ডেঙ্গু আপাত দৃষ্টিতে অনেকটা ভয়াবহ রোগ বলে মনে হতে পারে কিন্তু কতটা ভয়াবহ তা হয়তো আমার কখনো ভেবে দেখার অবসর পাইনি। কিংবা হয়তো আমরা যতটা ভাবি ঠিক তার একশো ভাগের একভাগও ভয়াবহ নয়। কত কিছু নিয়েইতো এই জীবনে লিখলাম আজ না হয় এই ডেঙ্গু মহাশয়কে নিয়ে একটু হাতুড়েপনা করি। আমার এই লেখার মূল কারণ হলো কোন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি বলেছিলেন তুমি কোন বিষয় সম্পর্কে ভাল ভাবে জানতে চাইলে ওই বিষয়ের বইগুলো পড়াশোনা করো আর যদি বিষয়টা সম্পর্কে আরো অধিক জানতে চাও তাহলে বিষয়টা নিয়ে নিজেই একটা বই লিখতে বসে যাও। ভয় নেই তাই বলে আমি আবার হাতুড়েপনা ছেড়ে ডেঙ্গু নিয়ে বই লিখতে বসছিনা। ওটা লেখার জন্য আরো অনেক রথি মহারথিরা আছেন।
ঈদের ছুটির পর ঢাকা ফিরলাম। বোধহয় খাওয়া দাওয়া বেশি হয়েছিল আর লাগামহীন চলাফেরা করেছিলাম তাই ঢাকা ফেরার পরই জ্বর জ্বর অনুভুত হলো। একটু ভাল করে চিন্তা করলে দেখতে পারবেন যে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষই কোন না কোন ভাবে এক একজন ডাক্তার। বিশ্বাস হচ্ছেনা? আপনার পাশের যে কাউকে বলুন আপনার মাথাটা ব্যাথা করছে বা জ্বর জ্বর অনুভব করছেন। দেখবেন সাথে সাথে কোন না কোন পরামর্শ ও ওষুধ খেতে বলছে। তো এই দৃষ্টিতে সবাই ডাক্তার। যখন ঢাকা ফিরেই জ্বর জ্বর অনুভব করলাম তখন কয়েকজনকে বিষয়টা বললাম। সত্যি সত্যিই তারা ডাক্তার হয়ে আমাকে এটা খাও সেটা খাও বলতে লাগলো। তাদের কারো কারোটা মনে ধরলো কারো কারোটা মনে ধরলো না। ওই উপদেশ দাতাদের তালিকায় নিজের ব্যাপারে আমি নিজেও ছিলাম। শেষে নিজের মতকেই প্রাধান্য দিলাম!
আমি কিন্তু এই পাচ দিন কেটে যাবার পরও থার্মোমিটার লাগিয়ে চেক করিনি যে ঠিক কি পরিমান জ্বর আমার শরীরে বাসা বেধেছে। কিন্তু শরীরটাতো আমার তাইনা? শেষে জ্বর পরিমাপ না করেও প্যারাসিটামল গ্রুপের ট্যাবলেট খেতেই থাকলাম। জ্বর কমেওনা বাড়েও না। ভাবছেন যদি থার্মোমিটার লাগিয়ে নাই মাপি তাহলে কিভাবে বুঝলাম? আরে ভাই আগেই বলেছি শরীরটাতো আমার তাইনা?
পাশাপাশি আমি কি করলাম? আমি প্রচুর পানি খেলাম এবং এখনো খাচ্ছি। আর? লেবু কিনে কেটে কেটে ছোবড়া সহ (আস্তু লেবুর বিচি বাদে সব অংশ) লবন মিশিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছি। খাবারে মোটামুটি রুচি আছে,বমি বমি ভাব নেই,শরীরে সরক ব্যাথা নেই এবং শরীরে ক্লান্তিও নেই।
আজ সকাল থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে ডেঙ্গু নিয়ে আজ একটু পড়াশোনা করবো এবং সব দেখে শুনে তার পর যদি কঠিন কিছু মনে হয় তো ডাক্তার দেখাব। কিন্তু ডাক্তারদের বলা লক্ষ্যনের কোনটাই এখনো আমার চোখে পড়েনি তাই সৃষ্টির্কতার কাছে হাজার শুকরিয়া এই ভেবে যে আমি সাধারণত আবহাওয়াগত পরিবর্তনের শিকার হয়ে জ্বরে ভুগছি।
তো এখন আসছি বাকিদের ব্যাপারে। আপনাদের প্রাণ শক্তি ঠিক আমার মত কিনা তা যেহেতু জানিনা তাই আপনাদের জন্য টুটাফাটা সবটাই লিখছি। যদিও জানি আমরা কষ্ট করে কিছু লিখলেও আপনাদের পড়ে দেখার মত সময় নেই বা র্ধৈয্য নেই। তার পরও দায়বদ্ধতা থেকেই লিখছি।
যেভাবে ছড়ায় ডেঙ্গু জ্বর: ডেঙ্গুতো একটা ভাইরাস জনিত রোগ এটা সবাই জানি তাই এটাও জানার কথা যে ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায় ডেঙ্গু জ্বর। এডিস ইজিপ্টাই নামে এক পাজি মশা এ ভাইরাস বহন করে। এ মশা কাউকে কামড়ালে তিনি চার থেকে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।
সময়কাল: যদিও বলা হয়ে থাকে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রকট। বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। কিন্তু জেনে রাখা উচিত যে সাপের মূখে বিষ থাকে সে সাপের বিষ যে কোন সময়ই সে ঢেলে দিতে পারে। তাই খুব কম করে হলেও বাকি সময়েও ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া সম্ভব । তবে শীতকালে সাধারণত এই জ্বর হয় না বললেই চলে।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রকারভেদ: ডেঙ্গু জ্বর প্রধানত দুই প্রকার। এক. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর। দুই. হেমোরেজিক জ্বর।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ: ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাঁড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফেভার’। জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচদিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ। এগুলো অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমিবমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এর দুই বা তিনদিন পর আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফেভার’ বলে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের লক্ষণ: এই অবস্থাটা সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো যে সমস্যাগুলো হয়- শরীরে বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন : চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সাথে, রক্ত বমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে রক্ত পড়তে পারে। মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকে। এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ: ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াভহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফেভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো-রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া। নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হওয়া। শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রস্রাব কমে যায়। হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
তাহলে কি করবেন যদি উপরের লক্ষ্যণগুলো খুজে পান?
আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর হলে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার নেই, এতে অযথা অর্থের অপচয় হয়। এজন্য জ্বরের চার থেকে পাঁচদিন পরে সিবিসি এবং প্লাটিলেট করাই যথেষ্ট। এছাড়া প্রয়োজনে ব্লাড সুগার, লিভারের পরীক্ষাগুলো যেমন এসজিপিটি, এসজিওটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি করা যেতে পারে। চিকিৎসক যদি মনে করেন রোগী ডিআইসি জাতীয় জটিলতায় আক্রান্ত; সেক্ষেত্রে প্রোথ্রোম্বিন টাইম, এপিটিটি, ডি-ডাইমার ইত্যাদি পরীক্ষা করতে পারেন। (তবে মনে রাখবেন আমার মত হাতুড়ে বলেছে বলে হুটহাট করে পরীক্ষা গুলো করে অযথা টাকা নষ্ট করবেন না। আগে ডাক্তার দেখান। তিনি যদি বলেন তবেই পরীক্ষা গুলো করান)।
চিকিৎসা: সবার মূখেই একই কথা ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এই জ্বর নাকি সাধারণত নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। চিকিৎসা নেই শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। তাই উপসর্গ অনুযায়ী সাধারণ চিকিৎসা যথেষ্ট। তবে নিম্নক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো। যেমন: শরীরের যেকোনো অংশে রক্তপাত হলে। প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে। শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে পানি আসলে। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে। জন্ডিস দেখা দিলে। অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে।প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।
করণীয়: এ রোগ এমনি এমনি সেরে গেলেও রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চলতে হবে। যাতে ডেঙ্গুজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়। ডেঙ্গু জ্বরটা আসলে গোলমেলে রোগ। সাধারণত লক্ষণ বুঝেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। খেতে না পারলে দরকার হলে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া যেতে পারে। জ্বর কমানোর জন্য শুধুমাত্র প্যারাসিটামল-জাতীয় ব্যথার ওষুধই যথেষ্ট। এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক-জাতীয় ব্যথার ওষুধ কোনোক্রমেই খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে। জ্বর কমানোর জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছাতে হবে।
অনেক বকবক করলাম এখন আসল কথায় আসা যাক। মূলত নিজে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর লক্ষণ খুজে বের করে চিকিৎসা নিয়ে নিজে ভাল হলেন সেটাই কিন্তু সব নয়। আপনার আমার দায়িত্ব হলো ডেঙ্গু যেন কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে তাই প্রতিনিয়ত সচেতন থাকা। ডেঙ্গু জ্বরের বাহক মশা যেন বংশ বৃদ্ধি করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে এবং পরিবেশকে সুন্দর রাখতে হবে। যদি ও ব্যাটা এডিস মশা জন্মাতেই না পারে তাহলে ওর বাপেরও ক্ষমতা নেই কাউকে ডেঙ্গুতে ভোগানোর।
তার মানে আমাদের সবার উচিত এটাকে কোন ভাবেই ছোট চোখে না দেখে গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং মশার প্রাদুর্ভাব থেকে পরিবেশকে রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তিকে অভয় দেওয়া এবং তার পাশে থাকা ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি চলা। আশা করি আমার এই অনর্থক বকবকানি খুব একটা পড়ার সময় আপনাদের হয়নি। যারা একটু চালাক তারা হয়তো শুরুর দিকে দু এক লাইন পড়েছেন এবং স্ক্রল করে শেষ দু এক লাইন পড়েছেন। আমি কিন্তু তাতে রাগ করিনি। কারণ জাজাফীর রাগ করতে নেই।
শুভকামনা সবার জন্য।
জাজাফী, উত্তরা,ঢাকা-১২৩০