১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নৃশংসতম কিশোরগঞ্জের ‘কানকাটি গনহত্যা দিবস’। এই দিনে স্বাধীনতা বিরোধীরা সদর উপজেলার কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের কানকাটি গ্রামে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। ওই দিন একটি হিন্দু পরিবারের ৭ জনসহ ৮ নিরীহ গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এখনও কান্না থামছে না বেঁচে থাকা সংখ্যালঘু এ পরিবারের স্বজনদের। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪০ বছর পার হলেও এখানে নির্মিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ১ম দিকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় হামলা-লুটপাট চালায়। তখন কানকাটি গ্রামের সুরেশ চন্দ্র সরকার ছিলেন এলাকার মাতব্বর। প্রগতিশীল রাজনীতিক হিসেবে তিনি দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় কানকাটিবাসীর জন্য। মে মাসের ১ম দিকে হানাদার বাহিনী এ গ্রামে নির্বিচারে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর ওই গ্রামে দুঃস্বপ্নের মতো হানা দেয় স্বাধীনতাবিরোধীরা।
স্থানীয় পিডিবি নেতা মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন ও কর্র্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ মেনু মিয়ার নেতৃত্বে ৫০/৬০ জনের হানাদার বাহিনী নৌকায় করে এসে হামলা চালিয়ে অসংখ্য গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকার আল বদর বাহিনী তখন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুরেশ চন্দ্র সরকার, তার দুই ভাই জ্ঞানচন্দ্র নন্দী, জয়চন্দ্র নন্দী, ভাতিজা মধুসূদন নন্দী, দুই নাতি হর্ষবর্ধন সরকার ও বিশ্ববর্ধন সরকারকে ধরে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ধুলদিয়া রেলসেতুর কাছে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। একই সাথে হত্যা করা হয় কানকাটি গ্রামের কৃষক আব্দুল জব্বারকে। নারকীয় ও বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের সময় অনেকে বেঁচে যান সৌভাগ্যক্রমে। তাদেরকে এখনও তাড়িত করে সেদিনের দুঃসহ ভয়াল স্মৃতি।
প্রতি বছর ১১ সেপ্টেম্বর এলেই কানকাটি গ্রামে স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে। সারা গ্রামে দেখা দেয় শোকাতুর পরিবেশ। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য এতোগুলো তাজা প্রাণ বিসর্জন দিলেও তাঁদের প্রতি সম্মান জানাতে সরকারিভাবে শহীদদের খোঁজ খবর নিতে যায়নি কেউ। হত্যাকাণ্ডের দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সুধীর চন্দ্র সরকার বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয় এমনকি অনেক রাজাকারের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় উঠেছে অথচ পরিবারের এতগুলো লোক জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পেলাম না। তিনি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাঁর নাম এখনো না উঠায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। প্রতি বছর গ্রামের লোকজন শহীদ সুরেশ সরকারের বিলুপ্ত বসত ভিটার স্থানে আয়োজন করে ঘরোয়া স্মরণ সভার। শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে এখানে একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন এলাকাবাসী। আজও বিকেলে বসতভিটা প্রাঙ্গণে স্মরণসভা ও সন্ধ্যায় শহরের রামকৃষ্ণ আশ্রয় কেন্দ্রে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
লিখেছেনঃ মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ