কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চল এলাকার প্রকৃতির বিরূপ আবহাওয়ার মতোও ভঙ্গুর এসব এলাকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান চিত্র। প্রকৃতির বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে অধিকাংশ সময় মানুষগুলো বড্ড অসহায়। দরিদ্রতা যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নকেও মাঝে মধ্যে প্রকৃতি তার এক স্পর্শেই সবকিছু ধূলিসাত করে দেয়। প্রকৃতিই যেন তাদের জীবিকা নির্বাহের গতিবিধি নির্ধারণ করে। তারপরও প্রয়োজনীয় নাগরিক সুযোগ সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলোর কাছে প্রকৃতিনির্ভর কৃষিই অর্থ উপার্জনের অন্যতম উৎস। আর্থিক সঙ্কট আর প্রকৃতির বৈরী আচরণ তাদের লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগালেও, তাদের সনত্মানদের লেখাপড়া শিখে মানুষ তৈরি করার সুন্দর স্বপ্নগুলো তাদের অনেকের কাছেই থাকে উপেৰিত। তারা চায় তাদের সন্তান বাস্তব শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, দ্রুত অর্থ উপার্জনে সম্ভব হোক। যেন সংসারের হাল ধরতে পারে।
বর্ষাকালে পানিতে দ্বীপের মতো ভাসতে থাকে গ্রামগুলো। যেদিকে তাকানো যায়, সবদিকে শুধু পানিতে থৈ থৈ করে। রীতিমতো গৃহবন্দী অবস্থা। তখন ছয় মাস এই অঞ্চলের মানুষের তেমন কোন কাজ থাকে না বললেই চলে, ফলে এসময় শিশুদেরও তাদের অভিভাবকরা ঘর হতে বের হতে দিতে চান না। পানির কারণে ছয় মাস নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন আরো বিকৃত রূপ ধারণ করে, এই ছয় মাস বেশিরভাগ রাসত্মাই শুধুমাত্র হাঁটার উপযোগী। পরিবহন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অনেক ক্ষেত্রে একটি গ্রাম থেকে আরেকটি গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘপথ হেটে পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে বিদ্যালয়ে পৌছাতে হয়।
প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় এসময় শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা কৃষি কাজ আর মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে আবার ইটখোলায় কাজের উদ্দেশ্যে কাজ করতে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে আর ফসল কাটার সময় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনেক কমে যায়, তখন হাওরের বিদ্যালয়গুলো একরকম বন্ধই থাকে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শিৰার আলোয় আলোকিত করার উদ্যোগ হিসেবে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দেশব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থায় এত যুগোপযোগী পরিবর্তন আর আধুনিকায়ন হলেও কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলগুলোতে পরিবারের দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডী পার হওয়ার আগেই ঝরেপড়ে অনেক শিক্ষার্থী।
বিপন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, উপকরণের অপর্যাপ্ততার সঙ্গে যখন যোগ হয় শিক্ষা সংকট, তখন যেন উত্তরণের পথ বড্ড কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলায় ৮০৮ টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৪৪৫টি রেজিস্টার্ড (বেসরকারী) প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। করিমগঞ্জ, নিকলী, বাজিতপুর উপজেলার আংশিক হাওর এলাকা হলেও ১৩টি উপজেলার মধ্যে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার পুরোটাই হাওর। এর মধ্যে ইটনা উপজেলায় ৪৪টি সরকারি ও বেসরকারি ২১টি, মিঠামইন উপজেলায় ৩৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও চালু আছে ৩৬টি ও বেসরকারি ৩১, অষ্টগ্রাম উপজেলায় ৪৫টি সরকারি ও ২৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।
এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত কমিটিগুলোতে সদস্য হিসেবে অন্তভূক্ত হবার জন্য অভিভাবকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও, নির্বাচিত হবার পর তাদের দায়-দায়িত্বগুলো সম্পর্কে অধিকাংশই উদাসীন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি, অভিভাবক কমিটি, উন্নয়ন কমিটি ও সামাজিক মূল্যায়ন কমিটি থাকার কথা থাকলেও বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে তা নিষ্ক্রিয়। এমনকি কমিটির সদস্যদের নিয়ে সভা আহ্বান করলে প্রায়ই কোরাম সংকট থাকে। শুধুমাত্র কমিটির সদস্যদের সমস্যাই নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না। ফলে বাইরে থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয় আর নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা বেশিদিন এসব দুর্গম এলাকায় শিক্ষকতা করতে চান না। তাই নিয়োগপ্রাপ্ত হবার পর পরই অন্যত্র যাওয়ার জন্য শুরু হয় উচ্চ পর্যায়ের জোর তদবির।
যারা থাকেন তারাও আবার জেলা সদর বা সংশিস্নষ্ট দূরে সুবিধাজনক এলাকায় অবস্থান করার কারণে সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকেন না। এসব সমস্যা দেখা যাওয়ার পরও সমস্যা দেখভাল করার জন্য উপজেলা পর্যায়ের প্রয়োজনীয় তদারকি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রয়েছে কর্তৃপক্ষের দীনতা। বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য যে বরাদ্দ রয়েছে, তা এলাকা বিবেচনায় অতি নগণ্য হওয়ায় তাদের উপস্থিতিও খুব কম। তবে আশার কথা, সম্প্রতি এ বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জরিপ, গবেষণা ও অনুসন্ধানে দেশের ৭টি জেলার হাওরাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপ শেষে হাওরের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে ১১ দফা সুপারিশও করা হয়েছে। তাই হাওরাঞ্চলের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আজ সময়ের দাবি। সংশিস্নষ্টদের মতে, হাওরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো বিশেষভাবে বিবেচনা করার পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রণোদনা সৃষ্টিতে হাওর ভাতা, শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপবৃত্তি, বিদ্যালয়ে একবেলা আহারের ব্যবস্থা করা হলে হাওরাঞ্চলের ভঙ্গুর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে।