ছেলেবেলায় গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে এই ফুল প্রথম দেখি। না দেখেও কোনো উপায় ছিল না; কারণ বিশাল দিঘিভর্তি নীলচে বেগুনি রঙের ফুলগুলো যেন আকাশকে নিচে নামিয়ে এনেছে। এর পরে এই ফুলের এত বিশাল সমারোহ আর কোথাও চোখে পড়েনি। আমরা যাঁর সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, তিনি বললেন, ‘এই ফুলের নাম কচুরিপানা’। কিন্তু আমাদের চারপাশের খালবিলে কচুরিপানা নামে যে বেগুনি রঙের আরেকটি সুদর্শন ফুল ফোটে! তাহলে কি দুই ফুলের এক নাম?এমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই কেটে গেল অনেক বছর। মাত্র কয়েক বছর আগে নওয়াজেশ আহমদের বাংলার বনফুল বইটি পড়ে এই সমস্যার গিঁট খুলল। তিনি এই ফুলকে‘বড়নখা’ (Monochoria hastata) বা ‘ছোট পানা’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আদতেও তাই বেগুনি রঙের অবারিত ও মুক্ত পাপড়ির ফুলগুলোর নাম কচুরিপানা। জন্মস্থান সুদূর ব্রাজিল। আর আলোচ্য বড়নখা বাংলাদেশ-ভারতের প্রজাতি। জন্মস্থান আলাদা হলেও দুটি একই পরিবারের গাছ।
কচুরিপানা সর্বত্র সহজলভ্য হলেও বড়নখা কিছু নির্দিষ্ট স্থানেই দেখা যায়। গত এক দশকে তুলনামূলকভাবে কম দেখা গেলেও ইদানীং পরিত্যক্ত ডোবা ও অগভীর জলাশয়ে মোটামুটি সহজলভ্য। ঢাকার আশপাশের জলাশয়গুলোতেও চোখে পড়ে।মাটির কাছাকাছি থাকতেই পছন্দ, আবার নরম কাদামাটিতেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মণপুর গ্রাম থেকে বড়নখার এই ছবিগুলো তুলেছি। তখন ভোরের বাতাসে বিচিত্র জলজ ফুলের মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছিল চারপাশে।
একটি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে এই ফুলকে বিপদাপন্ন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। বড়নখা মূলত বায়বীয় কাণ্ডের জলজ বীরু ৎ শ্রেণীর গাছ, শূন্য দশমিক ৭ থেকে ১ দশমিক ২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গাছের একক পাতাটি বর্শাফলাকৃতির। ছয় থেকে নয় সেন্টিমিটার দীর্ঘ মঞ্জরিদণ্ডের মাথায় একসঙ্গে ২৫ থেকে ৬০টি ফুলের একটি স্তবক থাকে। সব কটি ফুল মিলিয়ে একটি বড় আকৃতির ফুলের মতো। প্রতিটি ফুল ১৩ থেকে ১৬ মিলিমিটার লম্বা হতে পারে, দেখতে সাদাটে বা রক্তবেগুনি।
একটি পরাগধানীর রং নীল, ছয় মিলিমিটার লম্বা; অন্য পাঁচটি পরাগধানী হলুদ রঙের, চার মিলিমিটার লম্বা। ক্যাপসুল আকৃতির বীজগুলো সাত মিলিমিটার লম্বা। আমাদের দেশে ফুল ফোটার প্রধান মৌসুম গ্রীষ্ম থেকে হেমন্ত পর্যন্ত। বড়নখা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ অস্ট্রেলিয়ায়ও দেখা যায়। এরা কচুরিপানার মতো গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য। তা ছাড়া দাঁতের ব্যথায় শিকড়ের রস এবং হাঁপানি রোগে কাণ্ডের ছাল বেশ ফলদায়ক।
-Prothom Alo
You must log in to post a comment.