দেশে এখন এতো বেশী আলোচনা ও সমালোচনার বিষয়.. সংবিধান সংশোধন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তত্বাবধায়ক পদ্ধতি থাকবে কি থাকবেনা, বিচার বহির্ঃভুত হত্যাকান্ড সহ লোডশেডিং, যানজট এবং আওয়ামী লীগের গলার কাটায় পরিণত হওয়া ছাত্রলীগ ইত্যাদি ইত্যাদি। এতসব সমস্যার ভিড়ে আমাদের কি কোনো ফুসরত আছে একটু পিছনে ফিরে থাকানোর, পিছন মানে ৭১, ৬৯, ৬৬, ৫২ কিংবা ৪৭ এ নয় তাহলে কি ১৯০৫ সালের দিকে থাকাবো ? আমরা আসলে পিছনে যেতে চাইনা, চাই সামনে-অনেক সামনে থাকাতে, যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর আগামী অপেক্ষা করছে।
তবে এটাও সত্যি সামনে যাওয়ার জন্য পেছনের প্রেরনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। আমরা যখন পিছনের দিকে যাই ‘৭১ এ গিয়েই থেমে যাই, জাতীকে বিভক্ত করার জন্য। জাতী হিসেবে বিশ্ব পরিমন্ডলে নিজেদের তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে বড় থামার জায়গাই বা আর কি হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো যে আমরা কোনো কিছু শেখার জন্য ‘৭১ এ থামিনা। থামি হচ্ছে ইতিহাস নিয়ে টানাটানি, জাতিকে দ্বি-মেরুকরণ এবং সর্বোপুরি নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য। যদি সত্যিকার অর্থে কিছু শিখতে চাই তাহলে ৭১ থেকেই শিখতে পারি দেশের জন্য কিভাবে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়, দেশ সেবা মানে যে রাজনৈতিক লেবাসে শেয়ার কেলেংকারী করা নয় সেই শিক্ষা কিন্তু আমরা চাইলে ৭১ থেকেই নিতে পারি।
দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সাপে-নেউলে সম্পর্ক, একে অপরের প্রতি কাদা চুড়াচুড়ি এবং দেশে কোন সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না উঠার কারণে অনেক বিশ্ব বরেন্য, ইতিহাসের কিংবদন্তি এবং কীর্তিমান বাঙ্গালী আজ বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। হ্যা, আমি ভারত উপমহাদেশের প্রথম র্যাংলার আনন্দমোহন বসুর কথাই বলছি। ১৯৩৬ সালের ২০ শে আগষ্ট পরলোক গমন করা আনন্দমোহন বসু ১৮৪৭ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে পদ্মলোচন বসু (পিতা) এবং ওমা কিশোরী দেবীর (মাতা) ঘরে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন।
তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ এ এবং বি এ উভয় পরিক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি ১৮৭০ সালে প্রেমচাদ-রায়চাদ বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৭৮ সালে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য বিলেতে পাড়ি জমান। আনন্দ মোহন বসু ছিলেন ক্যামব্রিজে পড়া কোনো প্রথম ভারতীয় বাঙ্গালী। তিনি ভারত উপমহাদেশের প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদত্ত গণিত শাস্ত্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রি র্যাংলার উপাদি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ব্রাক্ষ্ম ধর্মের সমর্থক ছিলেন। জগদ্বীশ চন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণ প্রভা দেবীকে বিয়ে করে পরবর্তীতে তিনি নিজেকে ব্রাক্ষ্ম ধর্মের একজন পরিপূর্ণ অনুসারী হিসেবে গড়ে তুলেন।
কিন্তু এ নিয়ে ব্রাক্ষ্ম ধর্মের তরুন সদস্যরা ভিন্ন মত পোষন করলে ১৮৭৮ সালে তিনি শিবনাথ শাস্ত্রী, শিবচন্দ্র দেব এবং উমেষ চন্দ্র দত্তকে নিয়ে সাধারণ ব্রাক্ষ্ম সমাজ প্রতিষ্টা করেন। তিনি ২৭ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে ছাত্রসমাজ নামে সাধারণ ব্রাক্ষ্ম সমাজের একটি ছাত্র সংগঠন চালু করেন। একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে তখনকার সময় তার অনেক সু-খ্যাতি ছিলো, এর প্রমান পাওয়া যায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্টান বিনির্মানে তার অবদান পর্যবেক্ষন করলে। তিনি কলকাতা সিটি স্কুল ও সিটি কলেজের প্রতিষ্টাতা ছিলেন। তিনি ১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহে নিজ বসতবাড়ীতে কলকাতা সিটি কলেজের একটি শাখা চালু করেন এবং ১৯০১ সালে এই প্রতিষ্টানের নামকরন করা হয় ময়মনসিংহ কলেজিয়েট স্কুল।
১৯০৬ সালে তার মৃত্যও পর কলেজ সেকশনটি বন্ধ হয়ে যায়। দুই বছর পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্ল্যাকউড কলেজটি পুনঃ চালুর উদ্যোগ নেন এবং এই সময় কলেজটির নাম পরিবর্তন কওে আনন্দমোহন বসুর নামে অর্থাৎ আনন্দ মোহন কলেজ নামকরন করা হয়। তিনি কলকাতা শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রতিষ্টাতা ছিলেন। তিনি শিশির কুমার ঘোষের ইন্ডিয়ান লীগের সাথে জড়িত ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনে যে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি ছিলেন তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
তিনি সৌরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জিও সাথে যৌথভাবে ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এসোসিয়েশন প্রতিষ্টা করেন। ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত উক্ত সংগঠনের সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে আজীবন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার এবং ফেলো সদস্য ছিলেন। সবকিছুকে চাপিয়ে তিনি ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে অনুষ্টিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
অবিভক্ত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদ অলংকৃত করেই থেমে থাকেননি বরং গনমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। জগদ্বীশ চন্দ্র বসুর বাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা এই ক্ষণ জন্মা বরেন্য রাজনীতিক মৃত্যুকালে কোনো বংশধর রেখে যাননি। আর তাই বংশ পরম্পরার রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই ভারত উপমহাদেশে মৃত্যু পরবর্তীকালে তাকে যেমন কেউ স্মরণ করেনা ভারতে তেমনি তার মাতৃভুমি এই বাংলাদেশেও। আজ পর্যন্ত দেশের কোনো জাতীয় দৈনিকে তাকে নিয়ে দু কলম কেউ লিখেছে বলে আমার জানা নেই।
শুধু তাই নয় আমরা যেমন তাকে স্মরণ করি না তেমনি তার রেখে যাওয়া পৈতিৃক বাড়িটি পযর্ন্ত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সরকারের কিছু অসাধু কর্মচারীর হীন স্বার্থে এলাকার একজন প্রভাবশালী লোককে লিজ দেওয়া হয় যা নিয়ে এলাকায় জনমনে প্রশ্ন আছে। অথচ সরকার চাইলে প্রাসাদতুল্য বাড়িটিকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নিয়ে এটাকে সংরক্ষন করতে পারে যা কিনা প্রাচীন নির্মানশৈলির একটি স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদিও এলাকার সচেতন যুব সমাজ এবং এই কীর্তিমান পুরুষের স্মৃতি সংরক্ষনে এক সময় এলাকার কিছু শিক্ষিত যুবক মিলে গড়ে তুলেছিলো বসু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ তাদের দাবী ছিলো এই বাড়িটিতে যেন একটি কলেজ নির্মান করা হয়।
অবহেলা আর অযত্নে বাড়িটি যেন এক ভুতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। এই বাড়িটির চেয়েও অবহেলিত এক সময়ের কীর্তিমান এই মনিষী। ছোটবেলায় পড়েছিলাম কীর্তিমানের মৃত্যু নেই, কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা কি তাই বলে ? যে দেশে গুনির খদর করা হয়না সে দেশে গুনি জন্মায় না এই প্রবাদকে মনে রেখে সরকার আসছে আগষ্টের ২০ তারিখ বসু‘র ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি ন্যুনতম সম্মান টুকু প্রদর্শন করবে বিলেতের হিম শীতল আবহাওয়ায় এমন উষ্ণ প্রত্যাশায় রইলাম।
গাজী মহিবুর রহমান (সাংবাদিক, প্রবাসবাংলা )মানচেষ্টার, যুক্তরাজ্য।