ছোটবেলা থেকেই সরারচর থেকে মানিকখালী কিংবা কিশোরগঞ্জ অথবা সরারচর থেকে ভৈরব কিংবা ঢাকা এই পথ গুলো আমার কাছে ছিল স্বপ্নের মত। কেননা মানিকখালী ছিল আমার দুই ফুফুর বাড়ী বিভিন্ন কারনেই প্রায়ই যেতে হত এর বিশেষ কারনগুলোর মধ্যে একটি ছিল কটিয়াদীর কুড়ীখাই মেলা ও মন্ডলভোগের রহমান পাগলার মেলা। আমাদের এলাকার এই দুইটি মেলায় সুপরিচিত আর এই দুই মেলার কাছাকাছিই ছিল আমার দুই ফুফুর বাড়ী। যাত্রা পথ একটায় সে হল ট্রেন ।
সরারচর রেলষ্টেশন থেকে দুই ষ্টেশন পড়েই কিশোরগঞ্জ সদরের দিকে যেতে মানিকখালী ষ্টেশন । ট্রেন বলতে ভোরের ট্রেন চিটাগাং মেইল, এগার সিন্দুর এক্সপ্রেস, আর নয়তো ঈশাখা মেইল ।সঙ্গত কারনেই ট্রেন চড়ে ফুফুর বাড়ীর মেলায় যাওয়ার আগের দুই তিন রাত ঠিক মত ঘুম হতনা।লেখা পড়ার চাপ থেকে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচার যেন একটাই সুযোগ।
স্বল্প সময়ের ট্রেন যাত্রায় বিভিন্ন ধরনের চরিত্র মনে দাগ কাটে। তারমধ্যে অনেক স্মৃতি জমে আছে মনের মনিকোঠায়। যখন পরীক্ষা শেষ বা বিশেষ কোন ছুটি থাকত তখন বাবার সাথে ঢাকা পাড়ি জমাতাম দীর্ঘ সাড়ে তিনি ঘন্টার পথ। মনে আছে হঠাৎ কেরোসিনের দাম বেড়ে যায় কারন ছিল সাদ্দাম বুসের যুদ্ধ।
ট্রেনে একজন মধ্যবয়সী হকার কে ক্যানভাস করতে শুনেছিলাম- খাঁডি কেরাসিন তেলের বাজা, আগে গাড়ীর লাইজ্ঞা, ফরে বাড়ীর লাইজ্ঞা, এর ফরে বালা লাগলে হৌর বাড়ীর লাইজ্ঞা, গাড়ীর লাইজ্ঞা দুই টেহা, বাড়ির লাইজ্ঞা পাঁচ টেহা, নিজের লাইগা দশ টেহা, আরহৌর বাড়ীর লাইজ্ঞা বারো টেহা, লাগলে লইয়া লইন, আর বেশি নাই সামনের ইস্টিশনে নাইমা পরবাম।
এত বছর পরও যখন বাড়ী যাই তাকে পাই একই ডায়লগ এখনও সে যেন মধ্যবয়সী। তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকা এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস প্রভাতী কিংবা গোধূলী।
আমার ঢের মনে আছে একবার বাবা বলেছিল- আমি যখন ইউনিভার্সিটি পড়ি তখন তাঁকে এমনি দেখেছি এখন যেমন দেখি। বাবা নেই আজ চৌদ্দ বছর, মাসে একবার বাড়ী যাই সেই এগারসিন্দুরেই। সেই পুরনো ডায়লগ আজো শুনি, তিনি এখনও তেমনি আছেন যেমন বাবা ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন দেখেছিলেন, আমি বাবার সাথে দেখেছিলাম, আমি এখনো দেখি।
হাসিব কে বলেছিলাম এবার যখন বাড়ী যাচ্ছ, উনাকে যদি ট্রেনে পাও তবে সম্ভব হলে উনার ছবি ও কিছু তথ্য নিয়ে এসো। হাসিব আজ এসেছে সে জানাল তাঁর নাম কিসমত আলী, বাড়ী-দৌলত কান্দী, রায়পুরা থানা, জেলা- নরসিংদী। স্বাধীনতার আগে উনি চিরুনী, লজেন্স বিক্রি করত। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অব্দী নিজের তৈরী চানাচুরই বিক্রি করেন। তাঁর পাঁচ ছেলে, দুই মেয়ে। আক্ষেপ করলেন একটি ছেলে তাঁর প্রতিবন্ধী। প্রায়ই দৌলতকান্দি থেকে ভৈরব স্টেশন পর্যন্ত উনি পায়ে হেঁটে আসেন। মাঝে মধ্যে আসেন সি,এন,জি দিয়ে।
আমার দেখা কয়েকজন সংগ্রামী মানুষের মধ্যে তিনি অন্যতম। জীবনের মানে তাঁর কাছে তিরিশ কেজির একটি বেগ শুন্য করে বাড়ী ফেরা। যেখানে স্বপ্ন গুলো প্রতিনিয়ত তাঁর দিকে চেয়ে থাকে সন্ধ্যা লগ্নে বাড়ী ফেরার প্রত্যাশায়।
লিখেছেনঃ জি এম ফ্রেজার
লিখাটা ভালো লাগলো। আরও লিখবেন।
আমরা ওনাদের মত মানুষ কেই খুজে বের করতে চাই ।
good news search some other people like kismote ali
Nostalgic….