বঙ্গে পারুল আছে কি নেই এ নিয়ে বিতর্কের যেমন শেষ নেই; তেমনি আমাদের উৎসাহেরও কমতি নেই। আমাদের দেশে যে গাছগুলোকে পারুল ভেবে ভুল করা হয়, সেগুলো আদতে ধারমারা। সম্প্রতি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ফলে, পারুলের সন্ধানে আমাদের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকবে।
প্রয়াত ওয়াহিদুল হক একসময় দৈনিক সংবাদ-এ ‘অথঃ পুষ্পকথা’ শিরোনামে বাংলা সাহিত্যে বহুল ব্যবহূত পারুল, পিয়াল, মল্লিকাসহ আরও কয়েকটি ফুল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। মূলত তখন থেকেই পারুল নিয়ে অনুসন্ধানের শুরু। জবাবে দ্বিজেন শর্মা তখন মস্কো থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে একটি লেখা লেখেন এবং ছুটিতে বাড়ি এসে সিলেটের পাথারিয়া পাহাড় থেকে স্থানীয়ভাবে পারুল নামে পরিচিত এমন একটি গাছের তিনটি চারা এনে ঢাকায় লাগান মহানগর পাঠাগার, শিশু একাডেমীর বাগান ও রমনা পার্কে। তত দিনে নওয়াজেশ আহমদও পারুলের সন্ধানে নেমে যান। শান্তিনিকেতনেও যান কিন্তু পারুলের খোঁজ মেলে না। যশোর টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ প্রকৃতিপ্রেমিক আমিরুল আলম খান বাংলাদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশসহ অনেক স্থানে পারুল খুঁজতে যান। কিন্তু পারুল অধরাই থেকে যায়। শেষে তিনি বঙ্গে পারুল নেই নামে একটি বইও লেখেন।
ইতিমধ্যে প্রায় ১০ বছর কেটে যায়। তত দিনে মহানগর পাঠাগারের গাছটি কাটা পড়েছে, শিশু একাডেমী ও রমনা পার্কের গাছ দুটোতে ফুল এসেছে। কিন্তু কোনোটাই পারুল নয়। শিশু একাডেমীর গাছটি ধারমারা আর রমনা পার্কের গাছটি কাউয়াতুতি। একসময় সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে একটি পারুলের খোঁজ মেলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ওটিও ধারমারা।
২০০৯ সালের ১০ জুলাই নওয়াজেশ আহমদ প্রথম আলোয় ‘দেখা মিলেছে পারুলের’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখলে কৌতূহলী হয়ে উঠি এবং ফুলটির সন্ধানদাতা জামিল আখতার বিনুকে অনুরোধ জানাই, তিনি যেন পরের বছর ফুল ফুটলে খবরটা জানান। তাঁর ছোট চাচা সৈয়দ নুরুল হোদা প্রায় ৯০ বছর আগে ভারতের মেদিনীপুর থেকে গাছটি এখানে এনে লাগান। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী গাছটির নিচেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। যথারীতি ফুল ফুটল গত বছরের মে মাসে।
বিনু আপা আমাদের নিয়ে ছুটলেন বগুড়ার সোনাতলায়। সেখানকার নাজির আখতার সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণেই আছে গাছটি। পুষ্পপ্রেমিক রাজিয়া সুলতানাও যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। গাছটি বেশ পুরোনো ও উঁচু। সারা গাছে পুষ্পোৎসব। গাছতলায় পড়ে আছে বাসি ফুল।
গাছটির ফুল, পাতা ও ফলের নমুনা সংগ্রহ করে আমরা ফিরে এলাম ঢাকায়। নমুনাগুলো পাঠানো হলো বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরদার নাসির উদ্দিন, দ্বিজেন শর্মা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আবুল হাসানের কাছে। তাঁরা পরীক্ষা করে জানালেন, ফুলটি ধারমারা। বৈজ্ঞানিক নাম Stereospermum colais (Syn. T. personatum)।
আলোচ্য গাছটির গোড়ার দিকের বেড় প্রায় ১২ ফুট। ধূসর কাণ্ড, কচি ডালপালা রোমশ, পরে মসৃণ। যৌগপত্রে তিন-চার জোড়া পত্রিকা, প্রায় মসৃণ। ডালের আগায় শাখাবিভক্ত মঞ্জরিতে ছোট ফুল, আড়াই থেকে তিন সেন্টিমিটার লম্বা, দল নলাকার, দেড় ইঞ্চি লম্বা, মলিন সাদা, তাতে লালচে দাগ, ঈষৎ সুগন্ধি, পর্যায়ক্রমে ফোটে। ইংরেজি নাম ইয়েলো স্নেক ট্রি।
প্রকৃত পারুলের ফুল সুগন্ধি ও তামাটে লাল রঙের। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে: গাছ ৩০-৪০ ফুট উঁচু, পাতা পক্ষবৎ যৌগিক ১২ থেকে ১৮ ইঞ্চি লম্বা, পত্রিকা সাত থেকে নয়টি, আয়তাকার, সূক্ষ্মকোণী, কচি অবস্থায় রোমশ। মঞ্জরিদণ্ড দীর্ঘ, রোমশ ও বহুপৌষ্পিক। ফুল এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা, ঘণ্টাকার, পাপড়ির ঠোঁট রোমশ নয়। বৈজ্ঞানিক নাম Stereospermum chelonoides (S. suaveolens)।
পারুল ময়মনসিংহে স্থানীয়ভাবে কামসোনালু নামে পরিচিত। গারোদের কাছে প্রচলিত নাম ভাতসিল। খোঁজ চলছে, হদিস মিলছে না। প্রিয় পারুল কি শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যাবে?
লিখেছেনঃ মোকারম হোসেন