এই বিপুল-বিশাল-অন্তহীন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আমরা কি একা? আমাদের এই মহাবিশ্ব বিরাট, বিশাল। এখানে অসংখ্য তারকারাজি, গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সির স্তবক দেখা যায়। একটি গ্যালাক্সিতে গড়ে দশ হাজার কোটি তারা দেখা যায়। এরকম গ্যালাক্সির সংখ্যাও দশ হাজার কোটি। তাহলে মহাবিশ্বে তারার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০১১ x ১০১১= ১০ ২২ । এত তারার মাঝে আর কোথাওই কি প্রাণ বিকশিত হয়নি? পৃথিবী কি একমাত্র স্থান যেখানে বুদ্ধিমান প্রাণীর বিকাশ ঘটেছে?

এটা মেনে নেওয়া শক্ত যে ১০ ২২ সংখ্যক নক্ষত্রের কোনোটিতেই প্রাণ সৃষ্টি হয়নি। বিশেষ করে আজকাল যখন অন্যান্য তারার চারপাশে গ্রহ আবিষ্কৃত হচ্ছে, তখন এটা ভাবাই স্বাভাবিক যে এদের কোথাও না কোথাও প্রাণের বিকাশ ঘটেছে। পৃথিবীতে যখন প্রাণের বিকাশ ঘটেছে, তখন অন্য গ্রহে অনুরূপ পরিবেশে প্রাণের বিকাশ ঘটবে না তা কখনোই বলা যায় না। বিজ্ঞানীরা আজ এই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, বহির্বিশ্বে অণুজীবের বিকাশ ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও সম্ভবত বুদ্ধিমান প্রাণীর বিকাশ একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা। তাই ‘আমরা কি একা’- এই প্রশ্নের উত্তর এখন কারোরই জানা নেই। সম্ভবত আমরা একা নই– আমাদের মহাজাগতিক সঙ্গীদের খুঁজে বেড়ানো অনেক বিজ্ঞানীর সারা জীবনের আশা। ‘প্রাণ এমন এক শৃঙ্খলাবদ্ধ সিস্টেম যা বিশৃঙ্খলার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকতে পারে এবং বংশবিস্তার করতে সক্ষম’– বলেছেন ড. স্টিফেন হকিং।

মনে রাখা দরকার, কোষের প্রাচীরের মধ্যকার ঘটনাবলি বাইরের পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাণ এমন এক নন-ইকুইলিব্রিয়াম সিস্টেম যা কেবল তখনই বাইরের পরিবেশের সাথে একাত্ম হয়ে যায় যখন তার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জীবন বাইরের পরিবেশের সাথে এক গতিময় সাম্যাবস্থায় থাকে। কোষ প্রাচীরের মধ্যে চলে প্রাণময় সত্তার জীবন্ত কার্যক্রম। এই ঘটনা বাইরের রুক্ষ প্রাণহীন বিশৃঙ্খল দশার সম্পূর্ণ উল্টো। প্রাণ এক শৃঙ্খলাপূর্ণ ঘটনাক্রম, অথচ প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলে। বিশৃঙ্খলা বা এনট্রপি বেড়ে চলার এই ভৌতনীতির অপর নাম তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র। প্রাণ তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের পরিপন্থী বলে মনে হলেও আসলে তা নয়। মনে রাখতে হবে, এই বিশ্ব ক্রমান্বয়ে প্রসারণশীল, তাই তার এনট্রপি বাড়ার পরিমাণ কোষপ্রাচীরের ভেতরের এনট্রপি হ্রাসের তুলনায় অনেক বেশি। যা-হোক, কোষ প্রাচীরের ভেতরে সুশৃঙ্খল ঘটনাবলি বজায় রাখতে হলে কোষকে সর্বদা শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে হবে। যন্ত্র বা এঞ্জিন যেমন সুশৃঙ্খল তেল থেকে বিশৃঙ্খল তাপশক্তির সৃষ্টি করে, কোষও তেমনি (শৃঙ্খলাপূর্ণ) খাদ্যকে ভেঙে (বিশৃঙ্খল) তাপ সৃষ্টি করে জীবনকে সমুন্নত রাখে।

এভাবে এনট্রপিও বেড়ে যায়। জীবনের দুটি মৌলিক লক্ষণ হলো একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপ্রণালীর নির্দেশনা এবং সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা। জীবকোষে এই দুটো লক্ষণের নাম জেনেটিক কোড ও বিপাক। পৃথিবীতে আমরা যে জীবনকে জানি সেই ধরনের জীবনের মূল রাসায়নিক ভিত্তি হলো অসংখ্য কার্বন-ভিত্তিক যৌগ। এছাড়া নাইট্রোজেন, ফসফরাস ইত্যাদিও কিছু পরিমাণে থাকে। এই সবে মিলেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীতে জীবনের জয়গান। কার্বন ছাড়া যে জীবন সম্ভব নয় তা-ও নয়। সিলিকনের মতো চতুর্যোজী ক্যাটিনেশন ধর্মযুক্ত মৌলও জীবনের ভিত্তি হতে পারে। তবে সিলিকন-ভিত্তিক রসায়নের কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন সিলিকনের অক্সাইডটি একটি কঠিন পদার্থ (বালু) অথচ কার্বনের অক্সাইডটি একটি গ্যাস (কার্বন-ডাই-অক্সাইড)। এছাড়াও আরো কিছু সমস্যা আছে। তবে এপর্যন্ত আমরা শুধু কার্বন-ভিত্তিক জীবন সম্পর্কেই যা-কিছু জেনেছি, অন্য কোনো জীবনের তাত্ত্বিক সম্ভাবনাই কেবল আমরা বিচার করতে পারি। কার্বনের রসায়ন সত্যিই চমকপ্রদ।

কী না তৈরি করা যায় কার্বন অণুর অসংখ্য চেইন এবং অন্যান্য রূপভেদ (বাকিবল, কার্বন ন্যানোটিউব, গ্রাফিন শিট) ব্যবহার করে!মজার বিষয়, মহাবিশ্বের কিছু ভৌত প্যারামিটারের মান যদি অন্যরকম হতো, তাহলে কার্বন অণুই তৈরি হতে পারত না (যেমন ফাইন স্ট্রাকচার কন্স্ট্যান্ট, ইলেকট্রিক চার্জ, স্থান-কালের মাত্রা ইত্যাদি; বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন আমার বই ‘মহাকাশের কথা’, দ্বিতীয় সংস্করণ, অনুপম প্রকাশনী, ২০১১)। এই সব সংখ্যার মান একটু এদিক-ওদিক হলেই কার্বন অণুর দফারফা হয়ে যেত, জীবনই সৃষ্টি হতো না এই মহাবিশ্বে, পৃথিবীতে তো দূরের কথা ! এসবের অবশ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে । কিন্তু সেসব নিয়ে ভাবিত না হয়ে জীবনকে মেনে নিয়েই আমাদের প্রাণের ইতিহাসটা দেখতে হবে, বিশেষ করে মনোযোগ দেওয়া উচিত এই মহাবিশ্বে প্রাণের বিকাশের ধারাবাহিক ইতিহাসের দিকে।

১৩৭০ কোটি বছর আগে এক প্রবল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে। সেই বিগ-ব্যাঙের ক্ষণে মহাবিশ্ব অতি-তপ্ত, অতি-ঘন, অতি-ক্ষুদ্র দশায় ছিল। প্রথম কয়েক মিনিটে মহাবিশ্বে ছিল শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক মৌলিক কণিকা। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদির সমন্বয়ে মহাবিশ্ব সেইসময়ে দেখতে ছিল প্লাজমার মতো (সূর্যের বর্ণমন্ডলের অনুরূপ দশা)। কয়েক লক্ষ বছর পর বিশ্বের তাপমাত্রা কমে এলে ইলেকট্রন ও প্রোটন মিলে হাইড্রোজেন পরমাণু এবং দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রনের সমন্বয়ে হিলিয়াম পরমাণু তৈরি হয়। এর চেয়ে ভারী কোনো মৌল বিশ্বের প্রাথমিক দশায় তৈরি হতে পারে না। কারণ, প্রসারণের সাথে সাথে মহাবিশ্বের তাপমাত্রাও কমতির পথে ছিল। তাই আদিতে বিশ্বে কোনো কার্বনও তৈরি হতে পারেনি। এর দুই বিলিয়ন বছর পর দেখা যায় আদি প্লাজমার কিছু কিছু অংশ অন্য অংশের তুলনায় বেশি ঘন, তাই সেইসব জায়গায় মহাকর্ষের অধীনে ঘনীভবন শুরু হতে দেখা দেয়। আদিম বিশ্বের ঘনত্বের এই তারতম্য দেখা যায় WMAP স্যাটেলাইটের তোলা পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রার বিচলন (fluctuation) পরিমাপ থেকে। এই পরিমাপ থেকে আদি প্লাজমার ঘনত্বে যে বাড়া-কমা ছিল তা মাপা গেছে। এখন যে জায়গায় পাশের অঞ্চলের তুলনায় ঘনত্ব বেশি, সেই অঞ্চলে বস্তুর ঘনত্বও বেশি থাকে বিধায় সেখানে মহকর্ষীয় আকর্ষণ বেশি হয়।

তাই ঐ অঞ্চলে গ্যাস ঘন হতে শুরু করে এবং ঐ গ্যাস থেকে ধীর লয়ে তৈরি হয় গ্যালাক্সি ও তারাসমষ্টি। প্রথমদিকের তারাদের ভর ও উজ্জ্বলতা ছিল সূর্যের তুলনায় অনেক বেশি। এইসব তারা বিশ্ব সৃষ্টির সময়কার আদিম হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামকে তাদের তন্দুরে ভালোভাবে জ্বালিয়ে (পড়ুন নিউক্লিয় ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে) ভারী মৌলিক পদার্থ তৈরি করে। এভাবেই মহাবিশ্বে কার্বনসহ অন্যান্য ভারী মৌলের আবির্ভাব হয়। তারার কেন্দ্রের নিউক্লিয় বিক্রিয়াই একমাত্র উৎস যেখানে প্রথম দশার হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম জ্বলে-পুড়ে পর্যায়-সারণির অন্যান্য মৌলিক পদার্থ তৈরি করে। এসব তারার মৃত্যুর প্রক্রিয়ায় যে সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়, তাতেও ভারী মৌল তৈরি হয়। এসব পদার্থ আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই কাঁচামাল থেকে তৈরি হয় নতুন নক্ষত্রের। তারপর এই নক্ষত্রেরও মৃত্যু ঘটে এবং তার ভস্ম থেকে জন্ম নেয় নয়া নক্ষত্র। এভাবে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হয় পর্যায়-সারণির একশ আঠারোটি মৌলিক পদার্থের। এভাবেই তারার অভ্যন্তরে তৈরি হয় আমাদের শিরা-ধমনীর কার্বন, অক্সিজেন, লোহা। তাই আমরা সবাই স্টারডাস্ট, কোটি বছরের নক্ষত্র-ধূলিতে তৈরি আদমসুরত।

সাড়ে চারশত কোটি বছর পূর্বে আমাদের সৌরপরিবার তৈরি হয়েছে। আমাদের সূর্য একটি মাঝারি মানের তৃতীয় প্রজন্মের নক্ষত্র। ভ্রূণ-সূর্যের চতুষ্পার্শ্বে ঘূর্ণ্যমান পাথর, ধূলিকণা ও গ্যাসের সমন্বয়ে পৃথিবীর জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর সৃষ্টির পঞ্চাশ থেকে একশ কোটি বছরের মধ্যে কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদি মিলে এক অত্যাশ্চর্য বৃহদাণুর সৃষ্টি হয় যা নিজেই নিজেকে কপি করতে সক্ষম। এই বৃহদাণুটির নাম আরএনএ বা রাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড। এরই অধিকতর সুস্থায়ী (রাসায়নিক অর্থে) আরেকটি সহোদরের নাম ডি-অক্সি রাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড বা ডিএনএ। এই ডিএনএ’কে ভিত্তি করেই পৃথিবীর প্রায় সকল জীবন্ত কোষ তাদের জীবনের তথ্য বংশ-পরম্পরায় ছড়িয়ে দেয়। ডিএনএ’র গঠন প্যাঁচানো সিঁড়ির মতোন। জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ত্রিক এই গঠনটি আবিষ্কার করেন। প্যাঁচের দুই পাশে থাকে ফসফেট চিনির কাঠামো। এদের দুইয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে ক্ষার-অণুর জোড়া। একপাশে অ্যাডেনিন থাকলে অন্যপাশে থাকে থাইমিন (A-T); এবং একপাশে সাইটোসিন থাকলে অপরপাশে থাকে গুয়ানিন (G-C)। এভাবে পরিপূরক অণুর সমন্বয়ে সিঁড়ির ধাপগুলোর সৃষ্টি হয়। এই ক্ষার-অণুর তিনটি পরপর জোড়াকে নিয়ে কোডন তৈরি হয়। একেকটি কোডন একেকটি অ্যামিনো অ্যাসিড নির্দেশ করে। সমস্ত জীবকোষই মাত্র কুড়িটি অ্যামিনো অ্যাসিডের একটি সার্বজনীন সেট ব্যবহার করে। এভাবে একের পর এক অ্যামিনো অ্যাসিডের সমন্বয়ে প্রোটিন তৈরি হয়। প্রোটিনসমূহ জীবনের সকল প্রয়োজনীয় কার্য নির্বাহ করে। তাই জীবনের কার্যনির্বাহী একক হলো প্রোটিন এবং তথ্য-নির্দেশনার একক হলো ডিএনএ।

মহাবিশ্বে আরএনএ বা ডিএনএ’র মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ অণুর উদ্ভবের সম্ভাবনা কেমন? একদম এলোমেলো যদৃচ্ছ বা র‌্যান্ডম চান্স হিসেবে তা খুবই ক্ষুদ্র। কিন্তু বিশ্বে ১০ ২২ সংখ্যক তারার উপস্থিতি এই ক্ষুদ্র সম্ভাবনাকেও মূর্ত করে তোলে। তাই কিছু কিছু তারার কোনো কোনো গ্রহে অনুরূপ শর্তের অধীনে আরএনএ বা ডিএনএ তৈরি হতে পারে। পৃথিবীতে তো তৈরি হয়েছে, কিন্তু এখানে না হয়ে অন্যত্র হলে সেখানেও আমরা একই প্রশ্ন তুলতাম, ‘এখানে কেন?’ যাহোক যেখানেই প্রাণের উদ্ভব হোক, যেহেতু এটি খুব কম সম্ভাবনার ব্যাপার, তাই অনেক কোটি বছর পরই জীবনের উদ্ভব হয়, যদি অবশ্য অনুকূল পরিবেশ পাওয়া যায়। বলা দরকার, অনেক কিছুর সাথে (যেমন নক্ষত্র থেকে এমন দূরত্বে অবস্থান করতে হবে যাতে পানি তিন দশাতেই থাকতে পারে ইত্যাদি) নক্ষত্রের দীর্ঘস্থায়িত্বও জীবন সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। কারণ, প্রথম কোষ আবির্ভাবের প্রায় আড়াই বিলিয়ন বছর পরে বহুকোষী জীবের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার আগেই যদি নক্ষত্রের মৃত্যুঘন্টা বাজে তো সব আয়োজন মাঠে মারা যায় !

পৃথিবীতে জীবনের ক্রমবিকাশ প্রথম দিকে খুব ধীরলয়ে ঘটেছে। সৃষ্টি হবার পর প্রাথমিক দোলাচল কাটিয়ে থিতু হবার প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর পর পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ সবচেয়ে প্রাচীন ফসিল রের্কড তা-ই বলে। এককোষী প্রাণীর আবির্ভাবের প্রায় আড়াই বিলিয়ন বছর পর বহুকোষী প্রাণীর উদ্ভব ঘটে। তারও প্রায় এক বিলিয়ন বছর পর মাছ ও সরীসৃপের দেখা মেলে। তারপর মনে হয় যেন বিবর্তন বেশ একটু গতি পায়– কারণ তারপর মাত্র দশকোটি বছরের মধ্যে দেখা যায় প্রাথমিক স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে মানুষের বিচরণ শুরু হয়ে গেছে। মাছের মধ্যে মানুষের অধিকাংশ সরলতম প্রত্যঙ্গের দেখা মেলে, তাই মনে হয় আমাদের আদি ইতিহাস জলজ-ই ছিল। এককোষী সরল প্রাণী থেকে বহুকোষী জীবে বিবর্তন কিংবা জলজ পরিবেশ ছেড়ে ডাঙ্গার দিকে জীবনের যাত্রাপথের মূল চালিকাশক্তি হলো জীবনের ক্রমবিকাশ। যার মূলে আছে র‌্যান্ডম মিউটেশন। আমরা জানি, ডিএনএ কপি করে বংশবিস্তার করে। এই কপি হবার প্রক্রিয়া নির্ভুল নয়, কদাচিৎ কখনো একটা-দুইটা ভুল হয়ে যেতেই পারে। এইসব ভুল অধিকাংশই জীবনের জন্য ক্ষতিকর, তাই তা পরিতাজ্য। অর্থাৎ ঐসব বংশধারা পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু কদাচিৎ দেখা যায় হঠাৎ করেই কোনো কোনো যদৃচ্ছ ভুল জীবনের প্রতিযোগিতায় একটা বড় সুযোগ এনে দেয়। প্রাকৃতিক পরিবেশে দীর্ঘকালের যাত্রায় যে জীব যত ভালোভাবে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে, তারই জয়জয়কার ঘটবে। এটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার যা দৈনন্দিন জীবনেও দেখা যায়। লক্ষ করলে দেখবেন, ইদানিংকার ঢাকা শহরের মশককুল ফ্যানের বাতাসেও হার মানছে না। তার কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন মশককুলকে শক্ত ডানা দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই একই প্রাকৃতিক নিয়মের কারণে আপনি দেখবেন যে প্রচলিত অ্যারোসোল আর মশা তাড়াতে পারছে না। একই কারণে মানুষের জন্য ক্ষতিকর জীবাণুরা আর অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধকে পাত্তা দিচ্ছে না। তাই আমরা দেখছি যক্ষ্মার মতো রোগ আরার মৃদুভাবে ফিরে এসেছে। এসবই প্রাকৃতিক বিবর্তনের সরাসরি ফলাফল। আপনি মানুন আর না-ই মানুন, জীবন তার নিজস্ব গতিতে চলতেই থাকে।

ইদানিং মানুষের ইতিহাসে এক নতুন বিপ্লব ঘটেছে। এটা হলো তথ্য বিপ্লব। ভাষার আবিষ্কারের পর মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখল। আরো পরে যখন লেখার আবিষ্কার হলো তখন তার সঞ্চিত জ্ঞানকে লিখিত আকারে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করতে শিখল। এখন সব তথ্যই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এটাই তথ্য বিপ্লব। জীবকোষের ডিএনএ’র পরিবর্তে এখন তথ্য ডিজিটালি সংরক্ষিত হচ্ছে, কিংবা লিখিত কেতাবে সংরক্ষিত থাকছে। এই তথ্য বিপ্লব জীবজগতের দীর্ঘ পরিসরে কী প্রভাব আনবে সেটা বলা যাচ্ছে না। তবে বুদ্ধিমান সভ্যতার বিকাশে এটা বৈপ্লবিক অবদান রাখে, এবং প্রকারান্তরে ঐ প্রাণীর জৈব বিকাশেও প্রভাব ফেলে। মানুষের ডিএনএ’তে প্রায় তিন বিলিয়ন নিউক্লিয়িক অ্যাসিড আছে। এদের অধিকাংশই কোনো কাজে লাগে না। এক সময়ে হয়ত লাগত, কিন্তু এখন সেসব সিকোয়েন্সে কোনো অর্থবহ প্রোটিন হয় না। কিন্তু জীবন এই তথ্য ছেঁটে ফেলে দেয়নি। গত দশহাজার বছরের ইতিহাসে মানুষের ডিএনএ’তে কোনো পরিবর্তনই দেখা যায় না। মানুষের ডিএনএ’তে প্রায় একশ মিলিয়ন বিট প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে। একটি গড়পড়তা পেপারব্যাক উপন্যাসের তথ্য সংখ্যা দুই মিলিয়ন বিট। তাহলে আমার-আপনার কোষের অভ্যন্তরে যে তথ্যভাণ্ডার আছে তা মোটামুটি পঞ্চাশটি ‘মাসুদ-রানা’ বইয়ের সমতুল্য। পশ্চিমা দেশের একটি বড়সড় ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পাঁচ মিলিয়ন বই থাকতে পারে। তাই বই বা লিখিত আকারে তথ্যের সঞ্চয় মানব জিনোমের এক লক্ষ গুণ! কাজেই ডিএনএ’র তুলনায় অনেক বেশি তথ্য আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে দিতে পারি। জীবকোষের বাইরে তথ্যের এই প্রবাহ সম্পর্কে স্টিফেন হকিং বলেন, “এর মানে এই যে আমরা বিবর্তনের এক নতুন দশায় প্রবেশ করেছি। প্রথম দিকে র‌্যান্ডম মিউটেশনের সাহায্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন এগিয়েছে। এই ডারউইনিয় দশার সময়কাল ছিল প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর যার সাহায্যে এই আমরা এসেছি, যারা তথ্য বিনিময়ের নিমিত্তে ভাষা আবিষ্কার করেছি। কিন্তু গত প্রায় দশ হাজার বছর সময়কালে আমরা একটা বহিস্থ প্রবাহের দশায় আছি। এই দশায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ডিএনএ কর্তৃক বাহিত তথ্যের অন্তস্থ রেকর্ডে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু বাইরের রেকর্ড, বই আকারে বা তথ্যের অন্যান্য সঞ্চয় ভাণ্ডার বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।”

এই তথ্য-বিপ্লবের ফলে এক কৌতূহলোদ্দীপক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন যে হারে নিত্য-নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে, সেই হারে আমাদের জৈবিক স্মৃতিশক্তি বাড়ছে না। অর্থাৎ জৈবিক বিবর্তন বাহ্যিক জ্ঞানের বা তথ্যের বিবর্তনের সাথে আর তাল মেলাতে পারছে না। তাই আমরা ‘বিশেষজ্ঞ’ শ্রেণীর সৃষ্টি করেছি। আমরা এখন সব ব্যাপারে কিছু কিছু জানার চেষ্টা করি, কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে সব জানার চেষ্টা করি। মনে হয়, দূর-ভবিষ্যতে মানুষ জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যে বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর চেষ্টা করবে। মানব-জিনোমের সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার এখন হয়ে গিয়েছে। জিনোম পাঠোদ্ধারের প্রথম দিকে মানুষ রোগ-বালাই দূর করার চেষ্টায় রত থাকবে। কিন্তু এক সময়ে সুপারম্যান তৈরির প্রচেষ্টা দমিয়ে রাখা কষ্টকর হবে। এভাবে হয়ত আমরা আমাদের ষড়রিপুর বদলে বুদ্ধিমত্তা বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হবো। এমন হবার সম্ভাবনা আরো বেশি যে জৈবিক জীবনের সাথে ইলেকট্রনিক্সের এক অকল্পনীয় মিথস্ক্রিয়া ঘটবে। ফলে বুদ্ধিমান বায়ো-ইলেকট্রনিক সত্তার বিকাশ ঘটবে। এভাবে হয়ত আমাদের দূর -ভবিষ্যতের ধীমান সভ্যতা এই গ্যালাক্সির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। জীবনের সাথে ইলেকট্রনিক্সকে মেলাতে পারলে বার্ধক্য আর কোনো সমস্যাই হবে না। এভাবে হয়ত আমরা নিজেরাই আমাদের ভবিষ্যৎ ডিজাইন করতে পারব। যদি ধরা যায় যে, আগামী বহু কোটি বছরে মানুষের ভবিষ্যৎ সভ্যতা কাছাকাছি গ্যালাক্সিগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে (যদি অবশ্য তার পূর্বে আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস না করে ফেলি), তাহলে মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণের সাথে ভবিষ্যৎ জীবনের কেমন বিবর্তন হবে?

১৯৯৮ সালের দিকে জ্যোতির্বিদেরা পর্যবেক্ষণ থেকে জানতে পেরেছেন যে, এই মহাবিশ্ব ত্বরিত হারে প্রসারিত হয়ে চলেছে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত আরো অন্যান্য পর্যবেক্ষণ, অপ্রত্যক্ষ গণনা ইত্যাদি এক মহাজাগতিক সমাপতনের ইঙ্গিত দেয়। এই সমাপতন অনুযায়ী দেখা যায় একাধিক পর্যবেক্ষণলব্ধ ডেটাসেট এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই ত্বরিত হারে প্রসারণশীল বিশ্বে ডার্ক এনার্জি প্রাধান্য বিস্তার করে, এর জ্যামিতি সমতল পৃষ্ঠের জ্যামিতি এবং এখানে দৃশ্যমান বস্তুর পরিমাণ মাত্র ৪ শতাংশ। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, একটি উন্মুক্ত অসীম প্রসারমাণ বিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণী কি অনির্দিষ্টকাল বেঁচে থাকতে পারে?

আমরা আগেই বলেছি যে, কোষ-প্রাচীরের অভ্যন্তরে জীবনের জটিলতা বাইরের পরিবেশ থেকে বেশি। অর্থাৎ ভেতরের এনট্রপি বাইরের থেকে কম। এই স্বাতন্ত্র্য বা এনট্রপির এই পার্থক্য জীবনের প্রাণশক্তি বজায় রাখে। কিন্তু যদি পরিবেশের তাপমাত্রা খুব কমে যায়, যেমনটা একটি উন্মুক্ত ত্বরিত প্রসারমাণ বিশ্বে হবার সম্ভাবনা বেশি, (কারণ অতিদূর ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে সব তারা নিভে যাবে এবং শক্তির উৎসের ক্রমান্বয়ে অভাব দেখা দেবে) তখন জীবনের জটিলতা বজায় রাখতে জীবকোষ থেকে প্রচুর তাপ বাইরে বেরিয়ে যায়। বেশি তাপ বেরিয়ে গেলে জীবকোষকে বেশি বেশি খাবার খেতে হবে। কিন্তু শক্তির উৎস যেখানে অপ্রতুল সেখানে খাবার উৎসেরও অভাব দেখা দেবার কথা। তখন ধীমান সত্তার আবশ্যিক জটিলতা কিংবা তথ্য প্রক্রিয়াকরণের শক্তির অভাব দেখা দেবে। তাই বেঁচে থাকতে হলে ঐ জটিলতাকে (কিংবা এনট্রপির বা তাপমাত্রার পার্থক্যকে) সংরক্ষণ করতে হবে। ফ্রিম্যান ডাইসন দেখিয়েছেন যে, তথ্য প্রক্রিয়াকরণের হার দেহ-তাপের সমানুপতিক।

স্বাভাবিক মানবদেহের তাপমাত্রা ৩১০ কেলভিন এবং এই তাপমাত্রার মানবদেহে ১০০ ওয়াট শক্তি খরচ করে। এর অর্ধেক তাপমাত্রায় শক্তি খরচ হয় ২৫ ওয়াট, কিন্তু চিন্তার দ্রুতি কমে অর্ধেক হয়ে যায়। ক্রম-প্রসারমাণ বিশ্বে, যেখানে বাহ্যিক তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে পড়তির দিকে, সেখানে বুদ্ধিমান জীবকে বেঁচে থাকতে হলে তার জটিলতা পরিহার করতে হবে। অর্থাৎ চিন্তা কম করতে হবে, ফলে কম তথ্যের প্রয়োজন পড়বে, তাপও কম খরচ হবে। একই সাথে জীবনীশক্তির অধিকতর সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জৈবিক কাজ কমিয়ে দিয়ে বিপাকের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। এমন হতে পারে বুদ্ধিমান (অবশ্য চিন্তা কমিয়ে দিলে ‘বুদ্ধি’ শব্দের অর্থ কীরকম হবে সেটা ভাবা যেতে পারে) প্রাণী দীর্ঘস্থায়ী শীতনিদ্রায় চলে যেতে পারে। প্রাণ যেখানে ওষ্ঠাগত, খাদ্য ও শক্তি যেখানে অপ্রতুল, বুদ্ধি সেখানে বিলাসিতা। তাই দেখা যায়, উন্মুক্ত বিশ্বে বুদ্ধি ও জীবনের জটিলতা অনেকাংশে পরিহার করে কেবল সামান্য কিছু তথ্যের উপর্যুপরি ব্যবহার করে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব। এভাবে, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে, অসীমকাল বাঁচা সম্ভব। শরৎচন্দ্রের সেই বিখ্যাত উক্তি স্মর্তব্য, ‘অতিকায় হস্তী লোপ পায়, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া থাকে।’

তাই আমরা, বুদ্ধিমান মানুষ, যদি নিজেদের ধ্বংস না করে, নিজেদেরকে আরো উন্নত করে, যদি পর্যাপ্ত দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে অতিদূর ভবিষ্যতে উন্মুক্ত বিশ্বে শক্তির প্রাচুর্যহীন পরিবেশে যদি টিকে থাকতে চাই, তবে মনুষ্যত্ব পরিহার করে, বুদ্ধির চাকচিক্য ফেলে দিয়ে, ঐ ‘তেলাপোকা’ হয়েই বেঁচে থাকতে হবে। তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স হয়ত নতুন এক ভেলকি দেখাতে পারে। হয়ত ‘বেবি ইউনিভার্স’ তৈরি করে বুদ্ধির সংকেতকে অন্য বিশ্বে পাচার করে দিতে পারে। কিন্তু ‘তেলাপোকা’ হয়ে বাঁচার চেয়ে বুদ্ধিমান অবস্থায় মৃত্যুও শ্রেয়। আপনি কী বলেন?

সহায়ক গ্রন্থাবলী
১.“লাইফ ইন দ্য ইউনিভার্স”- স্টিফেন হকিং, ২০০১.
২.“টাইম উইদাউট এন্ড: ফিজিক্স এন্ড বায়োলজি ইন অ্যান ওপেন ইউনিভার্স”, ফ্রিম্যান ডাইসন, রিভিউস অব মডার্ন ফিজিক্স, ৫১ খ-, সংখ্যা ৩, পৃ.৪৪৭৩৪৬০, ১৯৭৯।
৩.“দ্য ফেট অব লাইফ ইন দ্য ইউনিভার্স” , লরেন্স ক্রাউস ও গ্লেন স্টার্কম্যান, সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান, নভেম্বর ১৯৯৯।
৪. অপূর্ব এই মহবিশ্ব – এ.এম.হারুন-আর-রশীদ ও ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, প্রথমা প্রকাশন,২০১১

 

লিখেছেনঃ
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
বিজ্ঞান গবেষক ও শিক্ষক।
source:  bdnews24.com