আলোকলতা’, ‘স্বর্ণলতা’ বা ‘শূন্যলতা’—যা-ই বলি না কেন, ছেলেবেলায় এই লতা ছিল আমাদের বিস্ময় বা কৌতূহলের একটা বিষয়। অনেকবার মাটির সঙ্গে ওদের সংযোগ খুঁজেছি, পাইনি। পরে জেনেছি, এরা পরজীবী। অন্য গাছের ডালপালাই ওদের প্রিয় আবাস। বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে একটা ছোট্ট বরইগাছের ওপর এমনভাবে লতার জটলা জাঁকিয়ে বসতে দেখেছি যে গাছটি আর তেমন বাড়তে পারেনি। পরে গাছটি সড়ক উন্নয়নের বলি হয়েছিল।

আলোকলতা গ্রামে এখনো কিছুটা সহজলভ্য। জানামতে, ঢাকায় পাবেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্তে রমনা কালীবাড়ি-লাগোয়া পুকুরপাড়ে আর রমনা উদ্যানে। শহরের অন্যত্র থাকাও অস্বাভাবিক নয়। অনেকেই হয়তো লতা দেখেছেন, কিন্তু ফুল দেখেছেন—এমন দর্শকের সংখ্যা হাতেগোনা। আমরা সৌন্দর্য উপভোগ করি আর না-ই করি, প্রকৃতির নিয়মে সে তার রূপের পসরা সাজাবেই।

স্বর্ণলতা এখানকার অতি প্রাচীন পরজীবী। প্রাচীন কাব্য এবং জাতকেও এর উল্লেখ রয়েছে। জাতকে তার নাম ‘আকাশবল্লী’। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘সেখানে মানুষ কেউ যায় নাকো দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা/ বেতের বনের ফাঁকে জারুলগাছের তলে রৌদ্র পোহায়/ রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায়,—শাদা ভাঁট পুষ্পের তোড়া/ আলোকলতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণ ফুল বাসকের গায়;।’

আলোকলতা (Cuscuta reflexa) হলুদ-সোনালি রঙের, নরম ও সরু। পত্রহীন হলেও শাখা-প্রশাখা অসংখ্য। সাধারণত ছোট ও মাঝারি উচ্চতার গাছ বা বেড়ার গাছে জোঁকের মতো জড়িয়ে থাকে। এভাবে আশ্রয়দাতা গাছের কাণ্ডে নিজের মূল কাণ্ড গেঁথে তার সাহায্যে খাদ্য সংগ্রহ করে। তারপর নিজের শাখা-প্রশাখায় জড়িয়ে নেয় গাছটিকে। একসময় এর মূল বা কাণ্ড আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বসন্ত-গ্রীষ্মে পত্রহীন লতায় ছোট মঞ্জরিদণ্ডে সাদা রঙের ফুল ফোটে। দেখতে অনেকটা ছোট বাতির মতো, মাথায় পাঁচ পাপড়ি, পরাগকেশর অনেকটাই অদৃশ্য। বোঁটা বেশ ছোট এবং গুচ্ছবদ্ধ। ফল পাকে বসন্তের শেষে বা বর্ষায়।

বাংলাদেশ ও ভারতের সর্বত্র সহজলভ্য। এখানে চার প্রজাতির লতা দেখা যায়। গাছপালা তরুলতা গ্রন্থে বিপ্রদাশ বড়ুয়া সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি নতুন প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন। সারা পৃথিবীতে এই গণে হলুদ, কমলা ও লাল রঙের ১০০ থেকে ১৭০ প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়। আলোকলতার হিন্দি নাম ‘আকাশবেল’, রাজশাহীর আঞ্চলিক নাম ‘জারবুটি’।

এই লতার বীজ ও কাণ্ড ঔষধিগুণে ভরা। লতার স্বাদ তেতো, কচলালে আঠালো ধরনের হয়। মোটা লতা পিত্তজনিত রোগে, সরু লতা দূষিত ক্ষতে, বীজ ক্রিমি ও পেটের বায়ুনাশে খাওয়ানো হয়। এ ছাড়া পাণ্ডুরোগ, পক্ষাঘাত, মাংসপেশির ব্যথা, যকৃত ও প্লীহার রোগে এর বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। নিজেদের প্রয়োজনেই এসব মূল্যবান ও আলংকারিক লতাগুল্মকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

-প্রথম আলো