একজন মানুষ, তিনি তাঁর জীবনের পুরো সময়টাই চেয়েছেন দেশের মানুষের মঙ্গল, চেয়েছেন কিভাবে প্রতিটি মানুষকে ভালো রাখা যায়। আর সেজন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। সবসময় বলে গেছেন দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা। তিনি আমাদের সবারই খুব প্রিয়, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে সেই সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়৷ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময়টাতে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল কারাগারে। পুরো নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর যখন বাংলাদেশের মানুষ পেল এক নতুন পতাকা, এক নতুন স্বাধীন দেশ; তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে মুক্তি দিয়েছিল তারা। তাঁর মুক্তির জন্যও জনমত তৈরি করতে হয়েছিল বিশ্বব্যাপী। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বাঙালী জাতির এই মহান নেতাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টুকু তিনি ছিলেন দেশ ছাড়া, কারাগারে বন্দি। ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন মাথা উঁচু করে। তাই এই দিনটিকে আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালন করে থাকি। আজকে চলো আমরা এই মহান নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে গল্প শুনি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জায়গায় যখন মুক্তি বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একেবারে নাজেহাল অবস্থা, ঠিক তখনই পশ্চিম পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে চলছিল এক প্রহসন। শুধু তাই নয়, এই বিচারে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশও দেয়া হয়। কারাগারের যে ঘরটিতে তাকে রাখা হয়েছিল, সেই ঘরের পাশেই তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিলো। এসময়টাতেই পুরো পৃথিবীতে বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে ওঠে জনমত। এরপর এসে গেলো ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। স্বাধীনতা লাভের পর নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ তার মহান নেতার নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করে। এই দাবীর সঙ্গে যোগ দেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ। শেষে পাকিস্তান কুচক্রী সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আমাদের মহান নেতাকে।

মুক্তি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শুরু করে দিয়েছিলেন তাঁর কাজ। এজন্যই তো তিনি সবার প্রিয় নেতা। ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েই তিনি চলে যান লন্ডনে। এরপর সেখান থেকে দিল্লীতে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানকে সম্মান জানাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। এরপর ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন দেশে- তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে। সে দিনটাতে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রমনা রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দান এবং পথে পথে বাংলাদেশের আপামর জনতা মহান এই নেতাকে যে প্রাণঢালা সংবর্ধনা দেয় তা আজও ইতিহাসে অমলিন হয়ে আছে৷

আচ্ছা বলো তো, তিনি দেশে ফিরে কি করলেন? হয়তো ভাবছো কি আর করবেন; এতদিন পরে দেশে ক্লান্ত হয়ে এসেছেন নিশ্চয়ই তিনি বিশ্রাম নিয়েছেন, তাই না? কিন্তু তিনি তো সাধারণ কেউ নন। তিনি আমাদের অবিসংবাদিত নেতা। এজন্যই তিনি এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনতার সামনে ভাষণ দিয়েছেন। প্রতিজ্ঞা করেছেন দেশকে গড়ে তোলার। তাঁর দেশে ফেরার পর থেকেই তিনি শুরু করে দিয়েছিলেন তাঁর কাজ।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির বিকেল বেলা ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে নামেন। বিমানবন্দর তখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিলো। বিমান থেকে বঙ্গবন্ধু দেখলেন গোটা ঢাকা শহরের সব মানুষ যেন বিমানবন্দরকে ঘিরে আছে। একজন বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর পাশেই বসা ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি দেখলেন বঙ্গবন্ধু ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তখন সেই সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার তো আনন্দের দিন। আপনি কাঁদছেন কেন? বঙ্গবন্ধু কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, এতো যে মানুষ আমার অপেক্ষায়। আমি ওদের খাওয়াব কি? পাকিস্তানীরা তো সব ধ্বংস করে গেছে।’ জাতির পিতা না হলে ওই মুহূর্তে এ রকম কথা বলা যায় না। কারণ ঐ সময় তিনি যা চিন্তা করেছিলেন তা ছিল একদম সঠিক। যুদ্ধের কারণে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, দালান-কোঠা সবই তো ধ্বংস হয়েছে তখন। আবার নতুন করে সব কিছু গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু দেশের কোষাগারে নেই টাকা। এজন্য তিনি যা চিন্তা করেছিলেন তা ছিলো খুবই স্বাভাবিক। আজকে আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অনেক টাকা রয়েছে। কিন্তু এই খবর অনেকেই হয়তো জানে না যে কিভাবে শুরু হয়েছিল আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার। কানাডা সরকার সেই সময় বঙ্গবন্ধুকে আড়াই মিলিয়ন ডলারের স্বর্ণের একটা উপহার দিয়েছিলো। সেটাই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে শুরু করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনই বিকেলে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে খোলা ট্রাকে করে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে (তখনকার রেসকোর্স ময়দান) এগোতে থাকেন তিনি। সেখানে তাঁর অপেক্ষায় ছিল বিশাল এক জনসমুদ্র। এইটুকু পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা। এখানে তিনি জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ এক ভাষণ দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম ‘দুর্গ গড়ে তোল।’ আজ আবার বলছি ‘আপনারা একতা বজায় রাখুন’। আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো।’ বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। একজন বাঙালী বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশ হয়েই বেঁচে থাকবে। বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই।’

আজ আমরা স্বাধীন এক জাতি হিসেবে বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে। এই স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি সেই মহান নেতার দেশে ফিরে আসার দিনটিকে তাই বাঙালী জাতি মনে রাখবে চিরকাল। যারা জানে না এই দিনটির কথা তাদেরকে তোমরা কিন্তু জানিয়ে দিতে ভুলো না।