয়নে তাঁর ধ্যানধারণা ও নির্দেশনা যে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তা সর্বজনবিদিত। এ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চার মূল স্তম্ভের কথা বলা হয়েছিল: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে খসড়া সংবিধান অনুমোদনের সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে এ বিষয়ে অতি স্বচ্ছ, যুক্তিনির্ভর, আলোকসঞ্চারী বক্তব্য উপস্থিত করেছিলেন, জোর দিয়েছিলেন সংগ্রামী ঐক্যের উপর।

জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাপতন্ত্রের মূল্যবোধগুলিকে তিনি যেভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রীয় জীবনে এগুলি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তিনি যে রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, ইতিপূর্বে আর কাউকে আমরা তেমন করতে দেখিনি। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে তিনি যখন বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর করে উপযুক্ত মূল্যবোধসমূহ বাস্তাবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখনই তাঁকে করা হলো। কেন তাঁকে হত্যা করা হলো? কারা তাঁর হত্যার জন্য দায়ী? এটা ভাবা খুবই যুক্তিসঙ্গত যে বঙ্গবন্দুর আদর্শ ও চিন্তাধারার বিপরীত শক্তি, দেশী ও বিদেশী, এজন্য দায়ী। তাঁর আদর্শ ও কার্যক্রম সুস্পষ্টভাবে আঘাত করেছিল অবাধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে,বৃহৎ ব্যবসায়ী সমাজকে, আর সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য পদলেহী অনুচরদের। শোষণের হাতিয়ার পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ তো কখনো একা চলে না। তার অপরিহার্য সঙ্গী হয় স্বৈরাচার, ধর্মান্ধতা, দেশের ঐতিহ্যবর্জিত গণবিরোধী অপসংস্কৃতি। আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রও বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচিতে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। সযত্নে সুকৌশলে বিস্তার করা হয় চক্রান্তের জাল। সেই চক্রান্তের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও জানা যায়নি, কিন্তু যতটুকু উদঘাটিত হয়েছে তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্যাপারটি শুধু কয়েকজন তরুণ সামরিক অফিসারের অ্যাডভেঞ্চার প্রসূত ছিল না, এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজস ছিল দেশের ও বিদেশের, সামরিক ও বেসামরিক অনেক শক্তিধর পুরুষ ও সংস্থার।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের সরকার, এরশাদের সরকার, খালেদা জিয়ার সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের যাবতীয় ইতিবাচক মূল্যবোধ খন্ডিত, বিকৃত এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশের সংবিধান কয়েকবার ধর্ষিত হয়েছে< ইতিহাসবিকৃতি অবিশ্বাস্য রূপ নিয়েছে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ প্রতিশোধ গ্রহণের শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। খালেদা-নিজামীদের জোট-সরকার বাংলাদেশকে একটি জঙ্গী মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তাদের নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডে দেশের সাধারণ মানুষ প্রচন্ড ক্ষোভ ও ক্রোধে ফুঁসে উঠেছিল। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে মহাজোট। কিন্তু জোট-সরকারের আমলে গড়ে ওঠা জঙ্গী মৌলবাদীগোষ্ঠী বাংলাদেশকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে চরম নৈরাজ্যের দিকে। কিন্তু আমরা তো নৈরাজ্য চাই না। আমরা চাই বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে-বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। বঙ্গবন্ধু আজ সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তাঁর জীবন ও কর্মের স্মৃতি জ্যোতির্ময় শিখার মতো অন্তহীন প্রেরণার উৎস হয়ে আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। প্রতিক্রিয়ার শক্তি, খালেদা-নিজামীদের জোট-সরকার, বহু চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে কিন্তু পারেনি, কখনো পারবে না। অন্নদাশঙ্কর

রায়ের ভাষায়:

যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।।
আর, কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়:
মুজিব মানে আর কিছু না
মুজিব মানে মুক্তি,
পিতার সাথে সন্তানের
না-লেখা প্রেম চুক্তি।

লেখক: অধ্যাপক কবীর চৌধুরী: জাতীয় অধ্যাপক। শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও অনুবাদক। বাংলা একাডেমীর সভাপতি।
লেখাটি সংগৃহিত।

বিবিসি’র জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হবার পর জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এই লেখাটি লিখেছিলেন।