১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল৷ স্বাধীনতার গর্বে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ৷ শত বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাকে পেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে হাজার হাজার মানুষ৷ মিছিল হচ্ছে দেশজুড়ে৷ মিছিলে হাতে হাতে নতুন পতাকা৷ বাড়ির ছাদে উড়ছে নতুন পতাকা৷ সবুজ-শ্যামল বাংলার বুকে যেন রক্তস্নাত এক নতুন সূর্য উঠেছে৷
ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় মিছিল হচ্ছে৷ মিছিল দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন শ্যামলী নাসরিন৷ ছুটে যাচ্ছেন শম্পা, নীপা৷ ছুটে যাচ্ছেন হাফিজ৷ মিছিলের মুখগুলোতে তন্নতন্ন করে তাঁরা খুঁজছেন একটি মুখ৷ যাঁর এই মিছিলেই থাকার কথা৷ জনতার এই ঢলে ভেসে যাওয়ার আশায় দীর্ঘ নয় মাস ধরে তত্‍পর ছিলেন যিনি৷ এই মিছিল দেখার অপেক্ষায় প্রতিটি দিন প্রতিটি রাত কেটেছে তাঁর৷ অথচ হাজার হাজার মানুষের মধ্যেও তাঁকে খুঁজে পাচ্ছেন না শ্যামলী, শম্পা, নীপা ও হাফিজ৷ পরিচিত লোকদের দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন তাঁরা, কিন্তু কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারছে না৷ যাঁকে খোঁজা হচ্ছে তিনি শ্যামলীর স্বামী, শম্পা ও নীপার বাবা, হাফিজের বড়ভাই এবং অনেকের প্রিয় চিকিত্‍সক প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী৷ অনেকের চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি৷ অনেককে আশ্রয় দিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন৷ স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাহস ও অনুপ্রেরণা আলীম চৌধুরীকে পাওয়া যাচ্ছে না৷

১৫ ডিসেম্বর পুরানো পল্টনের বাসার দোতলার বারান্দায় স্ত্রী ও শাশুড়িকে নিয়ে বসেছিলেন আলীম চৌধুরী ৷ বিকেল তখন সাড়ে চারটা৷ শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে৷ ভারতীয় বোমারু বিমানগুলো ঢাকার আকাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে৷ বোমা ফেলছে হানাদার পাকিস্তানিদের ঘাঁটিগুলোতে৷ আকাশ তোলপাড় করা সেসব বিমানের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে আনন্দে-উত্তেজনায় টগবগ করছিলেন আলীম৷ বলছিলেন, ‘এদেশের পাকিস্তানিরা বোকার স্বর্গে বাস করছে৷ ভারতীয় বিমানগুলোকে বাধা দেওয়ার কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই৷ দেখো, দেখো, বিমানগুলো ইচ্ছেমতো বোমা ফেলছে৷ আর এখনও মাওলানা মান্নানের মতো পাকিস্তানিরা বলে কিনা আমেরিকা তাদের রক্ষা করবে৷ সপ্তম নৌবহর নাকি এসেছে৷’ বলেই প্রাণখুলে হাসলেন তিনি৷ অনেক দিন অনিশ্চতায়-আশঙ্কায় এই হাসি তিনি হাসতে পারেননি৷ আজ তিনি নিশ্চিন্ত৷ হাসতে হাসতেই বললেন, ‘দেখো, আর দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা স্বাধীন হয়ে যাব৷’

বিমানগুলো তখন পিলখানার দিকে বোমা ফেলছিল৷ সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন আলীম এবং তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়ি৷ খুব কাছেই একটা গাড়ির শব্দে তাঁদের মনোযোগ কেটে গেল৷ নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কাদা মাখানো একটা ছোটখাটো মাইক্রোবাস এসে নিচতলায় মাওলানা মান্নানের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে৷ তার কাছে এ রকম মাইক্রোবাস প্রায় প্রতিদিনই আসে৷ এ ধরনের মাইক্রোবাস যতবার এসে গেটে দাঁড়ায় ততবারই একটা আশঙ্কা হয়৷ আলীম মাইক্রোবাসটা দেখে বললেন, ‘উঁকিঝুঁকি দিও না৷ ভেতরে যাও৷’ বলে তিনি বাথরুমে ঢুকলেন আর তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়ি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন৷ এর প্রায় ৪৫ মিনিট পর তাঁদের সিঁড়ির নিচের দরজার বেল বাজল৷ আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ওপর থেকেই দেখলেন, বন্দুক উঁচিয়ে দুজন আলবদর দরজা খুলতে বলছে৷ কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না শ্যামলী৷ স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করব?’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলীম বললেন, ‘খুলে দাও৷’ বলেই তিনি নিচের তলায় মাওলানা মান্নানের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন৷ শ্যামলী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ তিনি বললেন, ‘মাওলানা সাহেবের কাছে৷ তিনি তো কোনো অসুবিধা হলেই যেতে বলেছেন৷’

১৯৭১ সালের কিছু আগে আজিমপুরের বাসা ছেড়ে পরিবারসহ তিন তলা এই বাড়িটায় এসে উঠেছিলেন আলীম চৌধুরী৷ দুই ও তিন তলায় থাকার ব্যবস্থা আর নিচ তলায় ক্লিনিক৷ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়৷ জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে একদিন সকাল দশটার দিকে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল৷ এ রকম বৃষ্টির মধ্যেই প্রতিবেশী পিডিপির (তত্‍কালীন রাজনৈতিক দল) মতিন সাহেব পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা মান্নানকে নিয়ে এলেন আলীমের কাছে৷ মতিন সাহেব তাঁকে বললেন, ‘এই ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে অত্যন্ত বিপদে পড়েছেন৷ তাঁর গ্রামের ঘরবাড়ি কে বা কারা জ্বালিয়ে দিয়েছে৷ একেবারেই নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছেন৷ এই মুহূর্তে তাকে আশ্রয় না দিলে ভদ্রলোক খুবই অসুবিধায় পড়বেন৷’

সব শুনে আলীম ওপরে উঠে এলেন৷ শ্যামলীকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করা যায়৷ শ্যামলী এক কথায় না করে দিলেন৷ স্ত্রীর ‘না’ বলার জোর দেখে আলীম আর কথা বাড়ালেন না৷ নিচে নেমে গেলেন তাদের মানা করে দিতে৷ কিন্তু মতিন ও মান্নানের কাকুতি-মিনতি শুনে আবার ওপরে উঠে এলেন তিনি৷ আলীম এবার তাঁর মাকে অনুরোধ করলেন শ্যামলীকে রাজি করানোর জন্য৷ শাশুড়ির অনুরোধ ফেলতে পারলেন না শ্যামলী৷

অনুমতি পেয়ে মান্নান স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এক কাপড়ে উঠে এলেন বাড়িটার এক তলায়৷ ক্লিনিকের রোগীদের বিছানা-চাদর পাল্টে তাদের থাকতে দিলেন আলীম৷ ক্লিনিক তো বন্ধই হয়ে গিয়েছিল৷ এবার চেম্বারটিও সরিয়ে আনা হোঁ নিচ তলা থেকে দোতলায়৷ চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত মান্নানের পরিবারের চা, নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার ব্যবস্থা করলেন আলীম৷ সপ্তাহখানেকের মাথায় মান্নানের ঘরগুলো জিনিসপত্রে ভরে উঠতে লাগল৷ কিছুই নেই, সব জ্বালিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এই লোকটা এই কয়েক দিনের মধ্যে এত এত আসবাবপত্র পাচ্ছে কোথায়? সন্দেহ বাড়ছিল আলীম ও শ্যামলীর৷ দশ-বারো দিনের মাথায় সব জানা গেল৷ তাঁরা তখন বুঝতে পারলেন কী বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে৷ এই লোকটা আলবদর বাহিনীর সংগঠক৷ স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতৃস্থানীয় একজন৷ তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী৷ সব জেনে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছু করার থাকল না৷ খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন আলীম৷ তাঁর এই করুণ অবস্থা দেখে স্ত্রী আর দোষারূপ না করে অন্য কোথাও সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে বললেন৷ বাড়ি খোঁজাও চলছিল৷ চুপিসারে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন তাঁরা৷ এদিকে সারা রাত মাওলানার বাসায় দেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস আর পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হৈ-হল্লা লেগেই আছে৷ পালিয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় পাচ্ছিলেন না৷ এরমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটা চিঠি এল মান্নানের কাছে৷ চিঠিতে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে: আলীম ভাই ওপরে না থাকলে তোকে কবেই বোমা মেরে উড়িয়ে দিতাম৷ এরপর থেকেই আলীম চৌধুরীর বাসার নিচ তলার সিঁড়ি দরজার বাইরে দুজন আলবদর দিয়ে সার্বক্ষণিক পাহারা বসানো হল৷ ব্যাপারটা যাতে আলীমের পরিবার না বুঝতে পারে সেজন্য মান্নানের গেটেও পাহারায় ছিল আরও চার-পাঁচজন৷ মনে মনে দুরভিসন্ধি থাকলেও মুখে সবসময় আলীম চৌধুরীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে মান্নান৷ দেখা হলেই বলে, ‘ডাক্তার সাহেব, আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলব না৷ আপনার কোনো ভয় নাই৷ আপনার কোনো বিপদ হবে না৷ যদি কখনো কোনো অসুবিধায় পড়েন, সোজা আমার কাছে চলে আসবেন৷ আমি আপনাকে রক্ষা করব৷ আমার জীবন থাকতে আপনার কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না৷’

মাওলানার এসব কথা মনে করেই আলীম সিঁড়ি দিয়ে নেমে মান্নানের দরজায় টোকা দিলেন৷ ভেতর থেকে কেউ কোনো সাড়া দিল না৷ আলীম এবার একটু জোরে আঘাত করতে করতে বললেন, মাওলানা সাহেব, দরজাটা খুলুন, দরজাটা খুলুন৷ এবারও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এল না৷ এবার প্রাণপনে দরজায় আঘাত করতে করতে মাওলানা মান্নানকে ডাকলেন তিনি৷ অনেকবার ডাকার পরও মান্নান দরজা খুলল না৷ ভেতর থেকে শুধু একবার বলল, ‘ভয় পাবেন না৷ আপনি যান৷ আমি আছি৷’

আলীম চৌধুরী তখন দৌড়ে ওপরে উঠতে যাচ্ছিলেন৷ ততক্ষণে বন্দুকধারী আলবদররা ভেতরে ঢুকে গেছে৷ আলীম চৌধুরী বলার পর বাসার কাজের ছেলে হাকিম ও মোমিন দরজা খুলে দিয়েছিল৷ বন্দুকধারীরা তাঁকে দৌড়ে ওপরে উঠতে দেখেই বলল, ‘হ্যান্ডস আপ! আপনি আমাদের সাথে চলুন৷’

তিনি জানতে চাইলেন, ‘কেন? আপনাদের সঙ্গে যাব কেন?’ ওরা বলল, ‘দরকার আছে৷ খুবই জরুরি দরকার৷’ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে৷ ভেতর থেকে কাপড়চোপড় পাল্টে আসি৷’ ওরা বলল, ‘না, না, অন্য কাপড়ের দরকার নেই৷’ বন্দুকধারীরা কথা বলছিল শান্তভাবেই৷ তবে তাদের কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল৷ আলীম চৌধুরী তাদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘তা কোথায় যেতে হবে আমাকে?’ ওরা বলল, ‘সেটা গেলেই জানতে পারবেন৷ চলুন৷’ আলীমকে নিয়ে বন্দুকধারীরা গেটের বাইরে যেতেই দৌড়ে দোতলায় ওঠে এল হাকিম আর মোমিন৷ শ্যামলীকে বলল, ‘সাহেবকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে৷’

কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না শ্যামলী৷ এই এতদিনেও মান্নান লোকটার সাথে কোনো কথা বলেননি তিনি৷ কোনোকিছু ভেবে না পেয়ে তার কাছেই ছুটে গেলেন৷ দরজায় কয়েকবার আঘাত করে ডাকতেই ভেতর থেকে সাড়া দিল মান্নান৷ দরজা খুলে দিল সে৷ মান্নান এই ফাঁকে একটু যেন দেখেও নিল তার স্যাঙ্গাতরা ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে কি না৷ শ্যামলী মান্নানের সামনে কাতর অনুনয়ে ভেঙে পড়লেন: ‘মাওলানা সাহেব, গাড়িটা এখনও ছাড়েনি৷ আপনি একটু দেখুন৷ দয়া করে ওদের বলুন, ওকে যাতে ওরা ছেড়ে দেয়৷’ মান্নান শ্যামলীর অনুনয় শুনছিল না৷ সোফায় বসতে বসতে সে বাইরের দিকে কান পেতে ছিল৷ সোফায় বসার পরও বাইরের দিকে কান পেতে ছিল৷ এ সময় মাইক্রোবাস ছাড়ার শব্দ পাওয়া গেল৷ গাড়ির শব্দে কান্না আর ধরে রাখতে পারলেন না শ্যামলী৷ গাড়ি ছাড়ার শব্দে নিশ্চিত হয়েই যেন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেল মান্নান৷ বলল, ‘অস্থির হবেন না৷ ওরা আমার ছাত্র৷ ওরাই ওনাকে নিয়ে যাচ্ছে৷ ডাক্তার রাব্বিকেও নিয়ে গেছে৷’

ডাক্তার ফজলে রাব্বির নাম শুনে শ্যামলী বললেন, ‘কেন নিয়ে গেছে? কোথায় নিয়ে গেছে?’ মান্নান বললেন, ‘নিয়ে গেছে সিএমএইচ’-এ (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল)৷ মান্নানের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে দোতলায় ফিরে এলেন শ্যামলী৷ মিসেস রাব্বিকে ফোন করতে চাইলেন৷ অনেক চেষ্টার পর পেলেন৷ মিসেস রাব্বি বললেন, ‘চারটার দিকে ডাক্তার রাব্বিকেও নিয়ে গেছে৷’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বললেন, ‘ওরা কি আর ফিরবে?’ মিসেস রাব্বির কথায় আঁতকে উঠলেন শ্যামলী৷ তাঁর বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তের মধ্যে শূন্য হয়ে গেল৷ পুরো বাড়িটা যেন কয়েকবার দুলে উঠল৷ দ্রুত ফোন রেখে দিলেন৷ আবার ছুটে গেলেন মান্নানের কাছে৷ এবার সরাসরি জানতে চাইলেন, ‘আপনি আমাকে সঠিক খবর দিন ‘ও’ কোথায় আছে?’

শ্যামলীর কাছ থেকে এ রকম সোজাসাপ্টা প্রশ্ন শুনে খানিকটা মিইয়ে গেল মান্নান৷ বলল, ‘ভাবি সাহেব, এত উতলা হওয়ার কিছু নেই৷ বললাম তো, চিকিত্‍সার জন্য নিয়ে গেছে৷ কাজ শেষ হলেই দিয়ে যাবে৷ ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সাথে আমার কথা হয়েছে৷’ মান্নানের কথায় শ্যামলী যেন আবার একটু আশ্বাস পেলেন৷ বললেন, ‘শীতের কাপড় নেয়নি৷ ওগুলো তাহলে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিন৷’ মান্নান বলল, ‘সে ব্যবস্থা ওরাই করবে৷’

শ্যামলী আবার ওপরে উঠে এলেন৷ রাত বাড়ছে৷ ঘুম আসছে না৷ কান পেতে বসে আছেন দরজার বেল শোনার জন্য৷ সামান্য খুটখাট আওয়াজেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ বারবারই এসব আওয়াজে তাঁর মনে হচ্ছে, এই বুঝি আলীম এসে গেছে৷ স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে তিনি ফিরে যান অতীতের দিনগুলিতে-

তিনি তখন মাস্টার্সে পড়াশোনার পাশাপাশি টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে শিক্ষকতা করছেন৷ লন্ডন থেকে ফিরে সেখানেই কুমুদিনী হাসপাতালে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দিলেন আলীম৷ আলীমের যোগদানের বিষয়টি ভারতেশ্বরী হোমস ও কুমুদিনী হাসপাতালের লোকজনের কাছে একটা আলোচনার বিষয় ছিল৷ শুনতে শুনতে ডাক্তার আলীম সম্পর্কে একটা ধারণাই গড়ে ওঠে শ্যামলীর৷ ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫৷ এই সময়টায় আলীম সম্পর্কে কিছু জানাশোনা হয়েছিল শ্যামলীর৷ শ্যামলী সম্পর্কেও কিছু জেনেছিলেন আলীম৷ কুমুদিনী হাসপাতাল ছেড়ে আসার সময় আলীম বুঝতে পারেন এখানকার একজনের কাছে তাঁর মনটা থেকে যাচ্ছে৷ ঢাকায় চলে আসার পর দুজনের মধ্যে চিঠিপত্রে ভাব বিনিময়৷ পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক পর্যায়ে আলীমকে বিয়ে করতে রাজি হন শ্যামলী৷ দুজনের মধ্যে ছিল ধর্মীয় ব্যবধান৷ সে বাধাও পার হন তাঁরা৷ শ্যামলীর বাবার পরিবার অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল শ্যামলীর ওপর৷ বিয়ের পর শ্যামলীর ভাইবোন ও বাবা-মাকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় নিজেদের বাসায় নিয়ে আসেন আলীম৷ নিজের বাবা-মা ও ভাইবোনকে যেমন ভালোবাসতেন, শ্যামলীর বাবা-মা ও ভাইবোনকেও তেমনি ভালোবাসতেন আলীম৷

আলীমের জন্মের সালটি মনে পড়ে যায় শ্যমলীর- ১৯২৮ (বাংলা ১৩৩৫ সালে ৩ বৈশাখ)৷ ১৯২৮ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার খয়েরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি৷ আলীমেরা তিন ভাই ও এক বোন৷ আলীম তৃতীয়৷ ডাকনাম টুনু৷ বাবা আব্দুল হেকিম চৌধুরী জেলা স্কুল পরিদর্শক৷ কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার খয়েরপুর গ্রামে ছিল হেকিম চৌধুরীর দাদার জমিদারি৷ হেকিম চৌধুরী বড় হতে হতে সে জমিদারির তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না৷ জমিদারি না পেলেও মানুষের ভালবাসা পেয়েছিলেন৷ কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে হেকিম চৌধুরীকে৷ বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছেন৷ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে শিক্ষালাভ করে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর কৃচ্ছ্রতাসাধন ও হারানো পৈত্রিক সম্পত্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টার মাধ্যমে সংসারে সচ্ছলতা এনেছিলেন তিনি৷ সন্তানদের কঠোর শাসনে মানুষ করেছেন তিনি৷ ধর্ম ও সাহিত্যচর্চায় তাঁর ঝোঁক ছিল৷

শ্যামলীকে ছোটবেলার অনেক গল্প শুনিয়েছেন আলীম৷ তিনি ছিলেন খুব জেদি৷ তাঁর জেদের কাছে কড়া মেজাজের লোক হেকিম চৌধুরীরও হার হয়েছিল৷ তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত খয়েরপুরের গ্রামের স্কুলেই পড়েছেন আলীম৷ পরে ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ হাইস্কুলে৷ চাচাত বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা৷ ব্যাপারটা শুরু থেকেই আলীমের মনে ধরেনি৷ এক সময় বেঁকেই বসলেন তিনি৷ বাবাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, আত্মীয় বাড়িতে থেকে লেখাপড়া তিনি করবেন না৷ বাধ্য হয়ে বাবা তাঁকে টাকা-পয়সা বাড়িয়ে দিলেন যাতে তিনি নিজের মতো থাকতে পারেন৷ কিন্তু যে টাকা মাসিক বরাদ্দ দিলেন তাতে চলছিল না৷ খরচের টাকা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার জিদ ধরলেন তিনি৷ বাবাকে বললেন, না হলে পড়ালেখা নয়, গ্রামে গিয়ে চাষাবাদ করবেন৷ আবারও ছেলের জেদের কাছে হার হলো বাবার৷

আলীম ১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৪৫ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন৷ এই দুই পরীক্ষায়ই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন৷ ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন তিনি৷ এরপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য লন্ডনে যান এবং সেখান থেকে ১৯৬১ সালে ডিও ডিগ্রি অর্জন করেন৷ শ্যামলীকে খয়েরপুর গ্রাম, হাইস্কুলের বন্ধু-বান্ধব ও কলকাতার দিনগুলোর কথা বলতেন তিনি৷

ছবি তোলা ও লেখালেখির শখ ছিল আবদুল আলীম চৌধুরীর৷ ছাত্রজীবনে ‘খাপছাড়া’ ও ‘যাত্রিক’ নামে দুটি প্রগতিশীল মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন৷ ছাত্র থাকাকালেই তিনি ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন৷

কিশোর বয়স থেকেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন আবদুল আলীম চৌধুরী৷ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট সফল করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন৷ ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি৷ এজন্য ১৯৫৩ সালে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়৷ তিনি শ্যামলীকে বলতেন ভাষা-আন্দোলনের ও কারাগারের দিনগুলোর কথা৷ ১৯৫৪-‘৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন৷ ১৯৫৭-‘৫৮ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (তত্‍কালীন পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক৷ পরে ১৯৬৭ সালে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি৷ ১৯৬২ সালে লন্ডনে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন৷ ১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান অপথালমোলজিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হন৷ এর আগে ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মেডিক্যাল জার্নালের সম্পাদক ছিলেন তিনি৷ ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত লন্ডনের সেন্ট জেমস হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ছিলেন আলীম৷ লন্ডনের দিনগুলোর কথা তিনি শোনাতেন শ্যামলীকে৷

এ রকম আরও অনেক গল্পই মনে পড়ে শ্যামলীর৷ সব যেন শ্যামলীর মনে ভিড় করে আসে৷ ঘুম আসে না৷ নির্ঘুম সারারাত কেটে গেল তাঁর৷ পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সারা দিন খুঁজেও আলীমের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না৷ কেউ তাঁকে আলীমের খবর জানাতে পারে না৷ শ্যামলীর দিশেহারা হওয়ার অবস্থা৷ তবে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছেন তিনি৷ কারণ, তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না৷ কাজের ছেলেদের পাঠিয়েছেন গেণ্ডারিয়ায় আলীমের ছোটভাই আবদুল হাফিজ চৌধুরীর কাছে৷ রাস্তায় এলোপাতাড়ি গুলি চলার কারণে তারা যেতে না পেরে ফিরে এল৷

কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এলেন আলীমের খবর জানতে৷ আলীমকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে তাঁরা এসেছে৷ তাঁরা জানতে চাইলেন, মাওলানা মান্নান কোথায়? রাত থেকে মান্নানের কোনো খবর রাখেননি শ্যামলী৷ পরিস্থিতি দেখে তাদের খাবার ঘরে এসে লুকিয়েছিল মান্নান৷ কিন্তু মান্নান যে কখন পালিয়েছে তা তিনি খেয়ালই করেননি৷ মান্নানকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেল মুক্তিযোদ্ধারা৷ পুরো দিনটি কাটল অপেক্ষায়৷ আলীমের ফিরে আসার অপেক্ষায় এক একটি প্রহর যুদ্ধের নয় মাসের চেয়েও দীর্ঘ মনে হলো শ্যামলীর৷ ১৭ ডিসেম্বর হাফিজ এল৷ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল খুঁজতে৷ ভাইয়ের খোঁজ জানার জন্য মান্নানকে খুঁজছিলেন তিনি৷ খুঁজতে খুঁজতে আজিমপুরের এক বাসায় মান্নানকে পেলেন৷ লোকজন তাকে পিটিয়ে মেরেই ফেলতে চাচ্ছিল৷ হাফিজ ভাবলেন, মেরে ফেললে অনেককিছু অজানা থেকে যাবে৷ সব খোঁজখবর জেনে নিয়ে পরে মারতে হবে৷ মান্নানকে তিনি রমনা থানায় সোপর্দ করলেন৷ পরে সে ছাড়া পেয়ে যায়৷

১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১৷ রায়ের বাজারের ইটখোলার বধ্যভূমিতে অনেক লাশের সন্ধান মিলেছে৷ লোকজন সেখানে খুঁজছে তাঁদের হারানো স্বজনের লাশ৷ হাফিজও ভাইকে খুঁজতে গিয়েছিলেন সেখানে৷ সাথে ছিল পারিবারিক বন্ধু এরশাদ ও আলীমের বাসার কাজের লোক হাকিম ও মোমিন৷ পাকিস্তানি বর্বর হানাদার আর তাদের এ দেশীয় দোসরদের নারকীয় হতাকাণ্ড এতই বীভত্‍স যে সহজে কোনো মৃতদেহ সনাক্ত করা যাচ্ছিল না৷ অনেকক্ষণ সেসব মৃতদেহের ভিড়ে ঘুরে ভাইকে পেলেন না হাফিজ৷ বীভত্‍সতা দেখে তাঁর মাথাটাই খারাপ হওয়ার জোগাড়৷ শেষে আর কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি৷ বিক্ষুব্ধ আর বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে ফিরে আসতে যাচ্ছিলেন৷ আলবদররা ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আলীমের পরনে ছিল শার্ট আর লুঙ্গি৷ গায়ে শার্ট ও লুঙ্গি, উবু হয়ে পড়ে থাকা একটি মৃতদেহ দেখে সন্দেহ হয় সঙ্গী এরশাদের৷ তিনি হাফিজকে ডেকে লাশটি দেখতে বলেন৷

শার্টটি গায়েই ছিল৷ পরনের লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপরে উঠে আছে৷ হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা৷ চোখ বাঁধার গামছাটা গলায় এসে ঠেকেছে৷ ছড়ানো ছিটানো ইটের ওপর মৃতদেহটি পড়ে আছে৷ চারপাশে শুকিয়ে আসা ছোপ ছোপ রক্ত৷ কাছে গিয়ে মৃতদেহর মুখের দিকটি তুলে ধরলেন হাফিজ৷ আর কোনো সন্দেহ রইল না৷ এটাই তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাই৷ বুকটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে৷ তলপেট ও কপালের বাঁ দিকে বেয়োনেটের আঘাতের চিহ্ন৷ দুর্লভ এই প্রাপ্তিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলেন হাফিজ৷

১৮ ডিসেম্বর প্রখ্যাত চিকিত্‍সক আব্দুল আলীম চৌধুরীকে আজিমপুর গোরস্তানে তাঁর বাবার কবরেই পাশেই সমাহিত করা হয়৷

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

বিখ্যাত চিকিত্‍সক এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালে (বাংলা ১৩৩৫ সালে ৩ বৈশাখ) কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার খয়েরপুর গ্রামে৷ ১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৪৫ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন৷ এই দুই পরীক্ষায়ই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন৷ ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন তিনি৷ এরপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য লন্ডনে যান এবং সেখান থেকে ১৯৬১ সালে ডিও ডিগ্রি অর্জন করেন৷

কিশোর বয়স থেকেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন আবদুল আলীম চৌধুরী৷ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট সফল করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন৷ ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি৷ এজন্য ১৯৫৩ সালে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়৷ ১৯৫৪-‘৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন৷

পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম চৌধুরী ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত লন্ডনের সেন্ট জেমস হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ছিলেন৷ এরপর দেশে ফিরে ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে তিনি মীর্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে যোগ দেন প্রধান চক্ষু চিকিত্‍সক হিসেবে৷ ঢাকার পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন তিনি ১৯৬৭ সালে৷ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৯৬৮ সালে৷ এরপর কিছুদিন ছিলেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিভাগে৷ তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ৷

বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আবদুল আলীম চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷ ১৯৫৭-‘৫৮ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (তত্‍কালীন পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক৷ পরে ১৯৬৭ সালে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন৷ ১৯৬২ সালে লন্ডনে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠায় তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন৷ ১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান অপথালমোলজিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হন৷ এর আগে ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মেডিক্যাল জার্নালের সম্পাদক ছিলেন তিনি৷

ছবি তোলা ও লেখালেখির শখ ছিল আবদুল আলীম চৌধুরীর৷ ছাত্রজীবনে ‘খাপছাড়া’ ও ‘যাত্রিক’ নামে দুটি প্রগতিশীল মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন৷ ছাত্র থাকাকালেই তিনি ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন৷

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর আলবদররা তাঁকে ঢাকার পুরানো পল্টনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়৷ স্বাধীনতার পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে আরও অনেকের সঙ্গে আবদুল আলীম চৌধুরীর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়৷ আলবদররা মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ এই চিকিত্‍সককে নির্মমভাবে হত্যা করে৷

শহীদ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী উদয়ন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন৷ বর্তমানে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত উদ্দীপন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক৷ তাঁদের দুই কন্যা, ফারজানা চৌধুরী নীপা এবং নুজহাত চৌধুরী শম্পা৷ দুজনই চিকিত্‍সক হিসেবে কর্মরত৷

কৃতজ্ঞতা
এই লেখাটির জন্য ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন শহীদ ডা. এএফএম আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী৷ এছাড়া মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর লেখা ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী’ গ্রন্থটি বিশেষ সহায়ক হয়েছে৷ সহায়ক হয়েছে রক্তঋণ থেকে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিত্‍সক: স্মৃতিকথা’, সময় প্রকাশনের ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আমীরুল ইসলাম ও আসলাম সানী সম্পাদিত ‘আমার বাবা: শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানদের স্মৃতিকথা’, বাংলা একাডেমী থেকে রশিদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ ও ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ এবং বাংলা একাডেমীর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’৷

লেখক : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ