নতুন আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিল সরকার। এর মধ্যে দুটি ঢাকায় ও ছয়টি ঢাকার বাইরে অবস্থিত। অভিযোগ উঠেছে, অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়েছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পেছনে কোনো না কোনোভাবে সরকারের সমর্থক ব্যক্তিরা জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সরেজমিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, তুলনামূলকভাবে বেশি যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে কম যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৯৫টি আবেদন জমা পড়লেও দীর্ঘ পর্যালোচনার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল নতুন আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়। বিষয়টি নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মতি নেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হলেও দুটি নাম বাদ পড়েছে এবং নতুন দুটি যুক্ত হয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’ এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথমেই আছে ঢাকায় অবস্থিত ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। মিরপুরের শাহ আলীবাগে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় আছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সূত্রমতে, ইউজিসি সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরির সময় (তখন প্রস্তাবিত) এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে পারেনি।

ঢাকায় অনুমোদন পাওয়া আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি। ঢাকার উত্তরা মডেল টাউনে অনুমোদন পাওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে আছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ইউজিসির একটি সূত্র জানায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকেরা ব্যবসায়ী হওয়ায় সব শর্ত পূরণ না হলেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে করেন শিক্ষার নীতিনির্ধারকেরা।

শিক্ষাবিদেরা বলে আসছিলেন, ঢাকায় কোনোভাবেই আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। তাঁদের যুক্তি ছিল, এমনিতেই ঢাকায় অবস্থিত ৪৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সরকার ঢাকায় দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিলেও স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরিসহ সব শর্ত পূরণ করা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পায়নি।

ঢাকার বাইরে ছয় বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকার বাইরে অনুমোদন পাওয়া ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনাঘাটের নিউ টাউনে অবস্থিত। এর পেছনে আছে ইউনানি ঔষধালয় হামদর্দ। হাকিম মো. ইউসুফ হারুন ভূঁইয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনকারী। চট্টগ্রাম মহাসড়কের একেবারেই পাশে হওয়ায় এটির অনুমোদন না দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছিলেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, সামান্য অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই মহাসড়ক বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে।

বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহীর মতিহারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্যোক্তা হাফিজুর রহমান খান হলেও এর সঙ্গে রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার ও প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান শিখর, যিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজশাহীতে সব শর্ত পূরণ করে স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ সব অবকাঠামো তৈরির পরও অনুমোদন পায়নি স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানকের নেতৃত্বাধীন গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শরীফ এম আফজাল হোসেনের টাইমস ইউনিভার্সিটি শর্ত পূরণ করেও অনুমোদন পায়নি। কিছু শর্ত পূরণ করলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল খালেকের স্ত্রী রাশেদা খালেকের নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অনুমোদন পায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নাম গেলেও শেষ সময়ে নর্থ বেঙ্গলের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। শিক্ষানগর রাজশাহীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি অবৈধ শাখা রয়েছে। সেখানে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট নয়। সূত্র জানায়, একটি মহল কৌশলে শিক্ষানগরের বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট ছিল।

সিলেটের গোলাপগঞ্জে নর্থইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মূল উদ্যোক্তা চিকিৎসক আফজাল মিয়া। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকবাল আহমেদ চৌধুরী। ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ চূয়াডাঙ্গার পৌর কলেজপাড়ায় অবস্থিত। এর মূল উদ্যোক্তা ওই এলাকার সরকারদলীয় সাংসদ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার। জানতে চাইলে সাংসদ সোলায়মান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশপাশের চার জেলার শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে ঢাকা, রাজশাহীতে পড়তে যায়। এ জন্য এটা করেছি।’

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় অনুমোদন পেয়েছে ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এর পেছনে আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য দুর্গাদাস ভট্টাচার্য। এ ছাড়া শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের কার্তিকপুরের মধুপুর এলাকায় অনুমোদন পেয়েছে জেড এইচ সিকদার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি। এর পেছনে আছেন আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। এই ব্যবসায়ী গ্রুপের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা এনামুল হক শামীমের সম্পর্ক রয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর আলোকে সাময়িকভাবে সাত বছরের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদিত বিভাগ ও অনুষদের বাইরে তারা কোনোভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এ ছাড়া কোনোভাবেই দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে পারবে না। সাময়িক অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শর্ত পূরণ করে স্থায়ী সনদ নিতে হবে।

দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টি (একটি আদালতের নির্দেশনায় চলছে)। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১০-১২টি ভালো বা ভালোভাবে চলার চেষ্টা করছে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষাবাণিজ্য ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন আটটি নিয়ে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬২টি।

৬১টি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বিষয়ে সতর্কীকরণ: শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১টি ক্যাম্পাস বাংলাদেশে পরিচালিত হচ্ছে। আইন অনুযায়ী এগুলো অবৈধ। এগুলোর নাম উল্লেখ করে পত্রিকায় সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আজকালের মধ্যেই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এর আগে এ রকম ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোসহ এবার ৬১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে এই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে।

লিখেছেনঃ  সামিউল আলম খান পলিন