দৈর্ঘ্যের কথা ভেবে এখানে সব কটি পালারই অংশবিশেষ তুলে দেয়া হলো । এখানে পালাগুলি আংশিক দিলেও স্তবকগুলি পুরোপুরি দেওয়া হয়েছে। উত্স: সুখময় মুখোপাধ্যায় এবং সুখেন্দু শেখর গঙ্গোপাধ্যায় এর সম্পাদিত গন্থ “ময়মনসিংহ-গীতিকা” ।

মহুয়া
।। ১৬ ।।
প্রেমের জয়

পাষাণে বান্ধিয়া হিয়া বসিল শিওরে ।
নিদ্রা যায় নদীয়ার ঠাকুর হিজল গাছের তলে ।।
আশমানের চান্দ যেমন জমিনে পড়িয়া ।
নিদ্রা যায় নদীয়ার চান্ অচৈতন্য হইয়া ।।
একবার দুইবার তিনবার করি ।
উঠাইল নামাইল কন্যা বিষলক্ষের ছুরি ।।
“উঠ উঠ নদ্যাঠাকুর কত নিদ্রা যাও ।
অভাগী মহুয়া ডাকে আঁখি মেইল্যা চাও ।।
পাষাণ বাপে দিল ছুরি তোমায় মারিতে ।
কিরূপে বধিব তোমায় নাহি লয় চিতে ।।
পাষাণ আমার মা ও বাপ পাষাণ আমার হিয়া ।
কেমনে ঘরে যাইবাম ফিইরা তোমারে মারিয়া ।।

জ্বালিয়া ঘিয়ের বাতি ফু দিয়া নিবাই ।
তুমি বন্ধুরে আমার আর লইক্ষ্যা নাই ।।
তুমারে মারিয়া আমি কেমনে যাইবাম ঘরে ।
পাষাণ হইয়া মা ও বাপে বধিল আমারে ।।
কাজ নাই ভিন দেশী বন্ধুরে দুঃখ নাইরে করি ।
আমার বুকে মারবাম আমি এই বিষলক্ষ্যের ছুরি ।।”
কি কর কি কর কন্যা কি কর বসিয়া ।

কাঞ্চা ঘুম জাগে ঠাকুর স্বপন দেখিয়া ।।
শিওরে বসিয়া দেখে কান্দিছে সুন্দরী ।
হাতে তুইল্যা লইছে কন্যা বিষলক্ষ্যের ছুরি ।।
“শুন শুন ঠাকুর আরে শুন মোর কথা ।
কঠিন তোমার প্রাণ পিওয়া কঠিন মাতা পিতা ।।
শানে বান্ধা হিয়া আমার পাযাণে বান্ধা প্রাণ ।
তোমায় বধিতে বাপে করিল সইন্ধান ।।
হাতেত আছিল মোর বিষলক্ষের ছুরি ।
তোমারে ছাড়িয়া বন্ধু আমার বুকে মারি ।।
পালাইয়া মায়ের ধন নিজের দেশে যাও ।
সুন্দর নারী বিয়া কইরা সুখে বইসা খাও ।।
বরামনের পুত্র তুমি রাজার ছাওয়াল ।
তোমার সুখের ঘরে আমি হইলাম কাল ।।
কি করিতে কি করিলাম নাহি পাই দিশা ।

অরদিশ হইয়া আমি……………….।।

মাও ছাড়ছি বাপ ছাড়ছি ছাড়ছি জাতি কুল ।
ভমর হইলাম আমি তুমি বনের ফুল ।।
তোমার লাগিয়া কন্যা ফিরি দেশে বিদেশে ।
তোমারে ছাড়িয়া কন্যা আর না যাইবাম দেশে ।।
কি কইবাম বাপ মায়ে কেমনে যাইবাম ঘরে ।
জাতি নাশ করলাম কন্যা তোমারে পাইবার তরে ।।
তোমায় যদি না পাই কন্যা আর না যাইবাম বাড়ী ।

এই হাতে মার লো কন্যা আমার গলায় ছুরি ।।

“পইড়া থাকুক বাপ মাও পইড়া থাকুক ঘর ।
তোমারে লইয়া বন্ধু যাইবাম দেশান্তর ।।
দুই আঁখি যে দিগে যায় যাইবাম সেইখানে ।
আমার সঙ্গে চল বন্ধু যাইবাম গহীন বনে ।।
বাপের আছে তাজি ঘোড়া ঐ না নদীর পারে ।
দুইজনেতে উঠ্যা চল যাইগো দেশান্তরে ।।
না জানিবে বাপ মায় না জানিবে কেহ ।
চন্দ্র সূর্য সাক্ষী কইরা ছাইড়া যাইবাম দেশ ।।
আবে করে ঝিলিমিলি নদীর কুলে দিয়া ।
দুইজনে চলিল ভালা ঘোড়ায় সুয়ার হইয়া ।।
চান্দ সূরুজ যেন ঘোড়ায় চলিল ।
চাবুক খাইয়া ঘোড়া শণেতে উড়িল ।।

********************

কঙ্ক ও লীলা
।। ৮ ।।
গোপন দীক্ষা

জুহরী জহর চিনে বেনে চিনে সোনা ।
পীর প্যাগাম্বর চিনে সাধু কোন জনা ।।
পীরের অদ্ভুত কাণ্ড সকলি দেখিয়া ।
কঙ্কের পরাণ গেল মোহিত হইয়া ।।
সর্ব্বদা নিকটে কঙ্ক ভক্তিপূর্ণ মনে ।
চরণে লুটায় তার দেবতার জ্ঞানে ।।
তার পর জাতি ধর্ম সকলি ভুলিয়া ।
পীরের প্রসাদ খায় অমৃত বলিয়া ।।
দীক্ষিত হৈলা কঙ্ক যবন পীরের স্থানে ।
সর্ব্বনাশের কথা কঙ্ক কিছুই না জানে ।।
জাতি-ধর্ম নাশ হইল রটিল বদনাম ।
পীরের নিকটে কঙ্ক শিখিয়ে কালাম ।।
পীরের নিকটে যায় কেউ নাহি জানে ।
গতায়তি করে কঙ্ক অতি সংগোপনে ।।
ভক্তি-মুক্তি-তন্ত্র-মন্ত্র-দেহ মন প্রাণ ।
অচিরে গুরুর পদে কৈল সমর্পণ ।।
গুরুতে বিশ্বাস আর গুরু ইষ্ট ধন ।
দামোদর দাস কহে এই ভক্তের লক্ষণ ।।

**********************

কঙ্ক ও লীলা
।। ৯ ।।
সত্যপীরের পাঁচালী

দেখিয়া শুনিয়া পীর, কঙ্কেরে করিলা স্থির,
উপযুক্ত ভক্ত এহি জন ।
সত্যপীরের পাঁচালী, কঙ্কেরে লিখিতে বলি,
একদিন হৈল-অদর্শন ।।
গুরুর আদেশ মানি, লিখিয়া পাঁচালী আনি,
পাঠাইলা দেশে আর বিদেশে ।
কঙ্কের লিখন কথা, ব্যক্ত হৈল যথা তথা,
দেশ পূর্ণ হৈল তার যশে ।।
কঙ্ক আর রাখাল নহে, কবিকঙ্ক লোক কহে,
শুনি গর্গ ভাবে চমত্কার ।
হিন্দু আর মোসলমানে, সত্যপীরে উভে মানে,
পাঁচালীর হৈল সমাদর ।।
যেই পূজে সত্যপীরে, কঙ্কের পাঁচালী পড়ে,
দেশে দেশে কঙ্কের গুণ গায় ।
বুঝি কঙ্কের দিন ফেরে, রঘুসুত কহে ফেরে,
দুঃখিতের দুঃখ নাহি যায় ।।

*********************

কঙ্ক ও লীলা
।। ১০ ।।
কঙ্ককে জাতিতে তোলা

জানিয়া শুনিয়া কানে, ভাবে গর্গ মনে মনে,
নহে কঙ্ক সামান্য মানব ।
ভক্তিমান অতি ধীর, গর্গ কৈলা মনে স্থির,
কঙ্ক ঘরে তুলিয়া লইব ।।
পণ্ডিত সমাজী গণে, একত্র করিয়া ভণে,
“এই কঙ্ক ব্রাহ্মণ-তনয় ।
জ্ঞন মানে নাহি রয়, চণ্ডালের অন্ন খায়,
ঘরে নিতে নাহিক সংশয় ।।”
এতেক শুনিয়া নন্দু, আর যত গোড়াহিন্দু,
কয় সবে মাথা নাড়াইয়া ।
“আমরা সম্মত নহি, আরও শুন সবে কহি,
লহ কঙ্কে মোদের ছাড়িয়া ।।

জন্মিয়া চণ্ডালের অন্ন খায় যেই জন ।
যে তারে সমাজে তুলে নহে সে ব্রাহ্মণ ।।
অনাচারে জাতি নষ্ট, নষ্ট হয় কুল ।
মটিতে পড়িলে কেহ নাহি তুলে ফুল ।।”

আর এক দল ভয়ে গর্গে ডরাইয়া ।
গর্গের কথায় শুধু গেল সায় দিয়া ।।
আদেখা হইলে গর্গ করে কত ফন্দি ।
কঙ্কে না তুলিতে গর্গে করে অন্দি সন্দি ।।
কত তর্ক-যুক্তি গর্গ সকলে দেখায় ।
তবু নাহি সে বিধি দিল পণ্ডিতসভায় ।।
কেহ বলে তুলি ঘরে কেহ বলে নয় ।
এই মতে নানা স্থানে বহু তর্ক হয় ।।

চারি দিকে দাউ দাউ অনল জ্বলিল ।
জ্বলিলেন গর্গ মুনি কঙ্ক ভস্ম হইল ।।
এমন সুখের ঘর পুড়ে হল ছাই ।
নিয়তি খণ্ডিতে পারে হেন সাধ্য নাই ।।
আছিল চণ্ডাল কঙ্ক হইল ব্রাহ্মণ ।
কঙ্কেরে নাশিতে যুক্তি করে দ্বিজগণ ।।

*********************

কঙ্ক ও লীলা
।। ১১ ।।
কঙ্কের বিরূদ্ধে ব্রাহ্মণগণের ষড়যন্ত্র

নানামত ভাবি তারা উপায় করিল ।
মাপের চোখেতে যেন ধুলা-পড়া দিল ।।
রটে কঙ্ক নহে শুধু চণ্ডালের পুত ।
মোসলমান পীরের কাছে হৈল দীক্ষিত ।।
হিন্দু যত সবে কঙ্কে মোসলমান বলি ।
কেহ ছিড়ে কেহ পুড়ে সত্যের পাঁচালী ।।
জাতি গেল মোসলমানের পুঁথি নিয়া ঘরে ।
যথাবিধি সবে মিলি প্রায়শ্চিত্ত করে ।।

আর এক কথা রটে না যায় কথন ।
“কঙ্কেরে সঁপেছে লীলা জীবন-যৌবন ।।”
সন্ধ্যামন্ত্র নাহি ঝানে বেদাচারহীন ।
দুরন্ত দুর্জন যারা সমাজেতে ঘৃণ ।।
মদ্য-মাংস খায় সদ্য পাষণ্ড-আচার ।
জন্মি ব্রাহ্মণ-কুলে যত কুলাঙ্গার ।।
মিথ্যা বদনাম তারা দিল রটাইয়া ।
“কলঙ্কী হইয়াছে লীলা কুল ভাঙ্গাইয়া ।।”
একে ত কুমারী কন্যা অতি শুদ্ধমতী ।
কলঙ্ক রটাইল তার যত দুষ্টমতি ।।

*********************

কাজলরেখা
।। ১৪ ।।

বাপ মায়ের কথা, বংশের কথা না সুধাইয়াই, একমাত্র প্রাণ-দাতা বলিয়া রাজকুমার তাকে
বিয়া করতে প্রতিজ্ঞা করল ।

গান–

ঘরে আছিল ঘিরেত বাতি সদাই অগ্নি জ্বলে ।
তারে ছুইয়া কুমার পরতিজ্ঞ যে করে ।।

ঠিক এমন সময় ছান কইরা ভিজা কাপড়ে কাজলরেখা মন্দিরে প্রবেশ করল । ঢুইকাই দেখে যে
তার স্বামী বাঁইচ্যা উঠছে ।
গান–

গ্রহণ ছাড়িলে যেমন চান্দের প্রকাশ ।
কুমারে দেখিয়া কন্যা পাইল আশ্বাস ।।
প্রভাতের ভানু যিনি ছুরত সুন্দর ।
একে একে দেখে কন্যা সর্ব্ব কলেবর ।।
কন্যারে দেখিয়া কুমার লাগে চমত্কার ।
এমন নারীর রূপ না দেইখ্যাছে আর ।।
পরথম যৌবনে কন্যা হীরা-মতি জ্বলে ।
কন্যারে দেখিয়া কুমার কহে মিঠা বুলে ।।
“কোথা হতে আইলা কন্যা কি বা নম ধর ।
কিবা নাম বাপ মার কোন দেশে ঘর ।।
কিসের লাগিয়া কন্যা ভ্রম বনে বনে ।
স্বরূপ উত্তর দাও এই অভাজনে ।।
মাও ত নিঠুরা তোমার বাপ ত নিঠুর ।
ঘরের বাইর কইরা তোমায় দিল বনান্তর ।।”
আগু হইয়া পরিচয় কহে কঙ্কণ দাসী ।
“কঙ্কণে কিন্যাছি ধাই নাম কাঙ্কণ দাসী ।”

রাণী হইল দাসী আর দাসী হইল রাণী ।
কর্মদোষে কাজলরেখা জন্ম-অভাগিনী ।।

সন্ন্যাসীর আদেশ মতে কাজলরেখা স্বামীর নিকট আত্ম-পরিচয় দিতে পারিল না । স্বামীর সঙ্গে
দাসী হইয়াই স্বামীর রাজ্যে চলিয়া গেল ।

************************

চন্দ্রাবতী
।। ১ ।।
ফুল-তোলা

“চাইরকোণা পুস্কুনির পারে চম্পা নাগেশ্বর ।
ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর ।।”
“আমার বাড়ী তোমার বাড়ী ঐ না ঐ না নদীর পার ।
কি কারণে তুল কন্যা মালতীর হার ।।”

“প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে ।
বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে ।।”

বাছ্যা বাছ্যা ফুল তুলে রক্তজবা সারি ।
জয়ানন্দ তুলে ফুল ঐ না সাজি ভরি ।।
জবা তুলে চম্পা তুলে গেন্দা নানাজাতি ।
বাছিয়া বাছিয়া তুলে মল্লিকা মালতী ।।
তুলিল অপরাজিতা আতসি সুন্দর ।
ফুলতুলা হইল শেষ আনন্দ অন্তর ।।
এক দুই তিন করি ক্রমে দিন যায় ।
সকালসন্ধ্যা ফুল তলে কেউ না দেখতে পায় ।।
ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ানন্দ সাথী ।
তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী ।।
একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায় ।
সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায় ।।

**********************

চন্দ্রাবতী
।। ২ ।।
প্রেম-লিপি

পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে ।
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে ।।
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা ।
“নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা ।।
তোমার গাঁথা মালা লইয়া কন্যা কান্দিলো বিরলে ।
পুষ্প বন অন্ধকার তুমি চল্যা গেলে ।।
কইতে গেলে মনের কথা কইতে না জুয়ায় ।
সকল কথা তোমার কাছে কইতে কন্যা দায় ।।
আচারি তোমার বাপ ধর্ম্মে কর্ম্মে মতি ।
প্রাণের দোসর তার তুমি চন্দ্রাবতী ।।
মাও নাই বাপ নাই থাকি মামার বাড়ী ।
তোমার কাছে মনের কথা কইতে নাহি পারি ।।
যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমাল চান্দবদন ।
সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন ।।
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই ।
সর্ব্বস্ব বিকাইলাম পায় তোমারে যদি পাই ।।
আজি হতে ফুল তোলা সাঙ্গ যে করিয়া ।
দেশান্তরি হইব ক্ন্যা বিদায়ে লইয়া ।।
তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দেও ভর ।
যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিঙ্কর ।।”

***********************

চন্দ্রাবতী
।। ১০ ।।
দুঃসংবাদ

ঢুল বাজে ডাগর বাজে জয়াদি জুকার ।
মালা গাথে কুলের নারী মঙ্গল আচার ।।
এমন কালে দৈবেতে করিল কোন কাম ।
পাপেতে ডুবাইল নাগর চৈদ্দ পুরুষের নাম ।।
কি হইল কি হইল কথা নানান জনে কয় ।
এই যে লোকের কথা প্রত্বয় না হয় ।।
পুরীতে জুড়িয়া উঠে কান্দনের রোল ।
জাতিনাশ দেখ্যা ঠাকুর হইল উতরুল ।।
“কপালের দোষ, দোষ নহে বিধাতার ।
যে লেখা লেখ্যাছে বিধি কপালে আমার ।।
মুনির হইল মতিভ্রম হাতীর খসে পা ।
ঘাটে আস্যা বিনা ঝড়ে ডুবে সাধুর না ।।
পাড়া পড়সি কয়, ঠাকুর কইতে না জুয়ায় ।
কি দিব কন্যার বিয়া, ঘটল বিষম দায় ।।
অনাচার কৈল জামাই অতি দুরাচার ।
যবনী করিয়া বিয়া জাতি কৈল মার ।।”

শিরেতে পড়িল বাজ মঠের মাথায় ফোড় ।
পুরীর যত বাদ্যভাণ্ড সব হৈল দূর ।।
ধূলায় বসিল ঠাকুর শিরে দিয়ে হাত ।
বিনা মেঘে হইল যেন শিরে বজ্রাঘাত ।।

**********************

চন্দ্রাবতী
।। ১১ ।।
চন্দ্রার অবস্থা

“কি কর লো চন্দ্রাবতী ঘরেতে বসিয়া ।”
সখিগণ কয় কথা নিকটে আসিয়া ।।
শিরে হাত দিয়া সবে জুড়য়ে কান্দন ।
শুনিয়া হইল চন্দ্রা পাথর যেমন ।।
না কান্দে না হাসে চন্দ্রা নাহি বলে বাণী ।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী ।।
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে ।
জানিতে না দেয় কন্যা জল্যা মরা মনে ।।

এক দিন দুই দিন তিন দিন যায় ।
পাতেতে রাখিয়া কন্যা কিছু নাহি খায় ।।
রাত্রিকালে শর-শয্যা বহে চক্ষের পানি ।
বালিস ভিজিয়া ভিজে নেতের বিছানি ।।
শৈশবের যত কথা আর ফুল তুলা ।
নদীর কুলেতে গিয়ে করে জলখেলা ।।
সেই হাসি সেই কথা সদা পড়ে মনে ।
ঘুমাইলে দেখিব কন্যা তাহারে স্বপনে ।।
নয়নে না আসে নিদ্রা অঘুমে রজনী ।
ভোর হইতে উঠে কন্যা যেন পাগলিনী ।।
বাপেত বুঝিল তবে কন্যার মনের কথা ।
কন্যার লাগিয়া বাপের হইল মমতা ।।
সম্বন্ধ আসিল বড় নানা দেশ হইতে ।
একে একে বংশিদাস লাগে বিচারিতে ।।

চন্দ্রাবতী বলে “পিতা মম বাক্য ধর ।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর ।।
শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি ।
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি ।।”
অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে ।
“শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে ।।”

*********************

কমলা
।। ৩ ।।
কমলা–যৌবনাগমে

দেখিতে সুন্দরী কন্যা পরথম যৌবন ।
কিঞ্চিত্ করিব তার রূপের বর্ণন ।।
চান্দের সমান মুখ করে ঝলমল ।
সিন্দুরে রাঙ্গিয়া ঠুট তেলাকুচ ফল ।।
জিনিয়া অপরাজিতা শোভে দুই আখি ।
ভ্রমরা উড়িয়া আসে সেই রূপ দেখি ।।
দেখিতে রামের ধনু কন্যার যুগল ভুরু ।
মুষ্টিতে ধরিতে পারি কটিখানা সরু ।।
কাকুনি সুপারি গাছ বায়ে যেন হেলে ।
চলিতে ফিরিতে কন্যা যৌবন পরে ঢলে ।।
আষাঢ় মাস্যা বাশের কেরুল মাটি ফাট্যা উঠে ।
সেই মত পাও দুইখানি গজন্দমে হাটে ।।
বেলাইনে বেলিয়া তুলিছে দুই বাহুলতা ।
কণ্ঠেতে লুকাইয়া তার কোকিলে কয় কথা।।
শ্রাবণ মাসেতে যেন কাল মেঘ সাজে ।
দাগল-দীঘল কেশ বায়েতে বিরাজে ।।
কখন খোপা বান্ধে কন্যা কখন বান্দে বেণী ।
কূপে রঙ্গে সাজে কন্যা মদনমোহিনী ।।
অগ্নি-পাটের শাড়ী কন্যা যখন নাকি পরে ।
স্বর্গের তারা লাজ পায় দেখিয়া কন্যারে ।।
আযাইঢ়া জোয়ারে জল যৌবন দেখিলে ।
পুরুষ দূরের কথা নারী যায় ভুলে ।।

*********************

দেওয়ান ভাবনা
।। ৩ ।।

গাঁথ গাঁথ সুন্দর কন্যালো মালতীর মালা ।
ঝইরা পড়ছে সোনার বকুল গো ঐনা গাছের তলা ।।
তোমার বিয়ার ঘটক আইছে লো কালুকা বিহানে ।
কেমন করে দিব বিয়াগো ভাবে মনে মনে ।।
বরমা যে লেখ্যাছে কলমরে কপালে তোমার ।
ভাবিয়া চিন্তিয়া মায় দেখে অন্ধকার ।।
এইতনা ঘটক ফির্ য়া গেলগো পছন্দ না হয় ।
চান্দের সমান কন্যাগো বর যে কালা হয় ।।

এই ঘটক ফির্ য়া গেলরে আর ঘটক আইল ।
সোনাইর বিয়া দিতে মায়ের গো মন না উঠিল ।।
যেমন সুন্দর কইন্যা গো তেমন না আইল বর ।
তার মধ্যা থাকব জামাইর বারবাংলার ঘর ।।
সোনার কার্ত্তিক অইবো জামাই গো যেমন চান্দের ছটা ।
কুলে শীলে বংশে ভালা গো জমিদারের বেটা ।।
যতেক সম্বন্ধ আইল গো সোনাইর মায়ে নাই সে বাসে ।
এহি মতে আইল ঘটক পরতি মাসে মাসে ।।

*********************

দেওয়ানা মদিনা বা আলাল দুলালের পালা
।। ২ ।।

আওরতের লাগ্যা কান্দে দেওয়ান সোনাফর ।
আলাল দুলাল কাইন্দা অইল জর্ জর্ ।।
কান্দিয়া কান্দিয়া তারা ভূমিতে লুটায় ।
দানা পানি ছাড়্যা কেবল করে হায় হায় ।।
মায়ের জানে পুতের বেদন অন্যে জান্ ব কি ।
মায়ের বুকের লৌ পুত্র আর ঝি ।।
দুই না ছেউরা ছাওয়ালে বুকেতে করিয়া ।
সোনাফর মিঞা কান্দে মাথা থাপাইয়া ।।
দুধের ছাওয়ালে কেমনে বাঁচাই পরাণে ।
অনাধারে মরে কেমনে দেখিব নয়ানে ।।
মা মা বল্যা যখন আরে আলাল দুলাল কান্দে ।
বুকেতে আমার হয়রে ছেল যেমন বিন্ধে ।।
কি দিয়া বুঝাইয়া রাখি চেউড়া পুত্রেরে ।
কে বা খাওন দেয় আরে পরিলাম ফেরে ।।
মর্ য়াত না গেছ আওরাত গিয়াছ মারিয়া ।
তিনলা পরাণি মার্ য়া গেছ পলাইয়া ।।
কি দুষ্মনি কইর্ য়াছিলাম আর জনমে আমি ।
তার পর্ তিশোধ লইয়া এই না জন্মে তুমি ।।
বান্যাচঙ্গের দেওয়ান আমি নাহি মোর সমান ।
অদুন্যাই ধন দৌলত গোলাভরা ধান ।।
পন্থের ফকির অইল আরে আমার থাক্যা সুখী ।
দুনিয়াতে নাই আর আমার মত দুখী ।।
কি করিব ধন দৌলতে আর কি ছার দেওয়ানি ।
দিলের দুঃখেতে যদি চক্ষে ঝরে পানি ।।
কেবা খাইব আমার যে এই ধন দৌলত ।
শূণ্য অইল ঘর মোর মরিয়া আওরাত ।।
বুকে ছেল দিয়া গেলা তুমি কোন্ পরাণে ।
দুনিয়া যে দেখি আমি আন্ধাইর নয়ানে ।।
তুমি যে আছিলা আন্ধাইর ঘরের বাতি ।
তুমি যে আছিলা আমার হৃদ-পিঞ্জরার পংখী ।।
তোমারে ছাড়িয়া আমি বাঁচি কোন পরাণে ।
তেজিতাম পরাণি আমি তোমার কারণে ।।
তোমার পিছ লইতাম আমি এই আছিল মনে ।
দুধের বাচ্চা রাইখ্যা গিয়া ফালাইলা বে-নালে ।।
এইনা কানেদে দেওয়ান আরে বুক না কুটিয়া ।
পাড়া পরশী পরা’ব পাইল তারে না বোঝাইয়া ।।
ঘর খালি অইল আর গুরজান না চলে ।
সোনার সংসার বের্ত্তা হায়রে যায় যে বিফলে ।।
ঘরের লক্ষ্মী জননা আরে তার যে লাগিয়া ।
বান্ধা সংসার মিঞার যায় যে ভাসিয়া ।।
দিবা নিশি চিন্তে মিঞার দুঃখ অইল দিলে ।
দরবার বিচার হায়রে কিছু না চলে ।।
কিসের সংসার কিসের বাস কেমনে সুখ মিলে ।
মনসুর বয়াতি কয় সুখ না থাকলে দিলে ।।

উজীর নাজীর সবে আরে এই না দেখিয়া ।
মিয়ার নিকট কয় দরশন দিয়া ।।
“শুন্ খাইন দেওয়ান সাহেব শুন্ খাইন আমার কথা ।
সোনার সংসার আপনারে নষ্ট অইল বির্থা ।।
আর এক সংসার কর্ য়া রাখ্যুয়াইন দেওয়ানি বজায় ।
এক জনের লাগ্যা কেন সগল জলে যায় ।।”
কান্দিয়া দেওয়ান কয় আরে উজীরে নাজীরে ।
“দুধের বাচ্চা আলাল দুলাল আছে মোর ঘরে ।।
তারার দুঃখ দেখ্যা আমার ফাট্যা যায় বুক ।
সাদি করিলে অইব দুঃখের উপর দুখ ।।
সতাই না বুঝে সতীন-পুতের বেদন ।
সতির-পুতে দেখে সতাই কাঁটার সমান ।।
সেই কাঁটা তুইল্যা সতাই দূরেতে ফালায় ।
এরে দেখ্যা মন নাই সে সাদি করতে চায় ।।
কলিজার লৌ মোর আলাল দুলাল ।
দুঃখের উপর দুঃখ দিয়া না বাড়াই জঞ্জাল ।।
আলাল দুলালে বিবি আমায় সপ্যা দিয়া ।
সাদি না করিতে গেল মানা যে করিয়া ।।
বিয়া নাই সে করবাম আমি সংসারের লাগিয়া ।
কিসের সংসার আলাল দুলালে মারিয়া ।।
তারা মুখ দেখ্যা আছি আরে বাঁচিয়া পরাণে ।
রাক্ষসের হাতে নাই সে দিবাম জীবমানে ।।

এই কথা শুনিয়া উজার কয় মিঞার কাছে ।
কান্দিয়া কাটিয়া সাহেব ফয়দা নাই সে আছে ।।
সতাই সকল সাহেব আরে না হয় সমান ।
সতীন্ পুতের লাগ্যা কেউ দেয় জান পরাণ ।।
আলাল দুলালে যতন করিবাম সকলে ।
দুঃখ নাই সে পাইব কিছু সতাই বাদী অইলে ।।
দিলের দুঃখ দূর কইরা কর্ খাইন এক বিয়া ।
সোনার সংসার পাল্ খাইন যতন করিয়া ।।

এই কথা শুনিয়া মিয়া চিন্তে মনে মনে ।
কিছু ফয়দা নাই মোর সংসার ছাড়নে ।।
সোনার কলি আলাল দুলাল রহিলে বাঁচিয়া ।
সংসার না থাকলে তারা খাইব করিয়া ।।
সংসার নষ্ট অইলে পরে অইব তারার দুঃখ ।
চিরদিন দুঃখে হায় ফাটিব যে বুক ।।
আমার বুকের ধন রাখবাম যতন করিয়া ।
কি সাধ্য সতাই নেয় তারারে কাড়িয়া ।।
এই মতে দেওয়ান আরে চিন্তে মনে মনে ।
উজীর নাজীর লাগা পাছে বিয়ার কারণে ।।
মনস্থির কইরা দেওয়ান অইলা সম্মত ।
সাদি অইলা গেল পরে যেমন বিহিত ।।

*********************


রূপবতী
।। ১ ।।

রাজ্য করে রাজচন্দ্র রামপুর শহরে ।
বারবাংলার ঘর বান্ ছে ফুলেশ্বরীর পারে ।।
গড় খন্দর রাজার লাখের জমিদারী ।
হস্তি ঘোড়া আছে রাজার পাইক পটুয়ারী ।।
ঢুলী নাগারচী রাজার রাজ্যে বাস করে ।
রসুনচকি বাজায় তারা হাফার খানা ঘরে ।।
সেইত গীত না শুনিয়া রাজা জাগে বিয়ান বেলা ।
দরবারে বসিল রাজা সহিত আমলা ।।
সভাজনেরে রাজা ডাক দিয়া কয় ।
“নবাবের দরবারে যাইতে উচিত যে বোধ হয় ।।”

গণকে ডাকিয়া রাজা দিন স্থির করে ।
অষ্ট দিন বাকি আছে যাইতে নবাবের সরে ।।
কানা চইতা উভুতিয়া তারা দুইটি ভাই ।
পানসী সাজাইতে তারা পাইল ফরমাই ।।
ষোল দাঁড় জুইত করে আরও তুলে পাল ।
পানসীতে ভরিয়া রাজা তুলে মালামাল ।।
আবের কাঁকই লইল রাজা আবের চিরুনী ।
আবেতে রাঙ্গিয়া লইল খাড়ি আর বিউনী ।।

হাত্তির দাঁতের পাটি লইল গজমতি মালা ।
ভেট দিতে নবাবের করিল যে মেলা ।।
খাজনা উগাইয়া তঙ্কা লইল দশ হাজার ।
গাউইয়া বাজুইয়া লইল সঙ্গে এক ঝাড় ।।

উজান পানি বাইয়া রাজা পানসী বাইয়া যায় ।
নাগরীয়া যত লোক করিল বিদায় ।।
দানদক্ষিণা আদি পূণ্যকার্য করি ।
রাণীর কাছে সঁপিয়া গেল কুলের কুমারী ।।

চারিদিকে নানা গ্রাম নেহালিয়া দেখে ।
ফুলেশ্বরী উথারিয়া পড়ে নরসুন্দার মুখে ।।
সেই নদী ছড়াইয়া যায় ঘোড়া-উত্রা বাইয়া ।
মেঘনা সায়রে পানসী চলিল ভাসিয়া ।।
ঢেউয়ের করে বাইড়াবাইড়ি কাছাড় ভাইঙ্গা পড়ে ।
এই মতে যার রাজা নবাবের সরে ।।

তিন মাসথাক্যা রাজা জলের উপর ।
চাইর মাসে গেল রাজা নবাবের সর ।।
সঙ্গের যতেক দ্রব্য যত লোকজনে ।
একে একে ভেট দিল নবাবের স্থানে ।।
পূবইয়া আবের কাকই আবের চিরুনী ।
চক্ষে না দেখেছি শুধু লোকমুখে শুনি ।।
শীতল পাটি পাইয়া তবে শিতল হইল মন ।
পাইল ভেটের দ্রব্য যত আয়োজন ।।
দশ হাজার তঙ্কা পাইয়া খুসী হইল মিঞা ।
রাজচন্দ্রে দিলা ঘর বাছাই করিয়া ।।

নবাবের সরে রাজা আছে খুসী মন ।
ঘরেতে থাকিয়া রাণী দেখিল স্বপন ।।

*********************