woman-abstractরাবেয়ার মন খারাপ। প্রায় মিনিট পাঁচেক হল তার স্বামী শহীদুল তাকে বেশ গালিগালাজ করেছে। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি; কিন্তু গত পরশু দিন থেকে রাবেয়ার শরীরের তাপমাত্রা কোন সময়েই ১০২ ডিগ্রি এর নিচে নামে নি। জ্বরের জন্য সে প্রতিদিনই তার স্বামীকে ঔষধ আনতে বলে, শহীদুলের সে দিকে বিশেষ কোন নজর নেই বললেই চলে। লালনের মত একধরনের উদাসী উদাসী ভাব তার মধ্যে কাজ করে চলে অহর্নিশি। ছোটবেলায় পড়াশোনা তেমন একটা হয়ে ওঠেনি। টেনেটুনে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ওঠেছিলেন। পারিবারিক নানা টানাপোড়েনের কারণে প্রাইমারি স্কুল সম্পন্ন করতে পারে নি। এ নিয়ে তার সে কি আফসোস!

প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকলে কী হবে ধর্মীয় তত্ত্বজ্ঞান সম্পর্কে সে ছিল অগাধ পণ্ডিত। তবে এ নিয়ে তার এলাকার ইমামের সাথে বেশ কয়েকবার বাহাস ও হয়েছে। স্থানীয় ইমাম খুবই সুচতুর ব্যক্তি। প্রথম দিকে শহীদুলকে তর্কে বেশ ধরাশায়ী করত কিন্তু পরবর্তীতে কী বুঝে যেন সে বশ্যতা স্বীকার করল। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার পর মুসা ইব্রাহীম যেরকম খুশিতে বাকবাকুম হয়েছিলেন, ইমাম জয়নাল বশ্যতা স্বীকার করার পর শহীদুলেরও যেন সেরূপ অবস্থা! তখন শহীদুলের গর্বে যেন মাটিতে পা আর পড়তেই চায় না। বিভিন্ন জনের কাছে শহীদুল সম্পর্কে ইমাম জয়নাল বেশ প্রশংসামূলক বাক্যই প্রয়োগ করতেন। তবে এমন লোকদের কাছে প্রশংসা করতেন যাতে সে লোক ক্ষণপরেই শহীদুলের কাছে সংবাদটি পৌঁছে দেয়। এরপর থেকে শহীদুলের সাথে ইমাম সাহেবের বেশ ভাব। শহররতলী হওয়ায় শহুরে গতিশীলতার সুবাতাস এখনো পুরোপুরি লাগে নি। তবে কু প্রভাব ঠিকই পড়েছে। এই খাদিম এলাকার ছোট বড় সবাই জানত ইমাম জয়নালের সাথে তার বন্ধুত্বের কথা।

 শহীদুলের বাসার কাছেই ছিল মসজিদ। বেশ পুরনো। দু’তলা মসজিদটির ওপরতলার একপাশে ছিল ইমামের কক্ষ। সময় অসময়েই সে শহীদুলের বাসায় আসত। কখনো দেখা করতে, কখনো বা চা পান উপলক্ষে আবার কখনো বা পান খাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রায় সময়ই শহীদুল বাসায় থাকত না। একের পর এক সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করে সে রাবেয়ার সাথে গল্প জুড়ে দিত। গল্পে গল্পে তাদের বেশ ভাবও জমে গেল। একদিন রাত্রিবেলা ইমাম জয়নাল শহীদুলের খোঁজে তার বাসায় আসল। রাত তখন প্রায় ১০.৩০টা। ইমাম জয়নাল বললেন, ভাইছাব বাসাত আছইন নি?

– জি না। তাইন তো বাসাত নায়। রাবেয়া উত্তর করে।
– কোন সময় আইব্ব্যা?
– কিচ্চু তো কইয়্যা গেছইন না। তবে, আজখে তাইন নাও আইতা ফারইন।
– তাইলে আমি যাই গি… থোরা এখটু দরকার আছিল… আইচ্ছা।
– তে আর গর আউক্ক্যা। ভাইছাব নাই তো কিতা অইছে? আমরা নাই নি?
– না মানে….তাইন বাসাত নায় …
– আর মানে মানে খরইন না যে… গর আউক্ক্যা, চা খাইয়া যাইবা।

ইমাম অবশ্য মনে মনে এমনটিই চেয়েছিল কিন্তু চোখে মুখে অনিচ্ছা সস্তেও যেন বসতে হচ্ছে এমন একটি ভাব নিয়ে সে বসে পড়ে। এর আগেও যতবার সে এসেছে ততবারই বেশি সময় বসার জন্য রাবেয়াকে বিভিন্ন দোয়া শিখানো ও মাসলা মাশায়েল শেখানোর ফাঁকে বেশ গল্পগুজব করতেন। সে গল্প রাবেয়া মুগ্ধ হয়ে শুনত। শুনতে শুনতে নুরের চেহারার ঝিলিক দেখা যেত তার চোখে মুখে। রাবেয়ার ছেলেমেয়েরা সবাই তখন মোটামুটি ঘুমের ঘরে, কেবল নয় বছরের বড় মেয়ে পারুল ছাড়া। রাবেয়া পারুলকে চা করতে বলে সে নিজে বসে পান বানাতে বসে যায়।

চারদিকে থমথমে নীরবতা। কি মনে করে যেন ইমাম জয়নাল খাট থেকে নেমে রাবেয়ার হাত ধরে বলে- ভাবী, থাক আর কষ্ট করইন না যে। আপনে খালি অন বইয়্যা এখটু মাতলেও অইব। কথাটি বলেই সে, একরকম জড়িয়ে ধরেই খাটের দিকে নিতে চাইলো। রাবেয়া কেবল একটু ইতস্তত করল। রাবেয়ার প্রতিবাদহীনতা দেখে ইমাম দুহাত দিয়ে রাবেয়ার চিবুক ধরলেন। আশেপাশে মানুষ্য শব্দের লেশও নেই। গ্রামের মানুষজন যেমন প্রায় সন্ধ্যার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ে তেমনি শহরতলীর লোকেরাও। হয়ত একটু সময়ের তারতম্য ঘটে, তবে খুব একটা বেশি নয়।

ইমাম রাবেয়ার চোখে চোখ রাখে। তার শরীরে মুহূর্তেই বিদ্যুৎ ঢেউ খেলে যায়। মাথায় প্রাগৈতিহাসিক আদিমতা ভর করে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না ইমাম। রাবেয়ার ঠোঁটে ক্ষুধার্ত বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাবেয়া নিজেকে প্রাণপণে ছাড়িয়ে নিতে চায়, কিন্তু ইমামের শক্ত বাহুর ডোরে সে নিজেকে ছাড়াতে পারে না। কেবল ফিসফিসিয়ে বলে, ছি! আফনে ইতা খিতা খররা? ফুরি চা আনের! ইস! ছাড়ি দেউক্কা… ইস! … ইমাম সে কথার কোন পাত্তাই দিলেন না। এক এক করে তার হাত ঠোঁট উভয়ই চলতে লাগলো। রাবেয়া কাকুতি মিনতি করে বলছে- “ছাড়ইন না ভাইসাব, আফনার পায়ো দরি, ফুড়ির সামনে আমারে ছোট বানাইন না যে”!

রাবেয়ার এসব কথায় সে যেন আরও বেশি উৎসাহ পেল! ইমাম রাবেয়ার কাপড় খোলার চেষ্টা করে, এমন সময় চা নিয়ে রুমে প্রবেশ করে পারুল। ইমাম ও রাবেয়া দুইজনেই তখন খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। ইমাম রাবেয়াকে ছেড়ে দেয়। রাবেয়া ছাড়া পেয়ে লজ্জায়, ক্ষোভে খুব দ্রুত নিজের পায়ের জুতা খুলে ইমামের দুই গালে কষে দুই বাড়ি মারল। সেই সাথে মুখভর্তি থু থু নিক্ষেপ করল ইমামের মুখে। এখানেই শেষ নয়। এরপর শুরু হল শ্রাব্য-অশ্রাব্য ভাষায় গালি। সে কি গালি! “ইতরের বাচ্চা, বদমাশের বাচ্চা, লোচ্চার ঘরর লোচ্চা, চুতমারানির ফোয়া, তরে যদি আর কোনদিন আমার বাড়ির ত্রিসীমানাত ফাই- তাইলে এই জুতা দি তর গাল…!”

এরপর ইমাম জয়নাল আর একটি কথাও বলেন নি। পারুলের কথা তার মনেই ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় সে একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল কিন্তু রাগে গোখরা সাপের মত কেবল ফুলতে লাগলেন। মুখের উপর নিক্ষিপ্ত থুতু মুছতে মুছতে বের হওয়ার সময় বলে গেলেন, “ চুতমারানি মাগি, দেট টেকার বেটি- তরেও আমি দেকি লাইমু… কিলান তুইন তর জামাইর ভাত খাস!

ইমাম চলে গেলে, মা মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাইমাউ করে কাঁদতে লাগলো। রাবেয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে – মাইগো! আজখে যা অইছে ইতা দুনিয়ার খেউরে কইয়ো না। আমার কছম লাগের। কই বে নি গো মাই?

– না গো মাই, খইতাম নায়।
– যেদিন কইবে অউদিন কিন্তুক আমার মরা মুখ দেখবি।
– না গো মাই, খইতাম নায়। বিশ্বাস খর গো মাই। মুই জীবন থাখতে ইতা আর খেউর লগে মাততাম নায়। অউ তুমারে ছইয়া খইরাম রে গো।

এর প্রায় মাস খানেক পরের কথা। পারুল এলাকার আটদশজন ছেলেমেয়েদের মত মসজিদে কোরআন শিখতে যায়। অবশ্য সে আগে থেকেই যেত। গ্রাম-গঞ্জে মুসলিম শিশু সন্তানদের মসজিদে ধর্মীয় শিক্ষাদান যেন অঘোষিতভাবেই বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। পারুলের বান্ধবী মুন্নিও গেল তার সাথে। ওরা একই সাথে স্কুলেও পড়ে। জীবনবোধ সম্পর্কে হয়ত ভাল ধারণা ওদের জন্মেনি কিন্তু পুরুষের সুদৃষ্টি ও কুদৃষ্টি তারা বেশ ভাল করেই আঁচ করতে পারে। মসজিদে আমপাড়া পড়তে আসা স্থানীয় শিক্ষার্থীরা ইমাম জয়নালকে বড় হুজুর আর মুয়াজ্জিনকে ডাকতো ছোট হুজুর। পড়ার শেষ পর্যায়ে মুন্নির ডাক পড়ল দু’তলার বড় হুজুরের রুম ঝাড়– দেয়ার। মুন্নি একটু ইতস্ত করতে লাগলো।

মুয়াজ্জিনের তখন সেকি রাগ! বেত হাতে এগিয়ে আসে মারতে। তার কণ্ঠে ধর্মীয় ভয়ভীতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে যেমন বিরতিহীনভাবে জল গড়িয়ে পড়ে তেমনি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকেও এ মুহূর্তে যেন ধর্মীয় ভীতি বর্ষিত হচ্ছে! মুয়াজ্জিনের ধমকে ও ধর্মীয় ভীতিতে সব শিশুরা ভয়ে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মুহূর্তেই মনে হল সেখানে শ্মশানের মত নীরবতা বিরাজ করছে। মুন্নি ভয়ে সংকোচে উপরে গেল। মুয়াজ্জিন পারুলকে বলল নিচতলাটা একটু ঝাড়– দিতে।

মুয়াজ্জিন কখনোই তার সাথে খারাপ আচরণ করে নি। তবে তার সাথে খারাপ আচরণ করে নি বলে যে সে একবারেই ধোয়া তুলসিপাতা তা কিন্তু নয়। তার অপর এক বান্ধবী মুফলিহার মুখে মুয়াজ্জিন সম্পর্কে সে অনেক খারাপ তথ্য জেনেছে। কেবল লোকলজ্জা ও ধর্মীয় ভয়ে সে কখনো মুখ খোলে নি, এমনকি তাদের বাবা-মার কাছেও বলে নি। বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পারুল নিচ তলা ঝাড়– দেয়। পারুলের ঝাড়– দেয়া শেষ হয়ে গেলেও মুন্নি এখনো নিচে না আসায় বেশ বিব্রতবোধ করছে। অজনা ভয়ে একটু একটু ঘেমেও ওঠছে। সে নিজের ভেতর একটু সাহস সঞ্চয় করে সুউচ্চ কণ্ঠে ডাক দেয়- মুন্নি তর শেষ অইছে নি?

এর প্রায় মিনিটখানেক পরেই মুন্নি নিচে নেমে আসে। মুন্নির গাল ও ঠোঁট তখন বেশ লাল হয়ে ওঠেছে। অজ্ঞাত ভয়ে সে নিজের মধ্যেই যেন কুকড়াতে থাকে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের মত মুন্নি অসহায়ের দৃষ্টিতে পারুলের দিকে তাকায়। প্রতিবন্দীরা যেমন প্রতিবন্দীদের ভাষা বুঝে তেমনি ভুক্তভোগী পারুলেরও বুঝতে বাকী রইলো না উপরে কী ঘটনা ঘটেছে! শুধু মুন্নির হাত ধরে আস্তে করে বলল- “জলদি আয়। আইজ তাকি আর মচচিদে আইছ না। মারলেও আইছ না। আর হুন- ইতা কেউর লগে মাতামাতি করাত যাইছ না। বুচছত নি? একেবারেই ছোট্ট শিশুটির মত মাথা নেড়ে মুন্নি শুধু সায় দেয়। এরপর হাত ধরে ওরা বেরিয়ে যায়।

সেইদিন রাত্রে সাহস করে পারুল শহীদুলকে শুধু বলেছিল, “আব্বা, হুজুরের লগে বেশি মিশইন না যে। তাইন বেশি ভালা নায়। অনর বওত মানুষ তাইনরে খারাফ ফায়”। বলতে বলতেই ছোট পারুলের চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। পারুলের মুখে এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে শহীদুল একেবারে থ বনে গেল। ওর নিস্পাপ অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে শহীদুল আর কোন প্রশ্নই করে নাই। যা বুঝার সে এই কয়েকটি শব্দেই বুঝে নিয়েছে। পারুল কথাটি বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কোন নোটিশ ছাড়াই ইমাম জয়নালকে ছাটাই করা হল।

সমাজনীতি তার ভাললাগে না কেবল পেটনীতিই তার ভাললাগে। গান নিয়ে বেঁচে থাকতে ভাললাগে। তার গানের কণ্ঠস্বরও বাল্যকাল থেকেই ছিল বেশ ভাল। এলাকায় বিভিন্ন গানের প্রোগ্রামে তার বেশ সুনাম রয়েছে। তার এই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেও। গানের জন্য অনেক দূর থেকে মানুষ এসে তাকে বায়না করেও নিত।

শহীদুল দেখতে নাতিদীর্ঘ সুঠাম একজন মানুষ। বাউলদের মত এলোচুল। প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় রাতবিরাতে গানের প্রোগ্রাম থাকে বলে সংসারের সব দেখভাল সে করতে পারে না। তাছাড়া তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও পারিবারিক ইচ্ছেতে বিয়ে হওয়ার কারণে বউয়ের প্রতিও ছিল বেশ উদাসিন। এ নিয়ে রাবেয়া কোনরূপ প্রশ্ন করলে শহীদুল মুচকি হেসে বলতো- বাউল শিল্পীরা একটু উদাসিই হয়!

রাবেয়া কোনভাবেই তাকে সংসারমুখী করতে পারে নি। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাইরে বাইরে থাকতে থাকতে আর নানা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে সন্তানদের প্রতিও একসময় সে উদাসীন হয়ে পড়ে। তবুও জীবনের নিয়মেই যেন জীবন কেটে যায়।

রাবেয়া খাওয়া-দাওয়ায় তিক্ততা পোষণ করে। শুধু খাওয়া-দাওয়া নয় এখন তার জীবনের প্রতিই যেন তিক্ততা এসে গেছে। আজ আবার সে সকালে কয়েকবার বমিও করেছে। এমনিতেই সে খাওয়া-দাওয়া কম করে তার উপর কয়েকবার বমি হওয়ায় তার শরীরের অবস্থা অনেকটা নাজেহাল হয়ে পড়েছে। প্রতিবেশীদের সমালোচনায় শহীদুল জ্বরের প্রথম দিনই তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছিল। রাবেয়াই শহীদুলের কথাকে বেশ গুরুত্ব দেয় নি। আর দিবেই বা কি করে  আশে-পাশে যে ডাক্তাররা রয়েছে সবাই যে পুরুষ! হারিকেল জ্বালিয়েও বোধহয় এই খাদিমনগর এলাকায় মহিলা ডাক্তার পাওয়া মুশকিল!

রাবেয়া মনের দুঃখে সকাল বেলা শুয়ে শুয়ে নীরবে কান্নাকাটি করছে। এমন ক্ষণে বাড়ির পাশ দিয়েই ভাঙ্গারি ফেরিওয়ালা বেল বাজিয়ে জোরে হাঁক ছাড়ছে – এই ভাঙা টিন … ভাঙা হাড়িপাতিল ….। রাবেয়ার মন চলে যায় ভাঙ্গারি ফেরিওয়ালার উচ্চ হাঁকের দিকে। তার চোখের নীরব অশ্রু কখন যে থেমে গেছে সে হয়ত নিজেই বলতে পারবে না। বিষন্ন মনে সে অনেক কিছুই ভেবে চলছে। হায়রে! এই ভাঙ্গারিরা ভাঙ্গা টিন থেকে শুরু করে অনেক ভাঙ্গা জিনিসই নেয়, শুধু ভাঙা মন নেয় না।

রাবেয়ার ছেলেমেয়ে সাত জন। সব ছেলেমেয়েগুলো পিঠাপিঠি। বড় ছেলের বযস ১২ বছর। তার সন্তানেরা যতক্ষণ না খেলাধুলা করে তার চেয়ে বেশি সময় ঝগড়াঝাটি করে। সারাক্ষণই কোলাহলে মেতে থাকে। একজনের কান্না থামে তো অপর জনের শুরু হয়। সন্তানদের এরূপ কাণ্ডকারখানাতে সারক্ষণই যেন পরিবারটিতে নরকীয় ছায়া বিরাজ করে।

প্রতিবেশী শাহানা রাবেয়াকে পাঁচ বছর মেয়াদী নরপ্ল্যানের কথা বলতেই রাবেয়া শুধায়-“ইতা খিতা খও গো বইন… কোন ফল নষ্ট করা ঠিক নায়”।
– তাইলে ফেট কাটি আউ ।
– নাউজুবিল্লা! ইতা তুমি খিতা কও?

– কিতা কই মানে …ওত বাচ্চাইনতর ক্যাচক্যাচ গ্যাচগ্যাচ তোমার বালা লাগে নি? আবার ইতায় বড় অইতে না অইতেই আরবার বাচ্চা নিরায়! এরে হুনো, ইতারে ঠিক মত মানুষ খরতে না ফারলে কিন্তুক আল্লার কাছে ইখটার জোয়াব দিতে অইব!

– ইতা রে গো বইন তুমার চিন্তা খরা লাগত নায়। নিজর চড়খাত তেল দেও। …আর আমি বাচ্চাও আর খয়টা নিছি? আল্লায় দিলে আমি বাচ্চাইনতর বাগান সাজাইমু। বুচ্ছ নি?”

আজ শুয়ে শুয়ে এসব অনেক কিছুই সে স্মরণ করছে। হঠাৎ আবারও তার বমি ওঠে। মুখ তুলেই সে ওয়াক করে বমি করে। এভাবেই বেশ কয়েকবার পুনঃপুন চলতে থাকে। তার ওয়াক ওয়াক বমির শব্দ চারদিকে এক অস্বস্থিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে তোলে। রাবেয়ার বড় ছেলে মতিন পাশের কক্ষে জোরে জোরে হিন্দি ক্যাসেট বাজাছে। বেশ জোরে বললেও বোধহয় ভুল হবে। যাতে তার মায়ের ওয়াক ওয়াক বমির শব্দ তার কানে না যায় সে জন্য সে একটু জোরে টেপ বাজাচ্ছে।

হিন্দি ভাষা না বুঝলেও হিন্দি গানের তাল লয়ের প্রতি তার বেশ আসক্তি রয়েছে। অবশ্য মতিনের মত অনেক লোকই আছে যারা হিন্দি ভাষা বুঝে না তবু হিন্দি গান শুনে! রাবেয়া মতিনকে এই অসুস্থ শরীর নিয়েও কয়েকবার ধমক দিয়েছে। আজ তার শরীরটা বেশি খারাপ। নতুবা উঠে গিয়ে মতিনকে কিছু উত্তম মধ্যমও হয়ত দিত! মতিনেরই বা দোষ কী? ওর বয়স কম, বুঝেই বা কতটুকু? মানুষ স্বভাবতই স্পর্শকাতর। কান্না দেখলে যেমন অনেক সময় কান্না পায় তেমনি বমি দেখলেও বমির উদ্রেক হয়।

রাবেয়া মতিনকে গালি-গালাজ করতে থাকে। উচ্চ শব্দ সে পছন্দ করে না। তার ওপর আজ তার শরীর বেশি খারাপ! গালি চলতেই থাকে। গালির ধরন এমনই অশ্লীল যে সভ্য সমাজের কোন লোক সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করতে পারবে বলে মনে হয় না। ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে মতিন বলতে থাকে – ঔষধও খাইন না, মরইনয়ো না!

কথাটি শুনতে পেয়ে রাবেয়া আরও তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠল। কিন্তু তার শরীর বেশি দুর্বল বলে এর সমুচিত জবাব দিতে পারলো না। রাগে, দুঃখে রাবেয়া শুধু কাতরাতে থাকে। অজগর সাপ ভুল করে সজারু খেলে যে রকম কষ্ট হয় তেমনি কষ্ট হচ্ছিল তার! এমন কুলাঙ্গার ছেলে তার পেটে ছিল…ইত্যাদি ইত্যাদি। বেদনার নীল পাহাড় জমা হয় তার বুকে। ক্রমেই তার শরীর আরও দুর্বল হয়ে আসে। তার চিন্তাধারাতেও কেমন যেন স্তবিরতা দেখা যায়। অর্ধসংজ্ঞাহীন অবস্থায় ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের মত প্রলাপ বকতে থাকে।  শরীর বেশি দুর্বল বিধায় তা আর স্পষ্ট হয়ে ওঠে না।

এমন সময় ওয়াজের ক্যাসেট চালিয়ে টেপের বলিউম আরও বাড়িয়ে দেয়। মতিন জানে তার মা ওয়াজের ক্যাসেট সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। টেপে চালানো ওয়াজের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে চারদিকের দেয়ালে। ওয়াজের শব্দে রাবেয়া চোখ খুলে। ঘুম থেকে সদ্য জাগ্রত ব্যক্তির মত হাত দিয়ে চোখ কচলাতে থাকে। মুহূর্তেই অন্যরকম এক প্রশান্তি তার দেহ-মন আচ্ছন্ন করে ফেলে। রাবেয়া এখন নীরব। তার চোখে মুখে ক্ষোভের ছায়ার লেশও নেই। ক্রমেই যেন সে স্বাভাবিক হয়ে ওঠছে। সময় এগিয়ে চলে।