প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদুল ফিতরের বৃহত্তম জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। বৃহত্তম ঈদ জামাতকে সামনে রেখে প্রশাসনের উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। শেষ হয়েছে ঈদগাহ সংস্কারের কাজ। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। এবার শোলাকিয়ায় ১৮৮তম ঈদুল ফিতরের জামাতে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি অংশ নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বছর এখানে ৩ লাখেরও বেশি মুসল্লি অংশ নেন। এ বছর জামাতে ইমামতি করবেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। ঈদের দিন জামাত শুরু হবে সকাল ১০টায়। শোলাকিয়া ঈদের জামাতে অংশ নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্য, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন মুসলিম দেশের কূটনীতিকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। শোলাকিয়া মাঠ থেকে ঈদের জামাত সরাসরি সম্প্রচার করবে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আই। কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মীর রেজাউল আলম গতকাল সকালের খবরকে জানান, ঈদের জামাত নির্বিঘ্ন করতে নেওয়া হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঈদগাহ মাঠের সার্বিক নিরাপত্তায় র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন দায়িত্ব পালন করবেন। পোশাক পরিহিত নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি ছদ্মবেশে গোয়েন্দা পুলিশও মোতায়েন থাকবে মাঠ ও মাঠের বাইরে। ঈদগাহে প্রবেশের প্রতিটি পথে মুসল্লিদের দেহ তল্লাশি করা হবে। নামাজ শুরুর আগে পুরো মাঠ মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা (সুইপিং) করা হবে। ঈদকে ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আনা হচ্ছে বলেও জানান পুলিশ সুপার। জেলা প্রশাসক মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, শোলাকিয়ার প্রস্তুতি শেষের দিকে। প্রবেশপথে নির্মাণ করা হচ্ছে সুদৃশ্য তোরণ। লাখ লাখ মানুষ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ আদায় করতে পারেন, সে লক্ষ্যে ঈদের দিন শহরে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। সার্বিক সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। চুনকাম ও লাইন টানা হয়েছে। ওজুখানা প্রস্তুত করা হয়েছে। শোলাকিয়া ঈদগাহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় জানানো হয়, সুষ্ঠুভাবে ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দান : কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের শোলাকিয়া এলাকায় মৃত নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তীর্ণ এ ঈদগাহ ময়দান। বড় জামাতের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়লে প্রচুর সওয়াব পাওয়া যায়—তাই প্রতিবছর ঈদের সময় দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির সমাগম ঘটে এখানে। ঈদের জামাত প্রায় সাত একরের ময়দান পেরিয়ে আশপাশের রাস্তা, জমি, বাড়ির ছাদ, নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। গত বছর ঈদুল ফিতরের জামাতে রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লি অংশ নেন। এ ঈদগাহ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে নানা বিশ্বাস ও জনশ্রুতি। এর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে স্বীকৃত মতবাদ অনুযায়ী কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদারবাড়ির লোকজন এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। জানা গেছে, ১৯২৮ সালে হয়বতনগর সাহেববাড়ির জমিদার সৈয়দ আহম্মদ তার সম্পত্তি শোলাকিয়ায় নিজের ইমামতিতে প্রথম ঈদের জামাত পরিচালনা করেন। পরে দেওয়ান মান্নান দাদ খান এ মাঠের কলেবর বৃদ্ধি করেন। দেওয়ান মান্নান দাদ খান ছিলেন জঙ্গলবাড়ির বীর ঈশা খাঁর বংশধর। মূলত তার সময় থেকেই শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের প্রসার ঘটে। শোলাকিয়া মাঠের ইতিহাস প্রায় আড়াইশ’ বছরের। উপমহাদেশের দ্বিতীয় ও বাংলাদেশের বৃহত্তম ঈদগাহ শোলাকিয়া ময়দানের নামকরণের সঠিক ইতিহাস এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। শোলাকিয়ার নামকরণ নিয়েও রয়েছে মতবিরোধ। প্রচলিত আছে একাধিক জনশ্রুতি। জানা যায়, শোলাকিয়ায় প্রথম ঈদের জামাতেই বিপুল সংখ্যক মুসল্লি অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় দিন দিন এ মাঠে মুসল্লি সংখ্যা বাড়তে থাকে। কথিত আছে-কোনো এক ঈদের জামাতে লোক সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে সোয়া লাখে (১ লাখ ২৫ হাজার)  পৌঁছেছিল। সেই থেকে এ মাঠের নামকরণ হয় ‘সোয়ালাখিয়া’। পরে কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় এর নামকরণ দাঁড়ায় শোলাকিয়া। আরেকটি জনশ্রুতি হচ্ছে-জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে যে ভূমি রাজস্ব আদায় করতেন, তার পরিমাণ এক বছর রেকর্ড সোয়া লাখ মুদ্রায় দাঁড়িয়েছিল। সেই থেকে এর নাম সোয়ালাখিয়া বা শোলাকিয়া হয় বলে ধারণা। তবে প্রথম জনশ্রুতিটি বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

শোলাকিয়ার জামাতে বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ : ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে সুদূর আসাম ও কুচবিহার থেকে অসংখ্য মুসল্লি ঈদের নামাজ পড়তে এখানে আসতেন। গত কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমে প্রচারের ফলে দেশ-বিদেশে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের পরিচিতি আরও বেড়েছে। এখনও ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেন। দেশের ভেতর ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের হাজার হাজার মুসল্লি অংশ নেন শোলাকিয়া ময়দানে।

শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান পরিচালনা : কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসকের (পদাধিকার বলে) সভাপতিত্বে একটি কমিটি শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান পরিচালনা করে আসছে। হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির এক প্রতিনিধি জমিদাতা হিসেবে মাঠের মোতোয়ালির দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিবছর ঈদের আগে জামাতের ইমাম নির্ধারণ করা হয়।

বন্দুকের গুলি ছুড়ে জামাত শুরু : শোলাকিয়া মাঠ বিশালাকৃতির। নামাজ শুরুর সময় মাঠের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত ভালো করে দেখা যায় না।
জামাত শুরুর ১০ মিনিট, ৫ মিনিট ও সর্বশেষ ৩ মিনিট আগে বন্দুকের ফাঁকা গুলি ছুড়ে নামাজ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়।

লিখেছেনঃ নূর মোহাম্মদ, কিশোরগঞ্জ