কাঁধে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলিয়ে ভৈরব বাজারের নদীর পাড়ে আবর্জনার স্থূপে একাগ্রচিত্তে কাগজ কুড়াচ্ছিল শিশুটি। বয়স চার কি পাঁচ বছর হবে। হাত দিয়ে ইশারা করতেই কাছে এসে দাঁড়ায়। নাম জানতে চাইলে মৃদু স্বরে বলে ‘নয়ন’। বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে পারেনি। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে বলে “ঘর বাড়ি নাই, রেল ইস্টিশনে থাহি”। সম বয়সীদের মত স্কুলে পড়তে চায় কি না এমন প্রশ্নে জবাবে নয়নের সরল উক্তি “ইস্কুলে পড়লে টেহা লাগে, আমার কি টেহা আছে?”

নয়নের মত এমন অনেক শিশুই রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাগজ কুড়ায়। বাবার কোলে অপার স্নেহ আর মায়ের আঁচলে মুখ লুকানোর স্বর্গীয় সুখ যাদের কপালে জোটেনি। ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই ওরা অনাদর, অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছে ধাপে ধাপে। রাস্তার পাশে জেগে উঠা আবর্জনার স্থূপ, বাস টার্মিনাল-রেলস্টেশন-লঞ্চঘাটসহ এখানে-সেখানে নোংড়া অপরিচ্ছন্ন স্থানটুকুই আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয় ওরা । কাগজ কুড়ানো কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি দিয়েই ওরা জীবন শুরু করে। সব্যসাচী মানুষের ধিক্কার, চড়-থাপ্পরসহ নানা শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত। ওরা যেন সমাজের সর্বোচ্চ অবহেলিত মানুষ। ওদের নিয়ে ভাবনার সময় হয় না কারো। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সহ সকল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ওরা কারো সহানুভূতি পায় না কখনো। বেঁচে থাকার আহার টুকু কখনো রোজগার করতে না পারলে পেটের জ্বালায় ওরাই বেছে নেয় চুরি, ডাকাতিসহ নানা সামাজিক অপরাধমূলক কাজ। সমাজের এসব পথ শিশুরা কারো কাছে ‘টোকাই’ আবার কারো কাছে ‘পিচ্চি’ হিসেবে পরিচিত।

ভৈরব রেলস্টেশন এসব ছিন্নমূল টোকাইদের একটি বড় অংশের বিচরণস্থল। এছাড়া ভৈরব বাজারের আশেপাশে বিভিন্ন রাস্তার পাশে, কল-কারখানার আবর্জনার স্থূপে অনেক টোকাই ছেলে-মেয়েদের কাঁধে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলিয়ে কাগজ কুড়াতে দেখা যায়। তাছাড়া বাসস্ট্যান্ডে অনেক পথ শিশুকে বাসের কন্টাক্টারের সাথে সাথে যাত্রী হাঁকতে দেখা যায়।

কিন্তু শিক্ষা বঞ্চিত, সমাজ সভ্যতার তিমিরে নিমজ্জিত এসব ছিন্নমূল টোকাই-পিচ্চিদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ওদের মেধা ও শ্রমের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটিয়ে দেশের সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। ভিক্ষা নয়, দেশের উৎপাদনের বড় একটি অংশের যোগান দেয়া যেতে পারে ওদের দ্বারা। সেই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে একটি বেসরকারি এন.জি.ও সংস্থা ভৈরবের টোকাইদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৯৯ সালে ৩০ জন অনাথ পথ শিশুকে নিয়ে এনজিও ‘পপি’ শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় ‘পথ শিশু ও কর্মজীবী শিশু নিবাস ভৈরব’ নামে একটি আশ্রম গড়ে তোলে। ফলে ছিন্নমূল টোকাই শিশুদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা শেষে সামর্থানুসারে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরাই খুঁজে দিতো এদের কাজ। এতে করে এদের কর্মসংস্থানের একটি বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসে ওই এনজিও সংস্থা তাদের এ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিলে ভৈরবের অনাথ এ পথ শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর আর কোন প্রতিষ্ঠানই রইল না। পথ শিশু ও কর্মজীবী নিবাসের খবর নিতে ‘পপি’ অফিসে যোগাযোগ করা হলে তাদের প্রজেক্ট শেষ হয়ে যাওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেছে বলে একজন অফিস কর্মকর্তা জানান।

সচেতন মহলের অভিমত, সরকারসহ বিভিন্ন এনজিও ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি যদি এসব ছিন্নমূল অসহায় শিশুদের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে এরা উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে দেশ গড়ার কাজে অংশ নিতে পারে। প্রতিটি শহরে পথ শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠলে ঠিকানাহীন নিরাশ্রয় এসব শিশুরা মানুষ হবে। দেশ হবে সমৃদ্ধশালী। দেশে নতুন করে আর কোন টোকাই সাগর, পিচ্চি হান্নানের মতো সন্ত্রাসী সৃষ্টি হবে না।