১৭৮৭ সালের কথা। সে বছর হিমালয়ে প্রবল বর্ষণের ফলে ভীষণ বন্যা দেখা দিল। সেই বন্যা ছিল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। হিমালয় ও তার সংলগ্ন এলাকায় ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হলো। বিশেষ করে, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তায় এর প্রভাব পড়ল মারাত্মকভাবে।

ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয়ের কৈলাস শৃঙ্গের হিমবাহ থেকে। নানা জায়গা ঘুরে আসামের ধুবড়ি থানার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ধানীরামপুর দিয়ে তা বাংলাদেশে ঢুকেছে।এই নদের আদিখাত ওই মহাবন্যার আগে,বাহাদুরাবাদের উত্তর হয়ে জামালপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতো। তবে ওই বন্যার প্রবল জলরাশির চাপ তাকে পশ্চিম-দক্ষিণমুখী করে। তিস্তা নদীর গতিপথেও বিরাট পরিবর্তন আনল ওই বন্যা।

শুধু তা-ই নয়, করতোয়া ও আত্রাইয়ের যে ক্রমবিলীয়মান হাল তারও মূল কারণ কিন্তু ওই মহাপ্লাবন। বৃহত্তর রংপুরের কোথাও কোথাও করতোয়ার নাম বুড়ি তিস্তা বা পুরাতন তিস্তা। আত্রাই-করতোয়ার মৃত্যুর কারণ যে তিস্তার পথ-পরিবর্তন এবং তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত ধারাই যে যমুনা—এ সম্পর্কে নীহার রঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস: আদিপত্র গ্রন্থের ৮৯ পৃষ্ঠা (২০০১ সংস্করণ) ও রংপুর জেলা গেজেটিয়ার (১৯৯০) এর ৪ ও ৫ পৃষ্ঠায় যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।

মূল ব্রহ্মপুত্র যেখান থেকে পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে তার দক্ষিণ থেকে এর নাম হয়েছে যমুনা। গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ির কাছে তিস্তার ধারা এসে মিলেছে ব্রহ্মপুত্রের নতুন ধারার সঙ্গে। সেই থেকে যমুনা প্রবল ও বিশাল নদীর রূপ ধরে গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলাকে স্পর্শ করে ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দের কাছে পদ্মায় গিয়ে পড়েছে।

১৭৮৭ সালের মহাবন্যার আগে যে যমুনার সৃষ্টি হয়নি তার প্রমাণ হলো জে রেনেলেসহ পূর্ববর্তী কোনো মানচিত্রে এই প্রমত্তা নদী নেই। যে-কেউ সেই মানচিত্র অনুসন্ধান করলেই দেখবেন, এই অন্যতম প্রধান নদীর অস্তিত্ব তখন ছিল না। তবে এই নদী এখন এক প্রবল বাস্তবতা। বাঙালি জাতির পরিচয়ের অন্যতম স্মারক। সে কারণেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালির অন্যতম প্রধান স্লোগান ছিল ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।’

-লিখেছেনখন্দকার মাহমুদুল হাসান