কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শাহপুর। বিদ্যুত্ নেই, নেই কোনো বিদ্যালয়। যোগাযোগব্যবস্থাও উন্নত নয়। কয়েক বছর আগেও জারইতলা ইউনিয়নের ওই গ্রামের অনেক পরিবারেরই আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। এখন দিন বদলেছে। সেই সঙ্গে ঘুচেছে শাহপুরের দুই শতাধিক পরিবারের দৈন্যদশা। যাঁর হাত ধরে এই পরিবর্তনের সূচনা, তিনি শিখা আক্তার (৩৫)। শাড়িতে নকশা তোলার হাতের কাজ ‘কারচুপি’ শিখে নিজে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি গ্রামের অনেক পরিবারের অসহায় ও দরিদ্র্য নারীদের এই কাজ শিখিয়ে তাঁদের আর্থিক উপার্জনের পথ দেখিয়েছেন শিখা। রঙিন শাড়িতে কাজ করে এখন তাঁরা রঙিন স্বপ্ন দেখার সাহস করেন।

ঈদ আসন্ন। তাই কাজের চাপ বেশি, কারিগরদের ব্যস্ততাও। এখন শাহপুর গ্রামে গেলে দেখা যাবে, বেশির ভাগ পরিবারের নারী বাড়ির উঠোনে বসে জর্জেট কাপড়ে জরি, চুমকি ও পুঁতি দিয়ে নিপুণ হাতে কাজ করে একটি সাধারণ শাড়িকে কীভাবে অসাধারণ করে তুলছেন।

যেভাবে বদলে দিলেন শিখা
শুরুর কথা: ১০ বছর আগে শাহপুরের ফিরোজ মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় জেলার বাজিতপুর উপজেলার বুড়িকান্দা গ্রামের শিখার। বিয়ের পর স্বামী কর্মহীন ছিলেন। পরে ঢাকায় জুতার কারখানায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। পরিবারের অবস্থা ফেরানোর স্বপ্ন ছিল শিখার। আত্মবিশ্বাসী এই নারী চার বছর আগে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি যাওয়ার পথে বাজিতপুরের সরারচর টেংগুরিয়া গ্রামে দেখেন সেখানকার নারীরা শাড়িতে কারচুপির কাজ করছেন। দেখে তাঁর ভালো লাগে। কাজটি শিখতে তিনি আগ্রহী হন। কয়েক দিন পরই আট কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে বাবার বাড়ি থেকে এসে তাঁদের সঙ্গে কারচুপির কাজ শিখতে শুরু করেন। ১৫ দিন কাজ শিখে শাহপুরে স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসেন। ৬০০ টাকা দিয়ে একটি কাঠের ফ্রেম কেনেন। পুরোদমে শুরু করেন এই হাতের কাজ। শিখার কাছ থেকে গ্রামের অন্য অনেক পরিবারের বৌ-ঝিরা কাজ শেখেন। এখন তাঁরাও উপার্জন করছেন।

শাহপুর গ্রামে একদিন: ১৪ আগস্ট শাহপুর গ্রামে শিখার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ও তাঁর প্রতিবেশী জাহানারা (৩০), তানিয়া (২৫), ঝরনা (২৫), নাজমা (৩০), রত্না (২২) ও হেনা (২০) রং-বেরঙের শাড়িতে নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলছেন নানা ধরনের নকশা। একটি সাধারণ জর্জেট শাড়ি কারচুপির কাজের পর কতটা অসাধারণ হয়ে ওঠে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই দেখা গেছে নারীরা শাড়িতে সুঁই দিয়ে চুমকি, জরি, পুঁতি বসানোর কাজে ব্যস্ত।

কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, উজ্জ্বল রঙের ওপরে নকশাগুলো ফোটে ভালো। এত সব নকশা কোথায় পান জানতে চাইলে শিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব জ্ঞানে তৈরি কয়েকটি ‘ক্যাটালগ’ এবং প্রথম আলোর ‘নকশা’য় প্রকাশিত বিভিন্ন মডেলের পরা শাড়ির নকশা দেখান। তাঁরা জানান, নকশা যত জটিল, পারিশ্রমিক তত বেশি।

মাসে তিন হাজার টাকা আয়: একটি জর্জেট কিংবা টিস্যু শাড়িকে কারচুপির কাজে সাজাতে একজন কারিগরের পাঁচ-ছয় দিন সময় লাগে। যেসব পাইকার অর্ডার দিয়ে যান, তাঁরাই শাড়িতে কাজ করতে প্রয়োজনীয় সুঁই, সুতা, চুমকি, জরি ও পাথর দেন। প্রতিটি শাড়ির কাজে মজুরি বাবদ নারী কারিগরদের দেওয়া হয় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। একজন নারী কারিগর মাসে চার-পাঁচটি শাড়িতে কাজ করতে পারেন। গড়ে মাসে তাঁদের তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা আয় হয়।

বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী খোকন মিয়া জানান, সপ্তাহে দুবার শাহপুর গ্রামের নারীদের পুঁতি, জরি, চুমকি ও জর্জেট কাপড় দিয়ে যান। প্রতি মাসে এই গ্রামে ৮০০ থেকে ৯০০ শাড়ি তৈরি হয়। এগুলো পরে ঢাকার বিভিন্ন বিপণিতে বিক্রি করা হয়।

সফলদের কথা: চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী পান্না। তার ছোট বোন মান্না তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তার বাবা সুজন মিয়া পেশায় জেলে। সারা বছর সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। মেয়েরা কারচুপির কাজ করে এখন সংসারে সচ্ছলতা এনেছে। সুজন মিয়া জানালেন, মেয়েদের সহযোগিতায় তার পরিবার এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো চলছে।

সুপাচান ভুঁইয়া ঢাকার নবাবগঞ্জে জুতার কারিগর হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেও সংসারের অভাব দূর করতে পারেননি। মেয়ে তানিয়া আক্তার দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় কারচুপির কাজ শুরু করে। বর্তমানে সে বাজিতপুর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তানিয়া বলে, ‘পড়ালেখার খরচ চালিয়েও সংসারে মাসে এক-দেড় হাজার টাকা দিতে পারি। এখন সংসারের অভাব কেটেছে।’

একই অবস্থা ছিল কৃষক মাহফুজ মিয়ার সংসারেও। কৃষিকাজ করে সাত সদস্যের সংসার চালাতে কঠিন লড়াই করতে হতো। এখন আর সেই অবস্থা নেই। ছেলে আনোয়ার ও মেয়ে জেরিন শাড়িতে কারচুপির কাজ করে নিজেদের পড়ার খরচ চালিয়েও প্রতি মাসে দেড়-দুই হাজার টাকা দেয়।

নয় বছর আগে বিধবা হন সুফিয়া আক্তার। তিন মেয়েকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিলেন। কারচুপির কাজ করে এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তিন মেয়ে এখন স্কুলে যায়। বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া আমিনা বলে, ‘সংসারের অনটন দূর করতে পেরেছি শাড়িতে কারচুপির কাজ করে।’

শাহপুর গ্রামের নারীদের এই সফলতার প্রভাব পড়েছে পাশের রসুলপুর, হাবশ্বরদিয়া, হিলচিয়া ও গুরুই গ্রামেও। এখন এসব গ্রামের তিন শতাধিক নারী শাড়িতে কারচুপির কাজ করছেন। হিলচিয়া গ্রামের সুফিয়া (৪২) বলেন, ‘আমরা দাবি করি, সম-অধিকার দিতে হবে। কিন্তু সম-অধিকার পাইতে সংসারের কাজও সমানভাবে করতে হবে। তাই শাড়িতে কারচুপির কাজ করে স্বামীকে আর্থিকভাবে কিছুটা হলেও সহযোগিতা করতে পারছি।’

শিখার কথা: শিখা আক্তার বলেন, ‘আমি শাড়ির কাজ শেখার পর সংসারে বাড়তি আয় শুরু হলো। এখন আর অভাব নেই। আমার সাত বছরের মেয়ে প্রিয়া স্কুলে যায়। সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। অনেক সময় আমার সঙ্গে কাজে সাহায্য করে।’ শিখা জানান, তিনি কাজ শেখার দুই বছর পর একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে গ্রামের ১০ জন নারীকে এই কাজের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তারা যা বলেন: জারুইতলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়াম্যান জাকির হোসেন বাতেন বলেন, তাঁর ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের নারীরা শাড়িতে কারচুপির কাজ করে একে গ্রামীণ শিল্পে পরিণত করেছেন। এ কাজে গ্রামের অশিক্ষিত ও গরিব মেয়েরা সম্পৃক্ত হয়ে অলস বসে না থেকে স্বাবলম্বী হচ্ছে। অন্যদিকে অনেকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করায় দিন দিন এর প্রসার ঘটছে।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘গ্রামের নারীরা শাড়িতে হাতের কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে শুনে গ্রামটি ঘুরে এসেছি। সত্যি, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে আমাদের দেশের নারীদের হস্তশিল্প এত সুন্দর। এ কাজ করে তারা সংসারে সচ্ছলতা আনার পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়াও শেখাচ্ছে। তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে।’ এ কাজে প্রয়োজনে যেকোনো সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।

লিখেছেনঃ দিলীপ কুমার সাহা, নিকলী