গরিলা শিশু ‘ডিজিট’ সন্তানের মতোই আদর-সোহাগে বেড়ে উঠছে এক নিঃসন্তান দম্পতির কোলে। ফ্রান্সের পিয়েরে ও এলিয়ান থিভিলোঁর গরিলার প্রতি অবিশ্বাস্য ভালোবাসার গল্প। ৪৩ বছর আগে জোড়া বেঁধেছিলেন পিয়েরে ও এলিয়ান থিভিলোঁ। সংসার পেতেছেন ফ্রান্সের পশ্চিম লিয়ঁর পাহাড়ি অঞ্চলে। এত বছর পেরিয়ে গেলেও ফরাসি এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। আবার ঠিক নিঃসন্তানও তাঁদের বলা যায় না।
৮০ কেজি ওজনের ‘ডিজিট’ই তাঁদের সন্তান। ১৩ বছর আগে দত্তক নেওয়া গরিলার এই বাচ্চাটি পরম মমতায় বেড়ে উঠছে থিভিলোঁ পরিবারে। এই দম্পতিও ডিজিটের সঙ্গে সন্তানের মতোই আচরণ করছে। ডিজিটের প্রতি থিভিলোঁ দম্পতির টান এতটাই যে, গত ১৩ বছর ধরে বাড়ির বাইরে কোথাও যাননি তাঁরা। একটি রাতও ডিজিটকে চোখের আড়াল করেননি। তাঁদের কোনো ছুটির দিন নেই, নেই বাড়ির বাইরে নিশিযাপনের অবসর, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেখতে যেতে পারেননি কোনো সিনেমা। কারণ তাঁরা না থাকলে সন্তানের যে মন খারাপ হবে! তার মন খারাপ হলে এই বুড়ো-বুড়ির মনও যে অনেক খারাপ হয়। ডিজিটকে জন্ম না দিলেও, তাদের হৃদয়জুড়ে যে শুধু সে।
বন্যরা তো বন্যই থাকে, তারা তো আর মানুষ হতে পারে না। কখন কী বিপদ ঘটায় তার কোনো ঠিক আছে_এসব কথায় খুব আপত্তি ডিজিটের বাবা পিয়েরের। ডিজিটের সঙ্গে এক যুগের বেশি কাটিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু কখনোই ভয় পাননি তিনি। একদিন ডিজিটের দাঁতে আনারস আটকে গিয়েছিল। খুব অস্বস্তি নিয়ে হা করে পিয়েরের কাছে হাজির হয় ও। কোনো সংশয় ছাড়াই হাত দিয়েই ওর দাঁত পরিষ্কার করে দেন তিনি। তখনো ডিজিটের অভিব্যক্তিতে আক্রমণাত্মক কিছু ছিল না_’আমি তার ইশারা বুঝতে পারি। তারও আমাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। এমনকি কখনো কঠিন কোনো বস্তু তার হাতে গেলে, সে তখনই আমার কাছে সেটা নিয়ে আসে।’
থিভিলোঁ দম্পতির আদর পেয়ে পেয়ে ডিজিটও বেশ আহ্লাদি হয়ে উঠেছে। বেলা করে ঘুমোনো আর পানি নিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করা তার খুব পছন্দ। কখনো যদি ভুল করেও ভোরবেলা ঘুম ভাঙানো হয়, তাহলেই সেরেছে! ডিজিটের চেঁচামেচিতে পুরো বাড়ি মাথায় ওঠে। ডিম ও মাখনের তৈরি নরম রুটি আর দুধ মেশানো কফি পেলে ঠাণ্ডা মাথায় ডিজিট সেরে নেয় সকালের নাশতা। রাতে বেশি করে পিঁয়াজ দিয়ে রান্না করা ঝাল খাবার আর সস ছাড়া অন্য কোনো খাবার তাঁর মুখেই ওঠে না। পিয়েরে ও এলিয়ানও মেনে নিয়েছেন সন্তানের আবদার। এমনিতে বেশ শান্তশিষ্ট এই কিশোরী। তবে নিয়মের একটু এদিক-সেদিক ঘটলেই অফ হয়ে যায় তার মুড। অবশ্য একটু আদর পেলে আবার আগের রূপে ফিরে আসে ডিজিট। মেয়ের সঙ্গে বুড়ো-বুড়িও বেশ মজা করে দিন কাটান। পিয়েরে যখন ট্রাক্টর চালাতে যান, পাশে গিয়ে বসে পড়ে ডিজিট। আবার এলিয়ান মাঝেমধ্যে পোস্ট অফিসে গেলে সফরসঙ্গিনী হয় ডিজিট। কখনো কখনো গাড়ি চেপে ডিজিটকে নিয়ে আশপাশে ঘুরতে যান এলিয়ান। কিন্তু সিট বেল্ট বাঁধা যাবে না কিছুতেই। সে চেষ্টা করলেই শুরু হয় চেঁচামেচি। ডিজিটকে নিয়ে খেলাধুলা, এমনকি বইপত্রও পড়া হয় তাঁদের।
বাড়িজুড়ে ঘুরে-ফিরে, লাফালাফি, নাচানাচি আর খেলাধুলা করেই তার দিন কাটে। রাত হলে নাওয়া-খাওয়া সেরেই তার গন্তব্য বাবা-মায়ের শোবার ঘর। মা-বাবার মাঝখানে উবু হয়ে বসে, পালকের তৈরি লেপের নিচে হাত-পা ঢুকিয়ে চলে যায় ঘুমের রাজ্যে। কখনো কখনো রাতে পানির পিপাসা হলে বিনা সংকোচে বাবাকে গা ঝাঁকিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় ডিজিট। বাবাও সব আলস্য বাদ দিয়ে পানি খাইয়ে দেন মেয়েকে। দুই বছর বয়স পর্যন্ত সে আলাদাই ঘুমাত। কিন্তু ওই সময়ে তার পাকস্থলীতে ফোঁড়া হওয়ায় অস্ত্রোপচার করাতে হয়। অসুস্থ অবস্থায় তাকে নিজেদের সঙ্গে রেখেছিলেন পিয়েরে ও এলিয়ান। সেই যে শুরু, গত ১১ বছর ধরে সেভাবেই চলছে। বন্য প্রাণীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা এই দম্পতির। সার্কাসে বন্য প্রাণীদের ব্যবহার, শখের বশে ঘরে পশুপালন, এমনকি অনেক চিড়িয়াখানায় পশুপাখির প্রতি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ভীষণ নাড়া দিত থিভিলোঁ পরিবারকে। তাই বন্য প্রাণী সংরক্ষণের তাগিদে ৩৯ বছর আগে নিজেদের বসতভিটায় গড়ে তুলেছেন একটি চিড়িয়াখানা। প্রাণীদের দেখানোর বিনিময়ে পাওয়া প্রবেশ মূল্য আর অনুদানের টাকা দিয়েই মেটানো হয় চিড়িয়াখানার খরচ। এখানে আছে বানর, সিংহ, বাঘ, গিবন, চিতাবাঘসহ আটটি গরিলা ও নানা পশু-পাখি।
ক্যামেরুনে উদ্ধার হওয়া গরিলা ‘পামেলা’কে নিয়ে আসা হয় সেই চিড়িয়াখানায়। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে পামেলার গর্ভেই জন্ম নেয় ডিজিট। কিন্তু মা তাকে নিজের দুধ খাওয়াতে ব্যর্থ হচ্ছিল। এদিকে ডিজিটের ওজনও মাত্র দুই কেজি। এতে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান থিভিলোঁ দম্পতি। দুই দিন উৎকণ্ঠায় পার করে তৃতীয় দিন নিজেদের কাছে ডিজিটকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন তারা। ডিজিটও কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাত তাঁদের দিকে। পামেলাও বোধহয় বুঝতে পেরেছিল নিঃসন্তান দম্পতির মনের অবস্থা। তাই ডিজিটকে যখন খাঁচা থেকে বের করা হচ্ছিল, কোনো বাধাই দেয়নি। এলিয়ান সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন ডিজিটকে। দিনে দিনে তাদের সন্তান বনে যায় ডিজিট। কিন্তু ইদানীং দুশ্চিন্তার বলিরেখা দেখা যাচ্ছে এই দম্পতির কপালে। কারণ ডিজিটের ভবিষ্যৎ।
গরিলা সাধারণত ৩৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। তবে অনুকূল পরিবেশে বন্দি অবস্থায় ৫০ বছর পর্যন্তও বাঁচতে পারে। থিভিলোঁ দম্পতির বয়স এরই মধ্যে ৬০ পেরিয়ে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু এসে হাজির হবে দরজায়। তখন ডিজিটের কী হবে_এই ভেবেই অস্থির পিয়েরে ও এলিয়ান। এর মধ্যে ডিজিটের মা পামেলা আরো দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তাই বুড়ো-বুড়ি চেষ্টায় আছেন মা, দুই বোন আর অন্যান্য গরিলার সঙ্গে ডিজিটের বন্ধুত্বটা যেকোনো উপায়ে যত দ্রুত সম্ভব করিয়ে দিতে। যাতে তাঁরা মারা গেলে ডিজিট নিঃসঙ্গ না হয়ে পড়ে।
লিখেছেনঃ তানজীর মেহেদী