বাঙালী হিন্দুদের ধনী এবং ধনাঢ্য মধ্যবিত্ত অংশটি বাংলা ভাষাকে ছেড়েছে বহুকাল; বাংলাকে তারা মেনে নিয়েছে ব্রাত্যের ভাষা হিসেবে, হিন্দিতেই তাদের মুক্তি; বাংলার পরিচয় কেবল নিজ গৃহকোণে, সংগোপনে। বিপন্ন বাংলা আজও বেঁচে আছে এই বাংলাদেশেই।
যদিও একথা ভাবলেই আজ বিস্মিত হতে হয় যে, সত্যিই এমন একটা সময় এসেছিল, যখন এমন প্রশ্নও উঠেছিল, “বাঙালী মুসলমানের” মাতৃভাষা কি হবে? আপাত বিচারে প্রশ্নটি বালখিল্য ও কষ্টকল্পিত; কিন্তু এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটি ছিল স্পষ্ট। মরুসাম্রাজ্যবাদের প্রভাবে মুসলমানত্ব যখন ছাপিয়ে যায় বাঙ্গালিত্বকে, যখন বাঙালী পরিচয়টির চাইতে বড় হয়ে ওঠে মুসলমান পরিচয়টি, যখন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির চাইতে বড় হয়ে ওঠে ধর্মমোহ, তখন অংশ চায় সমগ্রকে অধিকার করতে, তখন সহজ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাওয়াও হয়ে ওঠে দুরূহ, দুষ্কর।
প্রবল আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভোগা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান হঠাৎ উদ্ভুত এ প্রশ্নের সমাধানে স্পষ্টতই ছিল বিভক্ত। একদিকে মন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহারের একটি দল রীতিমত বিধান সভায় প্রস্তাব আনেন আরবী হরফে বাংলা লিখতে, পরে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ভয়ানক সেই চিন্তাকে নেন এগিয়ে; অন্যদিকে ড. কুদরত-ই-খুদার দলটি আরেককাঠি বাড়িয়ে প্রস্তাব করেন রোমান হরফে বাংলা লিখতে। বামদিক থেকে নয়, ডানদিক থেকে লিখতে হবে বাংলা, এমন মতের লোকেরও অভাব পড়েনি মোটেই। হরফে পরিবর্তন, শব্দে পরিবর্তন, বানানে পরিবর্তন ইত্যাদি, ইত্যাদি গোলমেলে পরিবর্তন এনে গোটা বিষয়টাকেই করে তুলেন ধোঁয়াশাময়।
সাধারণ মানুষই চিরকালের খাঁটি বাঙালী। তাই মধ্যবিত্তের এসব নষ্টামো আর ভণ্ডামো তাদের স্পর্শ করেনি মোটেই, “বাঙালী মুসলমানের” মাতৃভাষা বাংলা নাকি উর্দু এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তারা বেগ পায়নি মোটেই, অটল থেকেছে মায়ের ভাষার প্রতি ভালোবাসায়, এমনকি রক্ত ঝড়াতেও দ্বিধা করেনি বিন্দুমাত্র। খুব সহজ প্রশ্নটির উত্তরও যে সবসময় খুব সহজে পাওয়া যায়না, তার হৃদয়বিদারী একটি অনন্য উদাহরণ হল বাঙ্গালীর ভাষার সংগ্রাম, আমাদের একুশের সংগ্রাম। আর তাই আজ হিন্দির প্রবল আগ্রাসনের শিকারে পশ্চিমবঙ্গের বিপর্যস্ত বাঙালীও নিজেদের খুঁজে ফেরে একুশের ভালোবাসায়, ফুলে ফুলে সাজায় সৌধ।
কিন্তু বাংলা নিয়ে এই যে ষড়যন্ত্র, তা থেমে থাকেনি মোটেই; স্বাধীন বঙ্গভূমিতেও সেই একই বালখিল্যতায় আজও তারা প্রশ্ন তুলে চলেছে ভাষা শহীদেরা কি শহীদ নাকি মৃত, শহীদ মিনার কি স্মৃতিস্তম্ভ নাকি পুজাস্থল, একুশের ভালবাসা কি পুস্পে নাকি দোয়াতে ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাদেরই পোঁ ধরা আরেকটি গোষ্ঠী, যারা আবার “আট-কালচারের লোক” বলেই পরিচিত, তারাও সমান নির্বুদ্ধিতায় বলছে ফুলের এ ঢল বুঝিবা অকারন অর্থব্যয়; এ শুধু একটি দিনের চেতনা, লোকদেখানো, শূন্যগর্ভ আর অসার।
এটা খুব স্পষ্ট যে, এদের মুল আপত্তি দিবস উদযাপনে নয়, এদের আপত্তি একুশের সার্বজনীনতায়; একুশের ধর্মনিরপেক্ষ, সেক্যুলার চরিত্রে। ঠিক আপত্তিও নয়, আসলে ভয়।
ভয়টা এ কারনেই যে, সাধারণ মানুষ, যারা চিরকালের খাঁটি বাঙালী, তারা যত বেশী ধর্মনিরপেক্ষ, সেক্যুলার গতিশীলতার সাথে সংযুক্ত থাকবে, ততই বাংলাদেশকে বাংলাস্তান বানানোর নস্ট উদ্দেশ্যটির সাধন পড়বে পিছিয়ে। নস্টদের এই একই দলটি একই ঘ্যানঘ্যানে সুরে বিরোধিতা করে পহেলা বৈশাখের, বিরোধিতা করে নবান্নের, বিরোধিতা করে পৌষমেলার, বিরোধিতা করে লালনের, বিরোধিতা করে আমাদের সকল কৃষ্টি, সভ্যতা আর ঐতিহ্যের।
বাংলায় কি হয়? ক’জন আমরা শুদ্ধভাবে বাংলা বলি আর লিখি? প্রমিত বাংলার কি আদৌ আর প্রয়োজন আছে? বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলার গুরুত্ব কতটুকু? কি প্রয়োজন ছিল বাংলা নিয়ে রক্ত ঝড়ানোর? বাঙ্গালী মুসলমানের মুখের ভাষা যাই হোক, শেখার মাধ্যম কি বাংলা হবে নাকি ইংরেজি সেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়াও সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
একুশের গভীরবোধটিকে হেয় করবার জন্য বিভিন্নমুখী চেষ্টাও থেমে নেই, বাণিজ্যিকীকরণের নির্মম অপচেষ্টায় কখনও বানায় একুশের ফ্যাশন, কখনওবা তাকে পরিণত করে রন্ধন উৎসবে, তাকে আবদ্ধ করতে চায় যান্ত্রিকতা আর আপোষকামীতায়; একুশকে ভালবাসার ছলেই।
আমাদের এই বৈপরীত্যভরা মানস বুঝতে হলে আদতে এগুতে হবে ইতিহাসের ধাপগুলির ভিত্তিতে; গভীর ভাবে অনুধাবন করতে হবে আমাদের শ্রেনী চরিত্র; কারন বাঙ্গালীর ইতিহাস শাসকের নয়, শোষিতের। এর মাঝেই রয়েছে রাজানুকল্য পাওয়া সুবিধাবাদী উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা নিজেরাই কখনও শোষক, আবার একই সাথে শোষিতও।
উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত বারবার নিজেদের পাল্টেছে, শাসকের চরিত্রানুযায়ী; সেজন্যই সে কখনও হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদি অত্যাচারী আবার কখনও মুসলমান নিপীড়ক; সেজন্যেই সে নিজের মাঝেও খুঁজে বেড়ায় আর্যরক্তের কৌলীন্য বা আরবের শেকড়, সকল নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অগ্রাহ্য করেই।
আর শোষিতরা, সাধারণ্যেরা চিরকালই অক্ষুন্ন রেখেছে নিজেদের সহনশীলতার ঐতিহ্য, কারন সব যুগে, সব সময় ঐক্যই ছিল তাদের একমাত্র শক্তি।
“আমরা আসলে তাহলে কি?”
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে তাই আমরা আসলে তাহলে কারা? আমরা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছি সে প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজে পাওয়া বড়ই প্রয়োজন।