বর্তমান যুগে নিত্যদিনের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোন ছাড়া দিনযাপনের কথা এখন ভাবাও যায় না। এই প্রযুক্তি পণ্যটি দিন দিন মানুষের বন্ধু হয়ে উঠলেও লোকচক্ষুর অন্তরালেই প্রকৃতিজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এর বিভীষিকা। হারিয়ে যাচ্ছে চেনা পাখি, কীটপতঙ্গ, মরে যাচ্ছে গাছ-গাছালি। আর এর প্রধানতম কারণ মোবাইল টাওয়ার থেকে নির্গত তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিস্তারিত বর্ণনার আগে নিজেরাই একবার মনে করুন তো, বাড়ির চারপাশে বা এলাকায় আগে যত মৌমাছি, চড়ুই পাখি, বুলবুলি, শালিক, টুনটুনি, ময়না, টিয়া, সারস, ব্যাঙ, চামচিকাসহ হরেক রকম প্রাণী ও কীটপতঙ্গ দেখতে পেতেন; এখনো কি তাদের তেমন ব্যাপক সংখ্যায় দেখা যায়? উত্তরে বেশির ভাগই বলবেন ‘না’। নগরায়ণ, কীটনাশকের ব্যবহার, বিষাক্ত বর্জ্য ইত্যাদির প্রভাবে এগুলোর সংখ্যা দিন দিন কমছে- এমনটাই এত দিন বলতেন পরিবেশবিদরা।

কিন্তু সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় ভারতের কিছু বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, এসব নিত্য চেনা পাখি ও কীটপতঙ্গ কমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, প্রতিটি এলাকায় যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য ব্যবহার করা টাওয়ার থেকে নির্গত চুম্বকীয় বিকিরণ। এসব টাওয়ার থেকে প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে বেতার তরঙ্গ। এসব তরঙ্গ এক হয়ে বায়ুমণ্ডলে একটি তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। এই বিকিরণকে গবেষকরা বলছেন, মানবসৃষ্ট নবতম দূষণ। যেহেতু, বর্তমানে যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য মোবাইলের টাওয়ারই বেশি নির্মিত হচ্ছে, সে জন্য দোষটা বেশি করে চাপছে এই প্রযুক্তি পণ্যটির ওপরই।

গবেষকরা জানান, বেতার তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রটির ভেতর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় পাখির শরীর ও মস্তিষ্কে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া ওই চৌম্বক ক্ষেত্রের ভেতর বাসা বোনা পাখির ডিম পাড়তে সমস্যা হয়, ডিম পাড়লেও ছানা ফোটে না। মৌমাছিরা চুম্বকীয় এলাকায় উড়ে গেলে ভুলে যায় কোথায় ছিল তার মৌচাক, দিগভ্রান্ত হয়ে উড়ে যায় অন্যদিকে এবং আর চাকে ফিরতে পারে না।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ওই বিকিরণের কারণে বদলে যাচ্ছে পশু-পাখি-পতঙ্গকুলের আচরণ, প্রভাব পড়ছে তাদের প্রজননেও। ফলে দ্রুত কমছে এদের সংখ্যা।ভারতীয় গবেষকরা এ জন্য আদর্শ উদাহরণ হিসেবে বেছে নেন অতি পরিচিত চড়ুই পাখিকে। তাঁরা সমীক্ষা চালিয়ে দেখেন, মোবাইল টাওয়ার যত বেড়েছে, তত কমেছে চড়ুইয়ের সংখ্যা। এ ছাড়া, গবেষকরা ৫০টি চড়ুইয়ের ডিম পরীক্ষামূলকভাবে ৩০ মিনিট ধরে তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের মধ্যে রেখে দেখেছেন, এর সবই নষ্ট হয়ে গেছে!

জানা গেছে, পাশ্চাত্যেও একইভাবে হারিয়ে গেছে চড়ুইয়ের দল। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, ১৯৯৪-এ লন্ডন শহরে যত চড়ুই ছিল, মোবাইল ফোন টাওয়ারের দাপটে এখন তার ৭৫ শতাংশ উধাও! একইভাবে স্পেনের ভালাডোলিড শহর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সারস। সারা বিশ্বে বিপন্ন হয়ে পড়েছে ময়না, টিয়া, দোয়েল, শালিক, টুনটুনিসহ পাখির প্রায় সব প্রজাতি।

গবেষকদের মতে, মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণের কারণে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে প্রায় সব ধরনের পতঙ্গও। এর প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। কৃষি উৎপাদনে সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও করেছেন তাঁরা। তবে অত ওপরে ওড়ে না বলে মশা-মাছির ওপর এর প্রভাব পড়ে না।

সূত্র : পিটিআই