দেশজুড়ে বাজার ছেয়ে গেছে একাদশ শ্রেণীর নকল পাঠ্যবইয়ে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সময়মতো একাদশ শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যবই না ছাপায় দেশের সাড়ে ৯ লাখ ছাত্রছাত্রী এখন নকল পাঠ্যবই পড়ছে। এসব বইয়ে প্রকৃত বোর্ডের বইয়ের গল্প-কবিতার কোনো ধারাবাহিকতা নেই। রয়েছে ব্যাপক মুদ্রণ প্রমাদ। চলতি বছর থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হয়েছে। অথচ নকল বইয়ে ওই প্রশ্নের কোনো নমুনাই নেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নকল বই কেনা শিক্ষার্থীরা।

গত ১ জুলাই চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ক্লাস শুরু হয়েছে। সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার দেড় মাস পার হলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) একাদশ শ্রেণীর বাংলা বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারেনি। এর সুযোগ নিয়ে রাজধানীর বাংলাবাজারের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বোর্ডের বাংলা বই নকল করে বাজারে ছেড়েছে। আর এনসিটিবি গত ২৪ জুলাই একাদশ শ্রেণীর সাড়ে ৯ লাখ শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র ১ লাখ ৬৬ হাজার কপি বাংলা বই ছেপেছে এবং গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত বই বিক্রি করতে পেরেছে মাত্র ৩৫ কপি। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা অভিযোগ করছেন, বোর্ডের খামখেয়ালির কারণে নকল বই কিনে প্রতারিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এর দায় এনসিটিবিকেই নিতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এনসিটিবির একটি চক্র যোগসাজশ করে নকল বই বাজারে ছাড়তে অসাধু প্রকাশকদের মদদ দিয়েছে।

সে কারণে এবার ইচ্ছাকৃতভাবে বোর্ডের বাংলা বই প্রকাশ বিলম্বিত করা হয়। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কেবল নকল বাংলা বই নয়, এর গাইডও বাজারে ছেড়েছে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা। তারা নকল বইয়ের সঙ্গে নোটবই ছাত্রছাত্রীদের গছিয়ে দিচ্ছে। এতে তাদের ডাবল লাভ হচ্ছে। প্রকাশনা খাতের সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, শুধু নকল বাংলা বই বিক্রি করেই এ চক্র এ বছর বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৩ কোটি টাকা। নকল পাঠ্যবই প্রকাশের সঙ্গে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির শীর্ষ নেতার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মোঃ আবু তাহের সমকালকে বলেন, ‘নকল বই প্রকাশকদের প্রতি আমি নিন্দা জানাই। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’ তার নিজের মালিকানাধীন প্রকাশনা সংস্থা ‘বই প্রকাশনী’ থেকেও নকল বাংলা বইয়ের গাইড বেরিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবু তাহের বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের একটি ধারণা দেওয়ার জন্য বইটি বের করেছি।’

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ মোস্তফা কামাল উদ্দিন নকল বই বাজারে ছাড়ার ক্ষেত্রে এনসিটিবির সম্পৃক্ততা সরাসরি অস্বীকার করেন। তিনি আরও বলেন, ‘বাজার থেকে একাদশ শ্রেণীর নকল বাংলা বই তুলে নেওয়ার জন্য গত ২৬ জুলাই ঢাকার পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি দেওয়া হলেও পুলিশ এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি।’ এ সাড়ে ৯ লাখ শিক্ষার্থী এখন কবে কীভাবে বোর্ডের বাংলা বই হাতে পাবে তার নিশ্চয়তা দিতে পারেননি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান।

তবে এনসিটিবির পাঠ্যবই মনিটরিং কর্মকর্তা রতন সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, ‘সারাদেশে যাতে বোর্ডের বাংলা বই পেঁৗছানো যায় সেজন্য এরই মধ্যে ৯টি জেলা সফর করা হয়েছে। এগুলো হলো_ চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, কুমিল্লা, ফেনী এবং বরিশাল। এই ৯টি জেলায় মাত্র ১০০টি বোর্ডের বই বিলি করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শিগগির যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে নকল বই বাজার থেকে তুলে না নেয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত বাংলা বই হাতে পাবে না।’

এনসিটিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নকল বইয়ের কাছে বোর্ডের মূল বইটি হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ এ ১ লাখ ৬৬ হাজার বই ঢাকার বাইরে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শিগগির মূল বই শিক্ষার্থীদের কাছে না পেঁৗছালে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। একইসঙ্গে একাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা নকল বাংলা বই পড়ার কারণে ২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নে কোনো মিল খুঁজে পাবে না। ফলে নির্ঘাত ফল বিপর্যয় ঘটবে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, ‘বই বিতরণের এসব কাজে পদে পদে বাধা আসছে। এগুলো অতিক্রম করেই আমাদের কাজ করতে হবে।’ পুলিশের মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বিষয়টির সুরাহা করা হবে বলে মন্ত্রী আশ্বাস দেন।