গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা ও সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে ইউনিপেটুইউ’র (বাংলাদেশ) এজেন্টদের কমপক্ষে ২০০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে কোন টাকা তুলতে দেওয়া হচ্ছে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হওয়ার পর থেকে গ্রাহকদেরও টাকা দেওয়া বন্ধ রেখেছে ইউনিপেটুইউ। ইউনিপেটুইউ বলছে, এজেন্টদের অ্যাকাউন্ট চালু না করা পর্যন্ত গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। এর ফলে অন্তত পাঁচ হাজার গ্রাহকের কিস্তির টাকা পাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রাহককদের টাকা ইউনিপেটুইউ’র মূল তিনটি অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে এজেন্টদের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার মাধ্যমে আত্মসাত করা হচ্ছে –এমন অভিযোগ পেয়েই অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করার পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বৃহস্পতিবার বিকালে অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়েছে বলে বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এ সকল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গ্রাহকদের কত কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। দুদকও এ বিষয়ে তদন্তে নেমেছে বলে জানা গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে কি পরিমাণ লেনদেন হয়েছে, সেখান থেকে কারা কারা টাকা তুলে নিয়েছেন এবং টাকা নেওয়ার মধ্যে ইউনিপেটু ইউ’র ম্যানেজমেন্টের কেউ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে দুদক। ইউনিপেটুইউ’র ম্যানেজার অপারেশনস মালিক হাসান নোমান এজেন্টদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার বিষয়টি স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই এজেন্টদের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের কোন চিঠি দেয়নি। শুধু মৌখিকভাবে তাদের লেনদেন বন্ধ করার কথা জানানো হয়েছে। ইউনিপেটুইউ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহে এজেন্টদের যে সব অ্যাকাউন্ট থেকে গ্রাহকদের কিস্তির টাকা পরিশোধের কথা ছিল সেসব অ্যাকাউন্টই জব্দ করা হয়েছে। ইউনিপেটু ইউ’র ওয়েবসাইটে অনিবার্যকারণে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনে (ব্যাংকের মাধ্যমে কিস্তির টাকা পরিশোধ) বিলম্ব হওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মালিক হাসান নোমান বলেন, ব্যাংকে আমাদের চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় এ বিলম্ব হচ্ছে। এখন টাকা তুলতে না দেওয়া পর্যন্ত গ্রাহকের টাকা পরিশোধও সম্ভব নয়। অ্যাকাউন্ট চালু হলেই কিস্তির টাকা পরিশোধ শুরু হবে। ইউনিপেটুইউ’র শীর্ষস্থানীয় এজেন্ট এস কে সাহা ও আশরাফুল হক বাংলানিউজকে বলেন, এসব অ্যাকাউন্ট জব্দ করার কারণে কমপক্ষে পাঁচ হাজার গ্রাহক তাদের কিস্তির টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। ইউনিপেটুইউ’র শীর্ষ কর্মকর্তারা এজেন্টদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা নিজেদের পকেটস্থ করছেন– এমন অভিযোগ কিছু দিন ধরেই আসছে। প্রসঙ্গত গত বছরের ১৩ মে ইউনিপেটুইউ বাংলাদেশ লিমিটেড এবং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুনতাসির হুসেইন ইমন, পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান, পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান, এদের নামে বা স্বাক্ষরে পরিচালিত মোট নয়টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে আদালতের রায়ে ইউনিপেটুইউ’র নামে পরিচালিত দি সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংকের তিনটি অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়। আদালতের রায় অনুযায়ী এ তিনটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ইউনিপেটুইউ’র সব লেনদেন করার কথা। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য ইউনিপেটুইউ মাসে তিন কোটি উত্তোলন করতে পারতো। কিন্তু আদালতের রায়কে পাশ কাটিয়ে ইউনিপেটুইউ’র এজেন্টের নামে অসংখ্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। অভিযোগ উঠেছে, গ্রাহকদের বিনিয়োগের টাকা মূল তিনটি অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে এসব অ্যাকাউন্টে রাখা হচ্ছিল। ইউনিপেটুইউ’র শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা এজেন্টদের সহায়তায় এসব অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নিতেন। একজন বিনিয়োগকারী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা এজেন্টকে টাকা দিতাম। আমাদের বলা হতো এজেন্ট অনেক গ্রাহকের টাকা একসঙ্গে তার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মূল অ্যাকাউন্টে জমা দেন। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা আমরা জানি না। এখন বৃহস্পতিবার থেকে আমাদের কিস্তির টাকা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’ টাকা উত্তোলন বন্ধ থাকায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উত্তেজনা এবং সর্বস্ব হারানোর দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে বলেও তিনি জানান। এজেন্টদের অ্যাকাউন্ট জব্দ করার উপরও ভরসা পাচ্ছেন না ওই বিনিয়োগকারী। তিনি বলেন, ‘শত শত বিনিয়োগকারী যখন ইউনিপেটুইউ’র ফাঁদে আটকে গেছে। অথচ এতদিন এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে তা বাংলাদেশ ব্যাংক বা দুদক দেখেনি।’ সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ইউনিপেটুইউ’র শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসীর হুসেইন ইমন, পরিচালক মোঃ মাসুদুর রহমান, পরিচালক মো. সাইদুজ্জামানের নামে ও স্বাক্ষরে ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ হওয়ায় এবং মূল তিনটি একাউন্ট থেকে তিন কোটির বেশি টাকা উত্তোলন করতে না পেরে প্রতারণার নতুন ফন্দি বের করে। এর অংশ হিসাবে প্রাথমিকভাবে নিজেদের বিশ্বস্ত এজেন্টদের নামে পৃথক পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেগুলোর মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা সরিয়ে ফেলেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। এরপর সব এজেন্টের নামে পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। গত ৭ মাস ধরে ইউনিপেটুইউ বাংলাদেশ নামে খোলা অ্যাকাউন্টে সব টাকা জমা না করে প্রচুর টাকা এজেন্টদের অ্যাকাউন্টগুলোতে জমা করে আসছে। তবে জব্দ করা ২০০ জন এজেন্টের অ্যাকাউন্ট ছাড়াও রাজধানীতে আরও অনেক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এছাড়া দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতেও এজেন্টদের নামেও অ্যাকাউন্ট রয়েছে। গ্রাহকদের নামে স্বর্ণ কেনা হয়, ১০ মাসে বিনিয়োগের টাকা দ্বিগুণ হিসাবে ফেরত দেওয়া হয় এসব অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে হাজার হাজার গ্রাহক থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কাজেই এসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আসছে ইউনিপেটুইউ। একবার বিনিয়োগ করার পর সে টাকা ১০ মাসের আগে কোনোভাবেই ফেরত পায়না গ্রাহক। তাছাড়া স্বর্ণ কেনারও কোন প্রমাণ দেওয়া হয় না গ্রাহকদের। টাকা জমা দেওয়ার পর গ্রাহককে ইন্টারনেটের মাধ্যমে শুধু একটি ফরম দেওয়া হয় যাতে স্বর্ণ কেনার কথা উল্লেখ থাকে।

* লভ্যাংশ ৬গুণ কমিয়ে দিয়েছে ইউনিপেটুইউ *

ইউনিপেটুইউ’র বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রুল জারি *

এমএলএম-এ বিনিয়োগকারীদের সংবাদ সম্মেলনে হট্টগোল, হাতাহাতি *

ইউনিপেটুইউ’র সঙ্গে লেনদেনে সতর্ক থাকার পরামর্শ বাংলাদেশ ব্যাংকের *

ইউনিপেটুইউ: সিলেটে গা বাঁচাতে মরিয়া গণ্যমান্যরা *

সিলেটে ইউনিপেটুইউ’র প্রতারণায় পুলিশি তদন্ত শুরু *

সিলেটজুড়ে ইউনিপেটুইউ’র ডিজিটাল প্রতারণা *

‘ইউনিপে-জ্বরে কাঁপছে সিলেট

সাঈদুর রহমান রিমন/জসীম উদ্দিন
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম