কমান্ডার যখন বেলাবো আসে তখনও বসন্তের কিছু কিছু ফুল অবশিষ্ট ছিলো। ওপরে গাবফুল, নীচে ভাঁট। বনজামের ছড়াছড়ি, লটকনের কুঁড়ি, কাঠালের মজি। আরো আছে কতো। বসন্তে কী না ফুটে, পায়ে পিষ্ট ঘাসও যে ফুল দেয়।
কমান্ডার, এইডা কী ফুলের গন্ধ?
মিয়ারা ছাইত্তাইন চিননা, তুমরা অইছো মুক্তিযোদ্ধা।
এহন ত রাইত, গাছ ত চোক্ষে দেহিনা, খালি না গন্ধ…
গন্ধ শুইংগাই শত্রু-মিত্র আলাদা করতে অইবো, সব চোক্ষে দেখতে পাইবা না।
কিন্তু ঠিক এর পরের রাতেই ছাতিমের গন্ধটা উটকো ঠেকে। কেউ যেন ওয়াক করে বমি করতে চাইলো। কমান্ডার ফিস্ ফিস্ করে বলে, হল্ট, হল্ট…।
কি ব্যাপার, রাস্তা কি ভুল করলাম?
না কমান্ডার একজন সহযোদ্ধা গাছটা জড়িয়ে ধরে বলে, এই তো আপনের ছাইত্তাইন বা ছাতিম গাছ।
ছাতিমের গন্ধ কি এমুন?
কমান্ডার, আধ মাইল দূরের ঐ গোপাটের পাশে আর্মিরা যে মানুষটা গুলি কইরা মারছিলো তা’ তিন দিন ধইরা পচতাছে। এইহানে আসতেই দমকা বাতাস নাকে বাড়ি দিলো।
ও। তা’ এই ফুলের গন্ধ থাইক্যা পচা গন্ধটারে আলাদা কর।
ক্যামনে কমান্ডার?
যেমনে পাকিস্তান থাইকা বাংলাদেশ আলাদা অইছে।
এহনও অয় নাই কমান্ডার।
করতে তো অইবো।
এ চ্যালেঞ্জ নিয়েই হারুনবাহিনী গড়ে উঠে। হারুনের সহযোদ্ধারা রাতেই লাশটা কবর দিয়ে আপাতত গন্ধটা দূর করে, কিন্তু আলাদা হয়না।
বেলাবো-শিবপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বেষ্টন করে আছে গাছ-গাছালী। শিমুল গাছগুলো সকন্টক দাঁড়িয়েছে রক্ষাব্যুহ তৈরি করে। কিন্তু একটি গাছের একাংশের পাতা ছেঁড়া। পরদিন ঝাঁঝালো রোদের আলোয় এক গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের দেখায় পাকিস্তান বাহিনী তাড়া খেয়ে কী ভাবে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। ঐ পাতাছেড়া ডালটার উপর অসংখ্য গুলি পড়ে শিমুলের বীজ ফেটে যায় এবং তুলা বের হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। যোদ্ধারা বলে, তাইলে এই আছিল শালাদের সাহস! শুয়োরের বাচ্চা চড়ুইয়ের আত্মা নিয়া যুদ্ধ করতে আইছে।
দিনে ওরা বের না হলেও আজ রাস্তাগুলো চিনে চিনে মুখস্ত করতে বিনা অস্ত্রে বের হয়ে আসে। এটাই কমান্ডারের নির্দেশ। অতঃপর রাত গড়িয়ে এলে শুরু হয় টহল। হারুনবাহিনী ক্যাম্প করার পর অঞ্চলটি এতোটাই মুক্তাঞ্চল হয় যে, এখানে মুক্তি ছাড়া অন্যরাও রাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। রাস্তায় অন্য কম্পানির কারো সাথে ক্রস্ হলে উভয়েই বলে উঠে, হ্যান্ডস্ আপ!
হারুন বাহিনীর কেউ একজন বলে, কই যাও?
শিবপুর ক্যাম্পে। সে পাল্টা প্রশ্ন করে, তোমরা কোনহানের?
বেলাবোর।
তোমাদের কমান্ডারের নাম কি?
তিন জন তিন রকম উত্তর দেয়:
মেজর হারুন।
পাগলা হারুন।
কমান্ডার হারুন।
ছেলেটি পাল্টা ঝারি দেয়, এই মিয়া, একজনের ৩ নাম অয় কি কইরা?
আমাদের কমান্ডারের এক কুড়ি নাম, এহন যাও, ভাগো।
ইপিআর-এর ল্যান্স নায়েক হারুনকে শৌর্য-বীর্যের কারণে জনগণ পদোন্নতি দেয় ‘মেজর’ হিসেবে। ময়মনসিংহের শেখ হারুন আস্তানা গাড়ে বেলাবোয়। এখানে তার বিশাল ক্যাম্প। যেন যুদ্ধের দামামার তালে জলে-হাওয়ায় ভেসে খড়কুটোর মতো এখানে এসেছে তারা। জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে তার কয়েক শ’ অনুচর। এলাকাবাসীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা জীবন-নাশের আশংকার ফাঁকে ফাঁকে এলাকার জোয়ানদের সাথে তাস-লুডু খেলে, চিড়া-মুড়ি-মাঠা খায়, কখনো রাতে হাঁসের ডিম আর কইমাছ দিয়ে আহার চলে। একজন মুক্তিযোদ্ধা চমক দেখাতে বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে আম পেয়ারা পারে মধ্যদুপুরে। একটা লিকলিকে গাছ থেকে ডাব ফেললে অন্যজন তা’ খাড়া বেয়নেটে বিঁধিয়ে নেয় বর্শার মতো। আবার পাড়ার ছোকরাদের দেখায় কীভাবে দাঁতে কামড় দিয়ে গ্র্যানেডের ড্যাটনেটর খুলে আনতে হয়। একজনের হাত নিশ্পিশ্ করলে একটা গুলি ছুটে যায়। কমান্ডার বলে, কি অইলো?
কিছুনা, ভুলে ছুইটা গেছে।
সাবধান কেউ আনমনা অইয়ো না, যুদ্ধে উদাসীন হওয়ার কুনু সুযোগ নাই। হারুনবাহিনীর কথা চাউর হয়ে যায় তামাম নরসিংদী-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ-জয়দেবপুরে।
আজ রাতে বাজিতপুর থেকে আসে দুর্ধর্ষ আনিসুর রহমান। রাত হতেই যোদ্ধারা বড়ো সাইজের একটা রেডিওকে ঘিরে গোল হয়ে বসে। কিন্তু রেডিওটা ঘ্যাড় ঘ্যাড় করে হঠাৎ থেমে যায়।
“আরে র্ধু, ভাই তাড়াতাড়ি করেন তো, একটু বাদেই চরমপত্র।”
“ম্যাকানিক্স সাব কই, ডাকেন তারে। বোমা বানানো খুব বুঝে, এইবার রেডিও ঠিক করুক।”
একজন বৃত্তের ভেতর জোর করে ঢুকতে ঢুকতে বলে দরকার নাই, দেহি…। বলেই জোরে একটা থাপ্পর দেয় যন্ত্রটির কাঠের শরীরে। এটি সচল হয়ে উঠে। তাৎক্ষণিক স্বাধীন বাংলা বেতারের গান বাজতে থাকে: বীর বাঙ্গালি অস্ত্র হাতে নেরে হাতিয়ার, প্রাণ নিয়ে যেন যায়না ফিরে দস্যু হানাদার…। একজন, সম্ভবত সিরাজ কী হাকিম বলে: এই তো আমি অস্ত্র ধরলাম তার হাত রাইফেলের বাটে মুঠো করে ধরা। আবার বলে, কিন্তু দস্যু হানাদার কই, কুথায় চালাই গুলি, বলেই ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ফেলে। তার সাথে হাসিতে যোগ দেয় অন্য ক’জন। একজন ধমক দিয়ে বলে রাখো হাসি, বন্ধ করো গান, অতো হাসি ভালা না। মুহূর্তেই সব নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে, বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনায় না।
কি অইছে ভাই, অতো ক্ষ্যাপলেন ক্যারে?
কমান্ডার রে জিগাই এহনও আমরা সবাইর হাতে অস্ত্র তুইলা দিতে পারি নাই। তাইলে যুদ্ধ করুম ঘা দিয়া?
“ও এই কথা? তা’ কমান্ডার জবাব দেইন।” একজন যোদ্ধার গলা শ্লেষাত্মক শোনায়।
কেবল একটিমাত্র কূপির আলোয় কমান্ডারের চোখ জ্বলজ্বল করে। বলে, আর একটু ধৈর্য ধর তোমরা। একটা অস্ত্র ভান্ডারের সন্ধান পাইছি, রশিদ ডাকাইতের বাড়ি।
কয়ডা অস্ত্র আছে?
আরে বহুৎ। বাঙালি আর্মিরা পাকিস্তানীদের অতর্কিত আক্রমনে সব অস্ত্র ভৈরব ব্রিজের কাছে ফালাইয়া দিয়া কুনু মতে জান বাঁচায়। সেইগুলা পরে নিয়া আসে রশিদ ডাকাইত, সবই চায়নিজ এলএমজি আর এসএমজি। চলো একদিন গিয়া নিয়া আসি। তা’ আনিস ভাই খবর কি? বাজিতপুরের খবর কইন?
মূসার জ্বালায় টিকা দায়।
কেডা এই মূসা? বহুৎ তো নাম শুনলাম।
সাক্ষাৎ আজরাইল। রূপকথার রাক্ষসের মত ভয়াল মূর্তি।
দেখতে ক্যামুন বুঝাইয়া কইন।
মানুষটা লম্বা পেশিবহুল। কালা শরীরে ৪টা উঁচা দাঁত বাইর অইয়া থাহে। কাপড়ও পরে সাদা লুঙ্গি আর শার্ট। কিরিচের খাপ রুপা দিয়ে বান্ধানো, সব সময় কোমরে গুঞ্জা দেওয়া থাহে।
তাতে ক্ষতি কি?
আরে রাইত কাডায় বেশ্যাপাড়ায়। যাওয়ার আগে ইন্দুভূষণের মালের দুকানে গলা পর্যন্ত বোঝাই কইরা যায়। বিনিময়ে এক পয়সাও দেয়না ইন্দুবাবুরে।
“ইন্দুবাবু যদি তারে মাগনা মদ গিলায় তাতে কার কি?”
“আরে পাকবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে সে মাইয়া সাপ্লাই দেয়।”
মাইয়ারা কি সব বেশ্যাপাড়ার, কমান্ডার পাল্টা প্রশ্ন করে।
না, গিরস্থ বাড়ির হিন্দু মাইয়া। তা’ছাড়া হিন্দুর দোকানের কতো কাপড়ের থান যে তার বাড়ি বোঝাই তা’ আর কইবার নাই। আছে তেল-ঘি-এর টিনও। সব লুট করা। তাদের মতো ঘরের শত্রু আছে বইলাই তো পাকিস্তানিরা বাড়তে পারছে। হাজার মাইল দূর থাইকা আইসা তারা কি রাস্তাঘাট চিনে? কমান্ডার, বাজিতপুরের জন্য কিছু করতে অইবো। একটা অপারেশন চাই।
অপারেশন। আপনেরা কমিনিস্টরা নিজেরাই তো পারুইন। আইচ্ছা তা’ দেহা যাইবোনে আনিস ভাই। আপনে দিনক্ষণ ঠিক কইরা খবর দিলে আমার কম্পানি অইহানে যাইতে পারে। আনিস চলে গেলে ২ দিন বাদেই হারুন কমান্ডার দলবল নিয়ে মরজালের কাছে রশিদ ডাকাতের বাড়ি ঘিরে ফেলে। ডাকাত বাড়ি নেই। তার কিশোর ছেলেকে ভয় দেখাতে উপরে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে ফেললে মা দৌড়ে এসে কমান্ডারের পায়ে পড়ে। বলে, বাবা আমার ছেরারে ছাইড়া দেও, যা’ চাও তাই পাইবা, অস্ত্রও সব দিয়া দিমু, এই ঘরের মাটির নিচেই আছে। হারুন কমান্ডারের দল ঘরের মেঝে খুড়ে সব অস্ত্র নিয়ে যায়। ভরদুপুরের অপারেশনে শ্রান্ত কমান্ডার মেঘনার পাড়ে আসতেই বিকেল হয়ে যায়। অদূরের আশুগঞ্জে আর্মি ক্যাম্প। কমান্ডার পাড়ে বসে জলবিয়োগ সারতেই চোখ যায় নদী বরাবর। বেশ দূরে দেখতে পায় জল ঠেলে ঠেলে সাঁতরে কিছু একটা এগিয়ে আসছে। কমান্ডার ভাবে গরুর পাল, কিংবা অন্য কিছু…। কিছুটা কাছে আসতে মাথার কালো চুল দৃশ্যমান হলো। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ওরা জানে-প্রাণে সাঁতরে আসছে। এরা কি তবে বউমাছ? কমান্ডারের চোখের ঘোর কাটে না। সারারাতের অনিদ্রায় চোখের কোনায় পিচুটিও জমেনি যে, তা’ সরিয়ে দেখতে হবে।
হঠাৎই পাড়ে উঠে গেলো একদল বিবস্ত্র মেয়ে মানুষ। তারা মেঘনা পাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত লাল বাড়িটিতে কোনো মতে সেঁধিয়ে যায়। হিন্দুর বাড়ি, তাই প্রাণভয়ে সব ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়েছে। বাড়ির বাইরে এসে উঁকি দিলেই নদীর ঐপাড়ে আশুগঞ্জের আর্মি ক্যাম্প দৃশ্যমান হয়, এখানে ক্যামনে থাকে লোকজন? জনমানবহীন বাড়িটিতে মেয়েগুলো ঢুকেই লোহার গেটটা বন্ধ করে দেয়। ঢুকবার পথে পেছন থেকে কমান্ডার দু’জনের গায়ের উর্ধাংশে দেখেছে এক চিলতে করে কাপড়, একজনের শতছিন্ন ব্লাউজ, একজনের নিম্নাংশের একটি সায়া, বাকী ৮জনই সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন। হারুন কমান্ডার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা, ঔৎসুক্য নিবারণের জন্য বাড়িটির ভেতরে ঢুকতে চায়। কিন্তু বারবার দরোজায় ধাক্কা দিয়েও সাড়া মিলছে না। অবশেষে দলেরই একটি ছেলের ঘাড়ে পা রেখে কোনো মতে দেয়াল টপকায়। কমান্ডার চিৎকার করে বলে, বোনেরা তোমরা বের হয়ে আসো, শুনি তোমাদের বেত্তান্ত, আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমি-আমরা তোমাদের ভাই, তোমরা বের হয়ে আসো…
দরজার কাছে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বলে কি কইরে আইয়াম, আমাদের গায়ে যে…
কমান্ডার বলে, দেখো একটা কাঁথা-চাদর পাইলে তা’ গায়ে জড়াইয়া নেও।
একটি মেয়ে বের হয়ে আসে, গায়ে তার কমান্ডার নির্দেশিত কাঁথা জড়ানো। তার গালে ক্ষত। দীর্ঘ সাঁতারে মুখের ঘা সাদা বেলিফুলের মতো ফুলে উঠেছে।
তোমার মুখে কি?
নির্যাতনের চিহ্ন।
কইত্থে সাঁতরাইয়া আইলা?
আশুগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প থাইকা। বাংকারে আমাদের ১১জনরে সম্পূর্ণ ন্যাংটা রাখা হইছিলো, যাতে পলাইতে না পারি। তাও আমরা সাঁতরাইয়া পলাইয়া আইলাম। ভাবলাম আব্রুর চাইতে জীবন বড়ো।
হ’ বইন।
ইতিমধ্যেই ওদের পাঁচ-ছয়জন কেউ গায়ে মশারি, চাদর, কেউ পুরুষের লুঙ্গি, এমনকি একজন ছালা জড়িয়ে কমান্ডারের সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন কোনোমতে বুক ঢাকতে পারে দু’ হাত দিয়ে, নিজের দু’ স্তন চেপে ধরে রেখেছে। তার কাঁধ উদাম। উরুর নিচ থেকে তার সারা পা’ দৃশ্যমান। সেই ভেজা পায়ে একটা রক্তরেখা গড়িয়ে নামছে। সে কি বজঃস্বলা, নাকি অন্তরালের কেনো ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে? কমান্ডার বোঝে গালে কোনো নেকড়ের কামড়ের দাগ, যা’ জলের ঝাপটায় সাদা দগদগে হয়ে আছে। কারো হয়তো পুঁজে পূর্ণ।
কমান্ডার বলে, সবাইরে আসতে বলো। ওদের একজন ঘরে ঢুকেই আবার বের হয়ে আসে, বলে ভাইজান বাকী আছে ৪জন, তারা এহনও গায়ে জড়ানোর কোনো কাপড় খুঁইজা পায় নাই।
হায় আল্লাহ্, কমান্ডারের দীর্ঘশ্বাস।
তোমার নাম কি বইন?
– দিপালী।
বাড়ি?
– বাজিতপুর, পালপাড়া।
তোমার নাম?
‘কুন্তলা’। সে সুন্দরী।
তোমার?
সরস্বতী।
সবাই বাজিতপুরের?
হ’ দাদা। জালিম মূসা আমরারে ধরাইয়া দেয়।
একটি মেয়ে পেছন থেকে এগিয়ে এসে বলে: আমি মূসারে ৬ হাজার টেহা দিছি, সোনারুপা মিলাইয়া অলংকার দিছি আধাসেরের মতো। তাও সে আমারে ধরাইয়া দিলো। জিনিস ফেরৎ দিতে বল নাই?
তা’ কেমনে?
শুয়রের বাচ্চা! কমান্ডার দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি উচ্চারণ করে।
তা’ তোমাদের অতো দূর ক্যামনে আনে?
সরারচর স্টেশন থাইক্যা মালগাড়ির ডাব্বাতে কইরা হাত বাইন্ধা আমরারে চালান করে।
কমান্ডার আর কোনো কথা বলতে পারেনা। সন্ধ্যার পর এদের এগার জনকে নিয়ে এসে বেলাবো পাঠায় চিকিৎসার্থে। কিন্তু কমান্ডারের মন শান্ত হয়না। তার ডান হাতের তর্জনী ট্রিগারে চাপ দিতে কেবলই নিশ্পিশ্ করে। কিন্তু বাজিতপুর থেকে কোনো খবর আসছে না।
বাজিতপুরের খবর না আসলেও পাশের অঞ্চল নিকলী থেকে আসে ভরসা ডাকাত। বেলাবোর আবদুল হাই মাস্টারের বাড়িতে কমান্ডারের সাথে সাক্ষাৎ হলে ভরসা বলে, আমারে খবর দিছিলেন স্যার? কী কারণ, বলেন তো।
বলতে চাই যে, এইসব এইবার ছাড়ো। দ্যাশের জন্য কিছু একটা করো। তুমি আজই বাড়ি ফিইরা যাও। আমার লোকজন তোমারে ১৭টা রাইফেল, ৩ বাক্স গুলি আর ১২টা গ্রেনেড বুঝাইয়া দিবো। এ কথা বলে কমান্ডার ঘরের ভেতরে যায়। বাহির বাড়িতে আবদুল হাই মাস্টার নিজে ভরসা ডাকাতকে আদ্যপান্ত বুঝিয়ে বলেন: বুঝলানা মিয়া, দ্যাশের জন্য যুদ্ধ করো। কমান্ডার হারুন তোমার শক্তির কথা জানে, তাই তোমারে সে মূল্য দেয়।
কিন্তু এই মূল্য দেয়ার জন্য পরে হারুনকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এক সপ্তাহ পর একজন যোদ্ধা এসে বলে: কমান্ডার, আপনে এক ডাকাতের অস্ত্র আইনা আর এক ডাকাতের হাতে তুইলা দিলেন?
আরে রাখো তোমার ডাকাত। দ্যাশটা ডাকাতেরও মা। যুদ্ধের সময় কোনো চুর-ডাকাত নাই। বরং ডাকাত আরো ভালা, তার ট্রেনিং আগেই তো দেওয়া আছে, ট্রিগার টিপতে সে আমাদের চাইতে ভালা জানে। শুন, দেশের জন্য যে অস্ত্র ধরে, সেই আমাদের বন্ধু। শুনছি ভরসা ডাকাত এহান থাইকা গিয়াই ধূলদিয়ার পোয়া মাইল জুইড়া রেললাইন তুইলা তাতে ধানগাছ লাগাইয়া দেয়। এহন পাকবাহিনী কতো বেকায়দায় দেহ।
যোদ্ধাটি বলে, চলেন বাজিতপুর অপারেশনে গেলে ভরসার কাছ থাইকা সব শুইনা আসি যদি তারে পাওয়া যায়।
তারে পাই বা না পাই, বাজিতপুর যাইয়াম কবে সেইডা তো জানিনা।
খবর পাইছি। আগামী মঙ্গলবার।
মঙ্গলবার ভোরে রওনা দিয়ে তারা পৌঁছায় বিকালে, সরারচর। ২৫জনের একত্রে ২৫ মাইল পাড়ি। রাস্তায় কেবল আউশ ধানের ক্ষেত। পথে ক্ষিদেয় পেট চুইচুই করেছে। এক দোকানে পায় মাত্র ৩ পোয়া চিড়ে। তাতে কি ২৫জনের হয়? খাবার না থাকলেও গোলাবারুদ আছে প্রায় ২০০ জনের। সরারচরের যে বাড়িটিতে তারা আশ্রয় নেয় তা’ রেল স্টেশনের অতি কাছে। স্টেশনে পাকবাহিনীর হাঁটাহাঁটি, টহল, বেঞ্চে বসে চা খাওয়া দেখে ওরা ক্ষণে ক্ষণে আঁৎকে ওঠে। স্টেশনের পাশের জলাটায় জলডাটা লকলকিয়ে উঠেছে। আঁতকে উঠার মতো এ গুল্মেরও অগ্রভাগ বাতাসে নড়ে চড়ে উঠে। এক সেনাকে স্টেশনের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করতে দেখে যা’ ওদের ঘরের খুবই নিকটে। একজন বলে: স্যার, ব্যাটারে মাইরে অস্ত্রটা নিয়া আসি?
কমান্ডার বলে: না, তাতে আসল উদ্দেশ্য ভেস্তে যাইবো। তার চেয়ে বরং আল্লা আল্লা করো, তাড়াতাড়ি সন্ধ্যাটা হোক। আচ্ছা, এইডা তো মুসলিম লীগের মেম্বারের বাড়ি। তিনি এহন কুথায়?
শুনলাম ভয়ে পালাইছেন। যদি ক্যাম্পে গিয়ে বলে দেয়?
সে আশায় গুড়ে বালি। বাড়ির সবাইরে আমরা একঘরে বন্দী কইরা রাখছি। সংবাদটা তার কানে পৌঁছছে, কোনো তথ্য ফাঁস হইলে সবাইরে মাইরে আমরা চইলে যাবো।
কিন্তু সন্ধ্যা যে হয়না। হ্যাঁ, সন্ধ্যা হয়না। জ্যৈষ্ঠাষাঢ়ের দীর্ঘদিন। অতি কাছে শত্রু। এরই মধ্যে মুক্তিদের আগমন সংবাদ শত্রু শিবিরে পৌঁছেছে কিনা তা-ই বা কে জানে? সারাদিন যোদ্ধারা এই বাড়িতে থেকে আশেপাশের কতো কিছু অবলোকন করে। দেখে শিবনাথ স্কুলের ক্যাম্প থেকে একজন পাকসেনা এসে স্টেশনের খোলা সেলুনে বসে। তার সারা মুখে ক্ষৌরকর্ম শেষ হলে গোঁফে কাঁচি চালাতে বলে। রাইফেল তার কোলের উপর। ক্ষৌরকার গোঁফ ছেটে দিলে দুই হাতের বৃদ্ধা ও তর্জনী দিয়ে সে গোঁফ পাকাতে থাকে। সারা গাল জুড়েই গোঁফ। এক পর্যায়ে ধূমপান করলে ওরা যেন স্পষ্ট দেখছে ধূয়া গোঁফের ভেতর দিয়ে কুয়াশার মতো উপরে উঠে যাচ্ছে। সেনাটি ফর্সা, গাল দু’টো রক্তিম। অবশেষে নরসুন্দর এককোনা ভাঙ্গা একটি বড়ো আয়না তার মুখের সামনে মেলে ধরে। সে মৃদু হেসে কিছু একটা বলে। হয়তো ‘বহুৎ আচ্ছা’। হারুনবাহিনীর একজন থ্রিনটথ্রিতে হাত দিয়ে বলে: দিমু নাকি শালারে শেষ কইরা। কমান্ডার এবারও তাদের নিবৃত্ত করে। বলে, আমার বাইরের শত্রুর দরকার নাই। আগে ঘরের শত্রু খতম কর। ঘরে কোনো শত্রু না থাকলে বাইরের শত্রু এমনি এমনিই ভাগবো।
কিন্তু কুত্তার বাচ্চা নাপিতরে পয়সা না দিয়াই গেলোগা।
তারা ত মনে করে দেশটা তাদের। তারা আছে আমাদের খেদমতের লাইগা…
পাকিস্তানিরা যা’ বলে আর কি!
গরীব নাপিত সারাদিন কয় পয়সা পায়। আর যুদ্ধের সময় কাস্টমার কই?
তখন ঘোর সন্ধ্যা নেমে আসে। খবর আসে যে, এলাকার যুদ্ধ সংগঠনকারীরা প্রস্তুত। রাত ঘনিয়ে এসে অন্ধকার দানা বাঁধলে আর্মি ক্যাম্পের অনেক দূর দিয়ে তারা ফসলের মাঠ পেরিয়ে সি.এন্ড.বি রোডে উঠে। শুরু হয় আবার পদযাত্রা। ওরা লাইন ধরে হাঁটে পাকা রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে। সরিষাপুরের মুহম্মদ বাকের, নোয়াপাড়ার আনিসুর রহমানসহ এলাকার অনেকেই দলের সাথে যুক্ত হয়। সরিষাপুর গ্রামে এসেই আক্রমণের মূল পরিকল্পনরা আঁটে কমান্ডার। তবে ধীরে গ্রামে জন্ম নেয় একটি গোমট হাওয়া, দম বন্ধ হওয়ার মতো। আমরা মুক্তিদের আশ্রয় দিলাম, হানাদার বাহিনী শুনতে পেলে পুরো গ্রামটাই মিসমার করে দেবে।
এমনিতেই এই গ্রাম হানাদারদের দীর্ঘদিনের টার্গেট। একে একে জোয়ানরা এসে কমান্ডারকে ঘিরে দাঁড়ায়। এই দলে বাকের ছাড়াও আছে হাসান, মেনু, রেদোয়ান, ইসহাক, মান্নান, আক্কাস, শাহ্জাহান, হাবিব ও অন্যরা। হারুন কমান্ডার তাদের বোঝায়, কিন্তু ভীতিটাই যেন পুরো গ্রামকে তাড়া করে। অনেক বোঝানো হলো যে, বাজিতপুরকে জনগণের জন্য নিষ্কন্টক করতেই আমাদের এ পরিকল্পনা। কিন্তু তারা বুঝ মানলে তো। হঠাৎই কমান্ডার হুংকার দিয়ে উঠলো আমি এই গেরামের উত্তর মাথা থাইক্যা দক্ষিণ মাথা পুরাটাই জ্বালাইয়া দেম। এহন আর পিছন ফিরবার উপায় নাই। কত কষ্ট কইরা আইলাম বেলাবো থাইক্যা, খালি হাতে ফেরৎ যাই কেমনে? ওরা লক্ষ্য করে কমান্ডারের দু’চোখের মণিতে জ্বলজ্বলে আগুনের পি-, যেন এগুলোই বিস্ফোরিত হয়ে এখনই পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। তারা উপায়ান্তর না দেখে বলে: কেমনে আমরা যাইবাম আপনের লগে, আমরার ত ট্রেনিং নাই। হ, হেই কথা কইন। ঠিক আছে, আসেন দেহাই কেমনে সংকেতের সাথে সাথে খাড়া থাইক্যা বইয়া পড়তে অয়। কমান্ডারের নির্দেশে সবাই লাইন ধরে দাঁড়ায়, আবার ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়। কমান্ডার হিশশ্… শব্দ করতেই সবাই বসে পড়ে, অতঃপর হামাগুড়ি দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়। আবার ওঠে।
দু’মাইল আসতেই নিতারকান্দির শ্মশান। মরা পোড়ার গন্ধে একজনের উটকি আসে। কিন্তু পাশাপাশি ভূত দেখার মতো কাউকে দেখে সে আঁৎকে ওঠে। গন্ধটি সে ভুলে যায়। কেউ বুঝতেই পারেনা কীভাবে কখন তাদের সাথে রাস্তার ডানপাশে একটা লোক যোগ দেয় হ্যারিক্যান হাতে। যেন সে-ই তাদের পথপ্রদর্শক। কিন্তু রহস্যময় মানুষটি তাদের আগে আগে হাঁটে। দ্রুত হাঁটায় ডানপাশের হ্যারিক্যানটা দুলছে আগে-পিছে। মুক্তিরা কিছুতেই নিরবতা ভাঙ্গবে না। তাই ওকে ডাকেওনা। দলের একজনের পায়ে স্যান্ডেলের চটর চটর আওয়াজ ওঠায় কমান্ডার বলে, কেডা জুতা পইরে আছে, খুইলা ফেলো। হারিক্যানওয়ালা ডানে মোড় নিয়ে একপ্রকার দৌড়ের ভঙ্গিতে হাঁটছে।
কমান্ডার বলে, আনিস ভাই, আমার কিন্তু সন্দেহ হয়। হয়তো সে মূসার লুক। সারাদিন রেকি করছে। এহন বাড়িতে গিয়াই খবরটা দিয়া ফালাইবো।
বাড়ির কাছে আসতেই লোকটা ‘এই মূসা এই মূসা’ বলে এক দৌড়ে দেউড়ি পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকে। মুক্তিরা তাৎক্ষণিক বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তাদের উপর্যুপরি ডাক আর দরজায় লাথিতে মূসা দরজা খুলেই আনিসুর রহমানকে কিরিচ দ্বারা আঘাত করে। ক্ষিপ্র গতিতে কিরিচ মুঠো করে ধরে ফেললে দু’পাশেই ধার থাকায় হাত কেটে রক্ত ছুটে ফিনকি দিয়ে। ঐদিকে হারুন কমান্ডারের গুলিতে মূসা তখনই লুটিয়ে পড়ে। মুক্তিরা দেখে এতোবড়ো ঘর লুটের মালে ঠাসা হয়ে ঘরের আয়তন ছোট হয়ে এসেছে। স্বাচ্ছন্দে হাঁটাচলারই জায়গা নেই। একজন রাগ সামলাতে না পেরে দিয়াশলাই-কাঠি বাড়ি দেয় ঘ্যাচ করে। পুড়তে থাকে থান কে থান কাপড়। মুক্তিরা বের হয়ে আসতেই আগুন দাউ দাউ জ্বলে ওঠে। চালার উপর নুয়ে পড়া গাছ থেকে পাখিগুলো উড়াল দেয় দিকবিদিক।
আগুনের লিকলিকে জিহ্বা উর্ধ্বমুখী হতেই কমান্ডার সামরিক কায়দায় সৈন্যদের নির্দেশ দেয়: অ্যাবাউট টার্ন!
গোলাম শফিক
জয়েন্ট সেক্রেটারী, বাংলাদেশ টেলিভিশন