হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা। কটিয়াদীতেও আজ প্রথম রথযাত্রা এবং ১১ জুলাই উল্টো রথযাত্রা হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপর নাম শ্রীশ্রীজগন্নাথ ও শ্রীশ্রীগোপীনাথ। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায় ভোগবেতাল গ্রামে অবস্থিত ঈশা খাঁ ও রাজা নবরঙ্গের ঐতিহাসিক হিন্দুধর্মীয় তীর্থস্থান শ্রীশ্রীগোপীনাথ মন্দির জেলার অন্যতম প্রত্নসম্পদ। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কোটামন দিঘি ও বাউলসাগর নামের নদীতীর থেকে কৃষ্ণবর্ণের দুটি নিম কাঠের খণ্ড দিয়ে গোপীনাথ বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করে মন্দিরে স্থাপন করেন। এর সংস্কার করেন ঈশা খাঁ। এই জায়গাটির নাম ভোগবেতাল। নামটির জন্মদাতা ঈশা খাঁ। এই নিয়ে এলাকায় একটি কিংবদন্তি রয়েছে। ঈশা খাঁ তাঁর সৈন্যদের নিয়ে যখন এগারসিন্দুর দুর্গ থেকে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মন্দিরে ভোগ রান্না হচ্ছিল। এর গন্ধে ঈশা খাঁ সেখানে থেমে যান। সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম ভোগবেতাল। ঈশা খাঁ এই মন্দিরটির সংস্কার করেছেন এবং বহু জায়গা দান করেছেন তামার পাত্রে লিখে। একটা জরাজীর্ণ সেতু এই মন্দিরের কাছে পানাম নগরের নকশায় নির্মিত।

এখানে প্রতিবছর রথযাত্রা, বার্ষিক উৎসব, দোলপূর্ণিমা, জন্মাষ্টমী, শিবরাত্রি, ঝুলনযাত্রা, বাসন্তীপূজাসহ নিত্য পূজা-পার্বণ হয়ে আসছে। গোপীনাথ মন্দিরে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান রথযাত্রা। ১৫৮৫ সালে সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় এই মন্দিরে প্রথম শুরু করেন এই রথযাত্রা। কিংবদন্তিতে আছে, ‘উড়িষ্যার জগন্নাথ, বঙ্গের গোপীনাথ’। বলা হয়, প্রাচীন বাংলার সর্ববৃহৎ রথযাত্রা ছিল গোপীনাথের রথযাত্রা। এককালে রথযাত্রা উপলক্ষে বসত ১৫ দিনব্যাপী মেলা। ভাটি এলাকা ও হাওরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসত নৌকা ও বজরার বহর। জড়ো হতো বাউলসাগর নদীতে। এককালে ১০৫ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন ৩২ চাকার রথ স্থানীয় জমিদারদের পোষা হাতি দিয়ে গোপীনাথ মন্দির থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ বিশাল সড়কপথ দিয়ে ভক্তরা রথ টেনে নিয়ে যায় গুণ্ডিচাবাড়িতে (শ্বশুরবাড়ি)। আবার আট দিন পর ফিরে আসে নিজ বাড়িতে। রথ ছিল তিনটি—একটি পিতলের, অন্য দুটি কাঠের তৈরি। আজও বাংলাদেশের মধ্যে এটিই দূরপাল্লার রথযাত্রা।

১৫৯৫ সালে এগারসিন্দুর দুর্গে ঈশা খাঁ সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ কর্তৃক অবরুদ্ধ হন। জনশ্রুতি আছে, মল্লযুদ্ধে সেনাপতি মানসিংহ ঈশা খাঁর কাছে পরাজয় বরণ করেন। বিজয়ী সৈন্যরা বিজয় উল্লাস করেন রথমেলায় সুপ্রশস্ত রাস্তায়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ২৫ একর ৮ শতাংশ ভূমি রয়েছে। ১৩৪২ বঙ্গাব্দে রথটি ঝড়ে পতিত হলে এর সংস্কার করা হয়। ৩২ চাকার রথটি কালক্রমে ২৪ ও ১৬ চাকা হয়ে বর্তমানে ৯ চাকায় এসে ঠেকেছে। বর্তমানে রথ অতীত কারুকার্যের কিছু স্মৃতি বহন করছে। আজ পর্যন্ত প্রতিবছরই রথযাত্রা ও মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, ওই মেলায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির হাট বসে। যে কেউ নানা ধরনের পাখি দেখার জন্য এখানে চলে আসতে পারেন। রথ উপলক্ষে পাঁচ গ্রামের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। তাঁরা তাঁদের মেয়েজামাইসহ কুটুম্বদের দাওয়াত করে থাকেন। এটা এই এলাকার একটি পার্বণ।

ট্রাস্ট কমিটির সম্পাদক দিলীপ কুমার সাহা জানান, রথের মেরামত ও সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। রথযাত্রা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লক্ষাধিক ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম ঘটবে। কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া এলাকার সাংসদ আ. মান্নান বলেন, রথযাত্রাটি দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বহুকাল আগে থেকেই রথযাত্রার অনুষ্ঠান ও মেলা হয়ে আসছে। ঢাকা, ধামরাই, খুলনা, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর প্রভৃতি স্থানে আজও রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। পুরান ঢাকায় প্রতিবছর জাঁকজমকের সঙ্গে রথযাত্রার মিছিল ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

রথযাত্রা উপলক্ষে হিন্দুদের মধ্যে দুটি সংস্কার প্রচলিত আছে। তাদের বিশ্বাস, এদিন কলাগাছ রোপণ করলে তাতে বেশি কলা ধরে এবং দিনের পূর্বভাগে মেঘ ডাকলে অগ্রিম বর্ষা আর পরভাগে ডাকলে বর্ষার আগমন বিলম্বিত হয়।

লিখেছেনঃ সালেহীন রাহাত