নারীদের ঐতিহ্যবাহী ও নিত্যনৈমিত্তিক পরিধেয় বস্ত্র শাড়ি। এই পোশাকটির সঙ্গে বাঙালিয়ানার টান রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাধারণত শাড়িকে সবচেয়ে উপযোগী পোশাক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সামনেই ঈদ। পছন্দের তালিকায় শাড়ির স্থান সবার ওপরে। এবারের ঈদে নানা ডিজাইনের লাল কাপড়ের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। আর আমরা সচরাচর শাড়ি না পরলেও ঈদ বা কোনো অনুষ্ঠানে শাড়িকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কে-কদ্ধ্যাফটের ডিজাইনার শাহনাজ খান বলেন, যে কোনো উৎসব-আয়োজনে শাড়ি খুব বড় একটা বিষয়। আর এ কথা ভেবে প্রতিবারই আমাদের ঈদ আয়োজনে বিভিন্ন ডিজাইনের বিভিন্ন কাপড়ের ও নানা রেঞ্জের শাড়ি থাকে, যাতে মানুষ তার সাধ্য ও পছন্দ অনুযায়ী যা চায় তা-ই পায়। তিনি আরও বলেন, শুধু বুননের পরিবর্তনের কারণে এসব শাড়ি ৪ থেকে ৫ ধরনের রেঞ্জের হয়ে থাকে। সুতির মধ্যে টাঙ্গাইলের শাড়িতে কাঁথা, এপ্লিক ও কারচুপির কাজ করা হয়েছে। তাঁতের ডিজাইনের শাড়িতে ব্লক ও স্ক্রিনপ্রিন্ট করা হয়েছে। আরেক ধরনের শাড়ি হচ্ছে হাফসিল্ক যার টানায় সিল্ক আর ভরনাতে সুতি, হাফসিল্ক বহু বছর ধরে জনপ্রিয়। এছাড়া এন্ডি সুতা মিক্সড করা শাড়িতে এপ্লিক, মেশিনের এমব্রয়ডারি ও কারচুপির কাজ করা হয়েছে। আর পার্টিতে পরার জন্য রাজশাহী সিল্ক ও মসলিন তো রয়েছেই। ঈদের সময় সারাদিন সুতি পরলেও রাতে একটু জমকালো লুকের প্রয়োজন রয়েছে। এসব শাড়িতে নিজস্ব ডিজাইন থেকে বুনন পরিবর্তন করা হয়। এরপর তাতে বিভিন্ন ধরনের কাজ করা হয়। শাড়ির সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে সুতা ও রঙ। শাহনাজ খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি শাড়িতে ১২ থেকে ১৩টি সুতার কম্বিনেশন রয়েছে। বিভিন্ন রকমের সুতা রঙে ভেরিয়েশন আনে। রাঙামাটি জেলায় আলম ডিজাইন নামে পরিচিত যা পাহাড়িয়া বুননের কিছু রীতি বা ডিকশনারি বলা যায়, ওই ডিজাইনের ইন্সপেরশনে আমরা সেগুলোকে প্রিন্টের মাধ্যমে ফোকাস করছি। এবারের কালারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শেড রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। ব্লু রঙের মধ্যে ডিপ থেকে লাইট শেড দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজ রয়েছে। রঙের ক্ষেত্রে সব রঙকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তবে বটল গ্রিন, অলিভ গ্রিন, ব্লুকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এবারের ঈদে ভালোই গরম থাকবে; তাই সুতিটাই মানুষ বেছে নিচ্ছে বেশি। ১০০ ভাগ সুতির যাকে ফাইন কাপড় বলা হয়, এগুলো মোটা হয় না, যা পাতলা ও আরামদায়ক। সেই আগের ডিজাইন আর এখনকার ডিজাইনের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ডিজাইনাররা অনেক কষ্ট করে ডিজাইনে পরিবর্তন এনেছেন। শাহনাজ খান এবারের ঈদে নিজে কী পরবেন জানতে চাইলে বলেন, এবার অফ হোয়াইটের মধ্যে গোল্ডেন সিলভারের কম্বিনেশনে কিছু শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। আমি নিজের জন্য নিলে এখান থেকেই একটা শাড়ি নেব।
এবার শাড়ি তৈরির ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিই। সেলাইবিহীন লম্বা কাপড় দিয়ে তৈরি হয় এ ঐতিহ্যবাহী পোশাকটি। সাধারণত চার থেকে নয় মিটার (প্রায় ১২ হাত বা ১৮ ফুট)। দীর্ঘ কাপড় দিয়ে তৈরি হয় এক একটি শাড়ি। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভুটান, মিয়ানমার এবং মালয়েশিয়ায় শাড়ি খুবই জনপ্রিয়। বিভিন্নভাবে ভাঁজ করে শাড়ি পরা হয়ে থাকে। শাড়ি ভাঁজ করে পরার নিয়ম দেশভেদে আলাদা হয়ে থাকে। সবচেয়ে সাধারণ ভাঁজ হচ্ছে কোমরে জড়িয়ে একপ্রান্ত কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া, যাকে আঁচল বলা হয়। তবে সেনাবাহিনীতে নারী সেনারা শাড়ি পরলে কোমরে শার্ট বেঁধে রাখেন। কেরালা এবং তামিলনাড়ূতে সেই ২০ শতক থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নারীরা ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে থাকেন। যদিও বিমানবালাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শাড়ি বলতে আধুনিক ঘরানার শাড়িকেই জনপ্রিয় করা হয়েছে। তবে উপমহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই নিজস্ব ধরনের শাড়ি তৈরি জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলাদেশের নারীরা সাধারণত সুতি শাড়িকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তবে জামদানি, ঢাকাই বেনারসি, রাজশাহী সিল্ক, রেশমি শাড়ি, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, তসর সিল্ক, কাতান শাড়ি, পাবনার শাড়ি খুবই জনপ্রিয়। নেপালি নারীরা বিভিন্নভাবে শাড়ি পরেন। এর মধ্যে হাকুপাতাসি উল্লেখযোগ্য। এটি লাল পাড়ের কালো শাড়ি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের শাড়ি পরে থাকে নারীরা। উত্তরাঞ্চলীয় শাড়ির মধ্যে বাঁধনি, বেনারসি, তাঁত জামদানি, শালু বেশি পরিচিত। পূর্বাঞ্চলীয় শাড়ি কাঁথা, বালুচরি খুবই জনপ্রিয়। মধ্যাঞ্চলীয় শাড়ি চান্দেরি পাইথানি উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণাঞ্চলে গাড়োয়াল, বলরামপুরম, মাইসোর রেশম, কাঞ্চিপুরম শাড়ি পাওয়া যায়। পাকিস্তানে প্রতিদিনের ব্যবহার্য শাড়ির স্থান সালোয়ার-কামিজ প্রায় দখল করে নিয়েছে। তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখনও শাড়ি পরা হয়ে থাকে। সাধারণত মোহাজির নামে পরিচিত ভারতীয় অভিবাসী পাকিস্তানিরা শাড়ির ব্যবহার টিকিয়ে রেখেছে, যা প্রধানত করাচিতেই চোখে পড়ে। শ্রীলংকায় বিভিন্নভাবে শাড়ি পরা হলেও ভারতীয় ধরনেই শাড়ি বেশি পরা হয়ে থাক, যা সাধারণভাবে কানাড়ি ধরন (অথবা সিংহলিজ) ভাষায় ওসারিয়া নামে পরিচিত। ক্যান্ডির পাহাড়ি এলাকায় ক্যান্ডির ধরন চালু রয়েছে।
অতীতে শাড়ি বোনা হতো সিল্ক বা সুতি দিয়ে। তখনকার দিনে একমাত্র ধনীরাই এ শাড়ি ব্যবহার করতে পারত। এ শাড়ি এতটাই পাতলা ছিল, আঙুলের রিঙের মধ্যে এটি প্রবেশ করানো সম্ভব ছিল। এ শাড়িগুলো হাতে তৈরি করা হতে। এটি তৈরিতে প্রচুর টাকা ব্যয় আর পরিশ্রম করতে হতো। সাধারণত হাতে বোনা শাড়ি ডিজাইন করা হতো চেক অথবা স্ট্রাইপের মতো করে। আর এক্সপেনসিভ শাড়িগুলোর ডিজাইন করা হতো ব্লকপ্রিন্টের মাধ্যমে, যাতে কাঠের ব্লক, ভেজিটেবল ডাইং থাকত, যা ভারতে ভানবীনি কাজ বলে পরিচিত ছিল। আধুনিক যুগে শাড়ি বুননে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন রকমের পশমি ম্যাটেরিয়াল যা পলেস্টর, লিলেন, রেওন নামে পরিচিত। এসব শাড়িতে মেশিনের মাধ্যমে প্রিন্ট করা হয়। হাতের বুননে, হাতের কাজ করা শাড়ি খুবই এক্সপেনসিভ হয় মেশিনে তৈরি শাড়ির থেকে। এখনও হাতের বুননের শাড়ি বেশ জনপ্রিয় ঈদ, বিয়ে অথবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের জন্য।