আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কিশোরগঞ্জ একটি পশ্চাৎপদ ও অবহেলিত জেলা, উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা, ভঙ্গুর যোগাযোগ অবকাঠামো, অপর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক পরিষেবা ইত্যাদি সমস্যায় জেলাবাসী জর্জরিত। এসব সমস্যার জন্য বিগত প্রতিটি সরকার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এলাকার উন্নয়নে উদাসীনতা, সমন্বয়হীনতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে জনগণের প্রতি তাদের অবজ্ঞা প্রদর্শনকে দায়ী করা হয়ে থাকে। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গর্ববোধ করেছে কিশোরগঞ্জবাসী।

কারণ জেলার সব ক’টি সংসদীয় আসনে মহাজোট সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সংসদের স্পিকার, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের ১৮ মাস অতিবাহিত হলেও উন্নয়নের এক পসলা বৃষ্টিও কিশোরগঞ্জে বর্ষিত হয়নি, যা শহরের ধুলোবালি ও ময়লা-আর্বজনাকে পরিষ্কার করে দিতে পারে।

রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে মাত্র ১৪০ কিলোমিটার ও রেলপথে ১৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের জেলা শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। যখন এ লেখা লিখছি, তখন জেলার প্রধান প্রবেশ সংযোগ সড়কের সেতু ভেঙে পড়ে আছে। আরও কয়েকটি মেয়াদোত্তীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দীর্ঘ দুই দশকের সংস্কারহীনতার ভার সইতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ার প্রহর গুনছে। একটি মাত্র আন্তঃনগর ট্রেন এগারসিন্দুর অপ্রতুল আসন ও নিুমানের সেবা নিয়ে কদাচিৎ যথাসময়ে স্টেশন ছেড়ে যায় ও গন্তব্যে পৌঁছায়। রাজধানী ঢাকা থেকে এ জেলায় ট্রেনে কিংবা বাসে পৌঁছতে সময় লাগে গড়ে ৫ ঘণ্টা, কোন কোন ক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টারও বেশি।

মানুষের এসব ভোগান্তির ব্যাপারে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরাবরই নির্লিপ্ত। ২৬৮৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জেলার ১৩টি উপজেলা ও ১০৮টি ইউনিয়নের অধিকাংশের সঙ্গে শহরের সংযোগ সড়ক নেই। গ্রামগুলোর অবস্থা আরও করুণ। হাওর অঞ্চল হিসেবে জলপথে পরিবহনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সংস্কার ও খননের অভাবে অধিকাংশ নদী-নালা ও খাল-বিল নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে পণ্য পরিবহন তথা যাতায়াতের বিকল্প ও সহজ ব্যবস্থাটিও ক্রমে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এখানকার নদীকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ পদ্ধতি ও সংস্কৃতি। জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সড়ক পথটি এতই অপ্রশস্ত যে, ঢাকাগামী বাসগুলোকে মুখোমুখি অতিক্রমের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। বাড়তি ভোগান্তি হিসেবে রয়েছে এক যুগেরও বেশি সময় থেকে সাইনবোর্ড ঝুলানো গোটা ছয়েক ঝুঁকিপূর্ণ সেতু।

জেলায় নেই কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজÑ এমনকি জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠান। একমাত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান কালিয়াচাপড়া চিনিকলটি দেখভালের অভাবে ক্রমাগত লোকসানের মুখে বন্ধ হয়ে বর্তমানে বেসরকারি মালিকানায়। শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নরসুন্দা নদীটি মৃতপ্রায়। বর্তমান সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর জেলায় শিক্ষার উন্নয়নে উদ্যোগ নেই। বরং যা আছে তা হল, দেশের সবচেয়ে নিরক্ষর এলাকার (নিকলী থানা) উপাধি।

এরপরও আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, কিশোরগঞ্জকে নিয়ে পত্রিকায় আর লেখা হবে না সবচেয়ে নোংরা, ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধের শহর, অশিক্ষিতের জেলা, কোমর ভাঙা রাস্তার শহর। জেলার একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ প্রত্যাশা খুব সামান্য। আমরা কোন অগ্রাধিকার চাই না, চাই না কোন স্বজনপ্রীতি। শুধু চাই দেশের অন্য সব জেলার মতোই উন্নয়ন বাজেটে কিশোরগঞ্জ বিবেচনায় থাকুক। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও সত্যজিৎ রায়ের নামের সঙ্গে যুক্ত এ জেলায় শিক্ষা উপদেষ্টার প্রচেষ্টায় ফিল্ম, মিডিয়া ও চারুকলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মাঠের পরিচিতি বাড়াতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর উদ্যোগে এর সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্প গৃহীত হোক।

দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতে সারাদেশের মুসল্লিদের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে ঈদ উপলক্ষে ইজতেমার মতো বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করা যেতে পারে। আর এর জন্য প্রয়োজন হবে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ রেললাইন সংস্কার ও সেবার আধুনিকায়নের। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে একনেকে বিশেষ প্রকল্প অনুমোদন ও দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হোক। ভৈরব থেকে জেলা শহরের সংযোগ সড়ক সংস্কার করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মতো প্রশস্ত করা হোক। বাংলার বার ভূঁইয়ার অন্যতম ঈসা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত এগারোসিন্ধুর দুর্গটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হোক। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি ও রামায়ণের অনুবাদক ‘চন্দ্রাবতী’র স্মৃতি উদ্ধার করা হোক।

সৈয়দ নজরুল ও আইভি রহমানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে¡র স্মৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রপতি ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মানের রাজনীতি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হোক যেখান থেকে দুনিয়ার নারী-পুরুষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও অধিকার সচেতন হয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেতে পারে।

হাওর অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে স্পিকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হোক একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। সর্বোপরি যেটা চাই জনপ্রতিনিধিরা এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখে অতীতের মতো অধরা ও ডুমুরের ফুল না হয়ে জনকল্যাণ ও উন্নয়নবান্ধব মানসিকতাকে ধারণ করুন, জেলা উন্নয়নের রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ ও নিবেদিত হোন।

শাহেদুর রহমান শামীম
প্রভাষক,  এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ