কিশোরগঞ্জ জেলার বেশীর ভাগ থানা গুলোই কোন না কোন ভাবে হাওরের সাথে সম্পৃক্ত । হাওর জনপদের মানুষের অবদান কিশো্রগঞ্জ তথা বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বরাবরই গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে এসেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় গুরুত্বপুর্ন হাওর জনপদের সাথে কিশোরগঞ্জের যাতায়াত ব্যবস্থার কোন প্রকার উন্নতি আজও সাধিত হয়নি হাওরের মানুষ বছরের বেশীর ভাগ সময়েই যাতায়াত করে নৌপথে, পাড়ি দেয় মস্ত মস্ত হাওর। যাতায়াতের মাধ্যম বেশীর ভাগই নৌকা। আজ়কাল হস্তচালিত মাঝি মাল্লার নৌকা বানিজ্যিক ভাবে আর যাত্রী বহন করে না।
অতি দৈবাৎ হতদরিদ্র জ়েলেদের দেখা যায় হস্তচালিত নৌকা ব্যাবহার করতে। প্রকৌশল বিদ্যার ইতিহাসে বলা হয় “চাকার” আবিস্কার এবং পরে “কপিকলের” আবিস্কার মানব সভ্যতায় এক নুতন দিগন্তের. উন্মচোন করেছিল।সেই পাথর কেটে মানুষ যখন প্রথম চাকা বানিয়েছিল সেদিন থেকেই কোন না কোন ভাবে চাকার মাধ্যমেই, চাকার ব্যবহারকেই কাজে লাগিয়ে চমক লাগানো সব আবিস্কার আজো একের পর এক তাক লাগিয়ে যাচ্ছে সারা দুনিয়া কে। এ আধূনিক বিজ্ঞানের যুগে এখনও চাকাকে বাদ দেয়া কল্পনাতীত।
আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত হাওরবাসীরা বিশাল বিশাল হাওর ঝড় ঝঞ্জা উপেক্ষা করে হাওর জনপদে হস্তচালিত পালের নৌকায় দেদারছে ঘুরে বেড়াতো। সাহসী মাঝি-, বদ্র, বদ্র, বলে দুরদান্ত প্রতাপে অতিক্রম করতো ধনু, কালনী, কুশিয়ারা। হঠাৎ করেই আশির দশকের শেষ দিকে সেই চাকা সম্বলিত পাওয়ার পাম্প (শ্যালো) মেশিনের ছোট সংস্করন দেশে আসতে শুরু করল। সারা হাওর জনপদ সেই মানব সভ্যতার প্রথম দিকের চাকা আবিস্কারের আনন্দের উল্লাসে মেতে উঠলো । মেশিন ব্যবহ্রত হতে থাকল নৌকায়, প্রথমে ভেবেছিলাম এই মেশিন হয়তো বা এক মাত্র ধনাঢ্য ব্যাক্তি দের ‘বজরা’ তে ব্যবহ্রত হবে। হয়তো Men Vs Machine এর যুদ্ধ হবে। কি হবে হস্তচালিত নৌকা গুলির ভবিষ্যৎ? কি হবে যারা জিবীকা নির্বাহ করতো হস্তচালিত নৌকা দিয়ে তাদের ? কিন্তু সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে Machine এরই জয় হলো। সহজ লভ্য চায়নিজ মেশিন দখল করলো ছোট্ট ডিংগি নৌকার খোলস পর্যন্ত। শুরু হলো ট্রলার/ইঞ্জিনের নৌকার জয়যাত্রা, (কোথায় এ মেশিন ব্যবহ্রত না হয়্- ধানমাড়াই কল, ভাংগানো কল, নসিমন, ভটভটি, আখের শরবতের কল, জ়েনারেটর, এমনকি কিশোরগঞ্জের এক কৌতুহলী বিজ্ঞানী তার ওয়ার্কশপে নির্মিত উড়োজাহাজ়ের ইঞ্জিন হিশাবেও এই ‘শ্যালো মেশিন’ কে বেছে নিয়েছেন!) শত শত মেশিনের গর্জ্জনে আন্দোলিত হতে থাকল হাওর জনপদ।
যাতায়াতের সময় কমে গেলো অনেকাংশে পক্ষান্তরে নৌদুর্ঘটনা বেড়ে গেলো বহুলাংশে । প্রতি বছর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম গুলুতে খবর আসতে থাকলো, “ঘোড়াউত্রায় ট্রলার ডুবি” , “ইটনায় ট্রলার ডুবি” , “চামড়ায় লঞ্চ ডুবি” এই তো গ্যালো বছর মিঠামইন এ লঞ্চ এবং ট্রলারের সংঘর্ষে নিহতদের স্বজনদের চোখের নোনা জলের লবনক্ততা হাওরের পানি থেকে কাটতে না কাটতেই, আবারও হাওরে ঘটছে ট্রলার দুর্ঘটনা। আর কতবার আমদের কে শুনতে হবে “উদ্ধারকারী জাহাজ খবর দেয়া হয়েছে, হামজা, রুস্তম আসছে” – “ প্রত্যেক মৃতের জন্য … হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে”- “দুর্যোগ পুর্ন আবহাওয়ার জন্য উদ্ধারকার্য পরিত্যক্ত” ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এখন ভীষনভাবে সময় এসেছে আমাদেরকে ভাববার, আর যেন একটি প্রানও নৌদুর্ঘটনায় না হারায়, একটি প্রান, একটি পরিবারের আজন্ম কান্না আর হাহাকার।
প্রথমে আমদেরকে বিবেচনায় আনতে হবে, হাওরের “আফাল”/ঢেউ, বাতাসের গতি,দিক (বাংলা মাসের উপর নির্ভর) বর্ষায় যুগের পর যুগ একই রকম ছিলো। বিশ্বউষ্বনায়নে হাওরের “আফাল” (হাওরের ঝড়ো,বৃষ্টি,ঢেউ) এর তেমন পরিবর্তন লক্ষনীয় নয়, তবে এ কথা সত্য যে গত ১৫-২০ বছরে হাওর এলাকার গ্রাম গুলোতে বেশ নারকেল গাছ জন্মেছে, যা আগে হতো না। জেনেছি উপকূ্লীয় এলাকায় পানিতে লবনক্ততা থাকলে নাকি নারকেল গাছ ভালো জন্মে, নিঃসন্দেহে আমরা উপকুলে নই, তাহলে নিশ্চয়ই হাওরের পানিতে কোন না কোন ভাবে লবনের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যাক এ ব্যপারে বিশেষজ্ঞরা ভালো বুঝবেন। তবে নারকেল গাছ বা হাওরের পানিতে লবনের উপস্থিতি যে সাম্প্রতিক কালের নৌদুর্ঘটনা বৃদ্ধির জন্য দায়ী না তা মোটামোটি হলফ করেই বলা যায়।
ট্রলার দুর্ঘটনার কারন অনেক গুলো- মূলত “ট্রলার” নামের নৌযানটির গাঠনিক আদল, এবং যাত্রীদের আসন বিন্যাস ব্যবস্থা, নৌযানের ভারসাম্যতার জন্য নৌকায় মালামালের সুষম বন্টন ব্যবস্থা, নৌযানের আকার এর সাথে ইঞ্জিনের অশ্বশক্তির সামঞ্জস্যতা, তাৎখনিক ভাবে গতি নিয়ন্ত্রনের জন্য ইঞ্জিনে গিয়ারের অপ্রতুলতা , নৌযানের আকার এর সাথে “হালের” অসামঞ্জস্যতা। রাতে চলাচল কারী ট্রলারে্র লাইট, প্বার্শ সিগন্যাল বাতির অনুপস্থিতি । বৈরী আবহাওয়া, সর্বোপরি ধারন ক্ষমতার বেশী অতিরিক্ত মালামাল এবং যাত্রী বহন। .
অতীতে ভাটি এলাকার হস্তচালিত সকল যাত্রী বাহী (গস্তি) নৌকার গঠন একই ধরনের ছিলো, ছইয়ের উপর যাত্রী বসা যেত না কারন এর আকৃতি (গোলাকৃ্তি), গলুইয়ের সামনে মালামাল থাকত, এবং নৌকার ভিতরে সামনের প্রথমাংশের দিকে পুরুষ যাত্রী, দ্বিতীয়াংশে মহিলা যাত্রী, সবার পিছনের অংশে মাঝি মাল্লারাদের বসার স্থান থাকতো নির্দ্ধারিত। নৌকায় মালের, যাত্রীর ওজনের ভারসাম্যতার হতো সুষম বন্টন। পালে বাতাস পেত, শক্ত হাতে, শক্ত হাল ধরতেন মাল্লা, নির্বিঘ্নে হাওর জনপদের মানুষ পাড়ি দিত হাওর, নদী,খাল।
এখন, একেক ট্রলারের একেক আকৃ্তি, উমুক মিয়ার ট্রলার দেখতে উমুক, তমুক মিয়ার ট্রলার দেখতে তমুক, কোনটা দেখতে নৌকার মত, কোনটা আবার বজরার মতো, কোনটা দেখতে ছোট লঞ্চের মতো, আবার কোনটা ট্রলার ও না আবার লঞ্চ ও না বিভিন্ন আকৃতি প্রকৃতির (কিশোরগঞ্জের চামড়া, অন্যজেলার আজমিরী গঞ্জ) নৌযান দেখতে পাওয়া যায়। স্বভাবত কারনেই কাঠামো গত তারতম্যতায় বিভিন্ন নৌযান গুলো বিভিন্ন ঋতুর আবাহাওয়ায় নদী, হাওরে চলাচলে.বিভিন্ন ভাবে আচরন করে।( Hydro dynamic behavior) যা আমাদের ট্রলার চালক ভাইদের না জানারই কথা। এ ক্ষেত্রে “ট্রুলার” তৈরীতে সরকার অনুমোদিত একটি নিদ্দৃষ্ট নকশা নির্ধারন করা খুবই জরুরী।
ট্রলারগুলুর ছাদ প্রায় সমতল, পার্থক্য শুধু প্রস্থতায়, এবং মজবুততায় ও দূর্বলতায়। সাধারনতঃ যাত্রীরা নিচে, আর মালামাল (অর্থাৎ রড, সিমেন্ট, কাপড়ের গাট, টিন থেকে টমেটোর খাচা পর্যন্ত) ছাদে। আপাতঃ দৃষ্টিতে বোঝা না গেলও , প্রায়শঃই মালের জন্য ট্রলারের উপরের অংশ, নীচের অংশ থেকে অনেকাংশে ভারী থাকে, যার জন্য সাধারন সৌম্য আবাহাওয়াতেও, ট্রলার উলটে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, ঘটেছে। আবার কখনো শুষ্ক মৌসুমে নদীর বাকে প্রবল স্রোতের প্রতিকূলে ট্রলার ঘুরানোর সময়, মালের ভারে ছাদ ধ্বসে নিচের যাত্রী চাপা পরেছে, ট্রলার তলিয়ে গেছে অতল গহ্ববরে। দিনের বেলা এরকম দূর্ঘটনা ঘটলে কেউ কেউ সাতরিয়ে প্রানে বেচে যায়। কিন্তু “আফালের” নিকষ কালো রাত্রে হাওরের এমন দূর্ঘটনা, ভাবলে “টাইটানিকের” সেই ভয়াল দৃশ্যকেও হার মানায়। অনেক সময় দেখা যায়, ট্রলারের আকৃ্তি এবং ওজনের তুলনায়, “হালের” অবস্থা করুন, দুর্বল ভাবে তৈরী। যার ফলে অনেক সময় ঝড়ের কবলে বা প্রচন্ড ঢেউয়ে হাল ভেংগে গিয়ে গতি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে দূর্ঘটনায় পতিত হয়।আর বৈরী আবাহাওয়ায় হাওরে মাত্রারিক্ত মালামাল এবং যাত্রী বোঝাই ট্রলারের দূর্ঘটনার আশংকা তো সব সময়ই বেশী, তবু আমরা আল্লাহ ভরসায় পাড়ি দেই হাওর। অনেক সময় রাত্রে বিশেষ করে ঝড়ের পরে, সঠিক দিক নির্নয় করতে না পেরে ট্রলার এলোপাতারি চলতে থাকে, অনেক যাত্রী মোবাইল ফোনে বন্ধু/আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে দিক নির্দেশনা প্রার্থনা করেন। ব্যপারটা খুব সহজ নয়, (ব্যক্তিগত ভাবে, আমি মোবাইলে সাহায্য করেছিও, এবং সাহায্য চেয়েছিও) ভাগ্যিস, মাঝে মাঝে কিছু কিছু গ্রামে জ়েনারেটর চালিত মোবাইল ফোনের টাওয়ার গুলো, হাওরে “বাতি ঘরের” কাজ করে। অন্ধকার রাতে হাওরে ট্রলার গুলো চলাচলে কি রকম আলো এবং প্বার্শ নির্নয়ের জন্য আলোক সংকেত ব্যবহার করে-, তা যারা লাস্ট ট্রিপে যাতায়াত করেন, তারা সবচেয়ে ভালো জানেন। এক কথায় – খুবই বিপদজ্জনক।
দেশের বিদ্যমান আভ্যন্তরীন নৌপরিবহন আইন, ম্যারিন আইন কানুন বড়ই চমৎকার, কিন্তু প্রয়োগ কই?
আজ পর্যন্ত নৌযানের নামের আগে ব্যবহ্রিত এম, ভি এবং এম, বি- এ দুটোর মজেজা বুঝলাম না। এতটুকু দেখি, এম, ভি অমুক মানে কার্গো জাহাজ, মাস্টার কেবিনে, সারেং, সুকানী সম্বলিত জাহাজ, স্টীয়ারিং দ্বারা চালিত- এবং তারা সার্টিফিকেট ধারী, আর এম,বি অমুক – আকার আকৃ্তিতে এবং মাল পরিবহনের ক্ষমতায় কার্গো জাহাজের তুলনায় বেশী বৈ কম নয়, পার্থক্য শুধু এটা দেখতে বিশাল ট্রলারের মত, স্টিয়ারিং নাই, বিরাট আকৃ্তির হাল সম্বলিত, এম, বি টাইটেলের আড়ালে আভ্যন্তরীন নৌপরিবহন আইনের প্রতি বৃদ্ধাংগুলি প্রদর্শন করে যেভাবে খুশী চষে বেরাচ্ছে হাওর জনপদ, পাল্লা দিচ্ছে ছোট ট্রলার গুলোর সাথে, দিনে দিনে বাড়িয়ে দিচ্ছে ভয়াবহ নৌদূর্ঘটনার আশংকা। জ়েনেছি, সকল প্রকার ট্রলারের (মালবাহী, যাত্রীবাহী) জন্য বাংলাদেশ আভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কতৃপক্ষ (BIWTA) ফিটনেস এবং রুট লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। বিষয় টি, আমলাতান্ত্রীক জটিলতার এক ভয়ংকর ধুম্রজাল, আর অন্তত পক্ষে নীরিহ ট্রলার মালিক দের কাছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন, কারন এই ট্রলারগুলো নিয়ন্ত্রনের এখতিয়ার নিয়ে ইউ,পি প্রশাসন থেকে উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন এবং BIWTA এর মধ্যে আমলাতান্ত্রীক হাঙ্গামার টানাপোড়েন দীর্ঘ দিন যাবত যথেষ্ট ভাবে লক্ষ্যনীয়।ট্রলার মালিক পক্ষ সকল ক্ষেত্রে ধনী/শিক্ষিত ভাবা ঠিক নয়। মালিক পক্ষ সব সময়ই লাইসেন্সিং এর পক্ষে, কিন্তু এর জটিলতা এরাতে নিরীহ মালিক পক্ষ আশ্রয় নেয় বিভিন্ন দুই নম্বর পথের, এ সুযোগে প্রশাসনের এবং রাজনৈতিক দলের কিছু সংখ্যক হোমরা চোমরারা হাতিয়ে নেয় “টু-পাইস”।
কোন ভাবেই কোন দুর্ঘটনা এড়ানোর একশত ভাগ গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না, কিন্তু দুর্ঘটনার ঝুকি কমানো যায়, নিয়ন্ত্রন করা যায়। নিয়ন্ত্রনজনিত কারনের ত্রুটি সম্বলিত দূর্ঘটনা গুলোই তো “ট্রাজ্যাডী” । হাওর জনপদের একমাত্র যোগাযোগ এর মাধ্যমকে ট্রাজ্যাডি মুক্ত করার লক্ষ্যে কালক্ষেপন না করে প্রয়োজনীয় উপায় বের করে, যথার্থ প্রয়োগ এর অপেক্ষায় অবহেলিত হাওরবাসি তথা সচেতনমহল অধির আগ্রহে সংশ্লিষ্ট সকলের আশু দৃষ্টি কামনা করছে।
ইতি পূর্বে এই পোষ্টটি একবার ফিচারে ছিল, পুনরায় ফিচারে ফিরিয়ে আনা হলো
– এডমিন
সাইটটি ভালো লেগেছে। হাওর সম্পর্কে কয়েকটা লেখাও ভাল। তবে সাইটটিকে নিয়মিত করলে আরো ভালো হবে।
সাইটি পরিদর্শনে আপনাকে ধন্যবাদ।