কিশোরগঞ্জে হামলার খবরটা পেয়ে মনটা খুব বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছে। রাতে ঠিক করে ঘুমাতেও পারলাম না।  সত্যি কথা বলতে কি, কিশোরগঞ্জের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কিন্তু আমার খুব একটা নেই। ছোট থেকেই আমি কলকাতায়। মাত্র একবারই গিয়েছি কিশোরগঞ্জে। সেও খুব ছোটবেলায়। সে সময় কিশোরগঞ্জকে কেমন দেখেছি, তা খুব একটা মনেও নেই। কিন্তু কিশোরগঞ্জে না গিয়েও সে শহরের সঙ্গে যোগাযোগ যেটা ছিল, সেটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগের চেয়েও অনেক বেশি। কারণ, বাবা আর কাকার মুখে নিরন্তর শুনতাম ওই শহরটার কথা। কলেজ জীবন থেকেই বাবারা কলকাতায়। কিন্তু তখনও কলকাতার ঠাঁইকে বাবারা বাসা বলতেন, আর কিশোরগঞ্জকে বলতেন বাড়ি। পরে পেশার সূত্রে স্থায়ী ভাবে কলকাতায় থাকা শুরু বাবাদের। কিন্তু তাঁদের গল্প-গুজবে, কথাবার্তায় কিশোরগঞ্জ বার বার উঠে আসত। এই ভাবেই ওই শহরটার একটা নিখুঁত ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল আমার মনে। আমার মনে হত, কিশোরগঞ্জের সব রাস্তাঘাটও আমার চেনা। এক বার সেখানে গেলে নিজে নিজেই চিনে চিনে সব জায়গা খুঁজে নেব।

আমার মেজো কাকা অর্থাৎ নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আত্মজীবনী ‘অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’-এও কিশোরগঞ্জ উঠে এসেছে খুব বড় জায়গা নিয়ে। বইটাতে একটা গোটা অধ্যায় রয়েছে কিশোরগঞ্জ সম্পর্কে— ‘মাই বার্থ প্লেস’। এই অধ্যায়টা যখন মেজো কাকা লিখছেন, তখন তিনি দিল্লিতে। ১৯৪৭ সাল। দৈবক্রমে আমিও তখন কাকার ওখানেই ছিলাম। আমার বয়স তখন ১৫-১৬। রোজ সকালে উঠেই কাকা লিখতে বসে যেতেন। সে আমলের টাইপ রাইটারে খট খট আওয়াজ তুলে লিখতেন। বেশ খানিকটা করে লেখার পর, আমাকে পড়ে শোনাতেন। লম্বা লম্বা প্যাসেজ পড়ে শোনাতেন কাকা, ইংরেজিতে লেখা। অসাধারণ বর্ণনা। আসলে আমার বাবা অর্থাৎ চারুচন্দ্র চৌধুরী এবং মেজো কাকা নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মধ্যে সম্পর্কটা খুব নিবিড় ছিল। দু’জনেই দু’জনকে খুব ভালবাসতেন। মেজো কাকা আত্মজীবনীর সেই অধ্যায়ের লম্বা লম্বা প্যাসেজগুলো আমাকে পড়ে শোনানোর পর বলতেন, ‘‘বাবাকে বলবে, কিশোরগঞ্জ নিয়ে এইটা লিখেছি।’’ আসলে আমাকে শোনানোর মাধ্যমে মেজো কাকা বাবাকেই শোনাতে চাইতেন ফেলে আসা জন্মভূমি সম্পর্কে নিজের অনুভূতিগুলো। সেই সুযোগে আমারও কিশোরগঞ্জকে চেনা হয়ে যেত আরও খানিকটা, আরও অনেকটা আপন হয়ে উঠত শহরটা।

বাবা-কাকারা একত্র হলে তো পূর্ববঙ্গের ওই ছোট্ট শহরটাকে নিয়ে কথার ঝাঁপি খুলে যেত। মনে হত, ওই ছোট্ট শহরটার মধ্যে বিরাট একটা জগৎ লুকিয়ে রয়েছে। অভাবনীয় সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি। আমি শুনতাম আর আশ্চর্য হতাম! বাবা-কাকারা সেই যুগে ওই কিশোরগঞ্জের মতো একটা ছোট্ট শহরে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করতেন। মিল্টন পড়তেন, শেক্সপিয়র পড়তেন, হোমার পড়তেন! সে সব নিয়ে এবং আরও অনেক বিষয় নিয়ে লেখালিখি করতেন। তাও আবার ইংরেজিতে। সেই যুগে পূর্ববঙ্গের কোনও এক সুদূর এলাকায় থেকে, সেখানকার স্কুলে লেখাপড়া করে, কী ভাবে অত ভাল ইংরেজি তাঁরা লিখতেন, আমি আজও ভেবে পাই না।

কিশোরগঞ্জ নিয়ে বাবা-কাকাদের মুখে যা শুনেছি, তাতে কখনও ভাবিনি এমন মর্মান্তিক হানাহানি সেখানে হতে পারে। ওঁরা যা বলতেন, তাতে এমন সঙ্কটের কথা কখনও শুনিনি। ইদের সময় সবাই মিলে আনন্দে মেতে উঠতেন সেখানে। হিন্দু পরিবার হলেও, ইদের জন্য সারা বছরের অপেক্ষা থাকত আমাদের কিশোরগঞ্জের বাড়িতে। বাবার কাছে শুনেছি, ইদের দিন সকালে খুব উৎসাহ নিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকতেন তাঁরা। সকাল সকাল নতুন জামাকাপড় পরে মানুষজন যখন ইদগাহের দিকে হেঁটে যেতেন, তখন তাঁদের মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি থাকত, একটা ভক্তির ভাব থাকত। মুসলমান ঘরের ছোট ছোট শিশুদের মুখেও সেই অদ্ভুত প্রশান্তি দেখা যেত ইদের নমাজ পড়তে যাওয়ার সময়। ফেরার পথে তাঁরা হাসি মুখে, খুশিতে উজ্জ্বল, উচ্ছ্বল হয়ে ফিরতেন। তার পর গোটা শহর উৎসবে মেতে উঠত।

আবার দুর্গোৎসবের সময় বা হিন্দুদের অন্যান্য উৎসবে মুসলমানরাও একই রকম ভাবে মেতে উঠতেন।

মেলা বসত কিশোরগঞ্জে। বড় বড় হাট বসত। সেখানে বই বাঁধাইয়ের দোকান বসত। অনেক মৌলবী সেখানে কোরান বাঁধাই করতে যেতেন। অন্য ধর্মের বাঁধাইওয়ালার হাতে কোরান দেওয়া যাবে না, এমন ভাবে কেউ ভাবতেন না।

মেজো কাকার আত্মজীবনীতে পড়েছি কিশোরগঞ্জের নদীটার কথা। একটা ছোট নদী। কিন্তু সে নদী আমার বাবা-কাকাদের খুব প্রিয় ছিল। ওই নদীটার যে দিকটায় আমাদের বাড়ি ছিল, কাকার লেখায় পেয়েছি, সেই দিকটাতেই ছিল সংস্কৃতির পীঠস্থান। নদীর অন্য পাড়ে একটু বাজার বাজার এলাকা।

আমার কাছে কিশোরগঞ্জ মানেই এই সব স্মৃতি। তেমন একটা না গিয়েও শহরটাকে একেবারে আপন ভাবার স্মৃতি। কখনও কোনও দাঙ্গা-হাঙ্গামার কথা শুনিনি। উগ্র ধর্মান্ধতা, জঙ্গিপনার কথা কখনও শুনিনি। আমার ইতিহাসবিদ পুত্র সুগতর কাছে অবশ্য কিশোরগঞ্জ রায়ট্‌স-এর কথা শুনেছি। ১৯৩০ সালের ঘটনা। তার প্রেক্ষিতটা কিন্তু ভিন্ন ছিল। ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট হয়েছিল সে সময়। তাই গরিব মানুষ আর কৃষকদের সঙ্গে মহাজনদের সংঘর্ষ হয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় ওই এক বারই বোধ হয় হিংসাত্মক ঘটনায় জন্য নাম এসেছে আমাদের কিশোরগঞ্জের। বাকিটা শুধু সহৃদয়তার স্মৃতি, সংস্কৃতিমনস্কতার স্মৃতি।

আমার মামার বাড়ি ঢাকায়। ঘটনাচক্রে আমার জন্মস্থানও ঢাকা।  মায়ের কাছে শুনেছি, ঢাকায় অশান্তি হত।  দাঙ্গা-হাঙ্গামায় মাঝে-মধ্যে অশান্ত হয়ে উঠত ঢাকা। আবার থেমেও যেত। কিন্তু কিশোরগঞ্জ সম্পর্কে বাবাদের মুখে তেমনটা শুনিনি কখনও।  উল্টোটাই বরং শুনে এসেছি বার বার।  সেই কিশোরগঞ্জে যে ঘটনা ঈদের সকালে ঘটল, তা আমাকে খুব আঘাত করেছে।  না চিনেও খুব কাছ থেকে চিনি যে শহরটাকে, তার সঙ্গে এই কিশোরগঞ্জকে মেলাতে পারছি না।

‘অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ প্রকাশিত হওয়ার পর সে বইটি আমাকে মেজো কাকা উপহার দিয়েছিলেন। তাতে আমার উদ্দেশে দু’চার কথা লিখেছিলেন। ‘ডিয়ার কৃষ্ণা’ বলে শুরু করেছিলেন লেখাটা। সেই কথাগুলো আজ খুব মনে পড়ছে। মেজো কাকা লিখেছিলেন, ‘‘…আমরা হেঁটেছি বিশ্বাস নিয়ে। তোমরা হাঁটবে আনন্দ আর আশা নিয়ে।’’ আজ মনে হচ্ছে মেজো কাকা থাকলে, বেশ কষ্টই পেতেন। আমরা আনন্দ আর আশা নিয়ে হাঁটব, এ বিশ্বাস তাঁর ভেঙে যেত।

(লেখক: প্রাক্তন সাংসদ এবং সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবারের সদস্যা)
সুত্রঃ ৮ জুলাই ২০১৬ / কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দ বাজার পত্রিকা