ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে কথা বলতে গেলে এর অপকারিতা কি তা নিয়ে আশা করি আর বলার প্রয়োজন নেই। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরাই আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ স্বরূপ উপস্থিত আছে। আমি এখানে শুধু ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তার কথাই বলব। যারা আমার মত একই পথে চিন্তা করেন তাদের সাথে শুধু আইডিয়া শেয়ার করাই আমার উদ্দেশ্য। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যখন কোন বিতর্ক শুরু হয় তখন এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথাই আসে। আর এগুলো আমরা এতবার ই শুনেছি যে এগুলো আর পুনরায় বলার প্রয়োজন বোধ করি নেই। তবে যেহেতু আমি পক্ষে কথা বলতে নেমেছি তাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত যুক্তিটা একবার উল্লেখ করা যায় বলে মনে করি। আর তা হচ্ছে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা আর গনতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই আমরা এটা এড়িয়ে যেতে পারি না। আবার আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না ছাত্রদের মারামারি, খুনোখুনি,চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছাত্র নির্যাতন, বেপরোয়া কর্মকান্ড আর শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করা সহ গুরুতর সব অভিযোগ। আমরা এমন একটি দ্বন্দ্বে আটকে গেছি যা থেকে বেরিয়ে এসে কোন পদক্ষেপ নেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিতে চান। তারা বলেন এটা ৬৯, ৭১ কিংবা ৯০ নয়। এখন আর ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন নেই। আমি জানি না আরেকবার ৯০ ফিরে আসাটা খুবই অসম্ভব কিনা। এটাও জানি না ছাত্রদের খুনোখুনি বন্ধ করা একেবারেই অসম্ভব কিনা। তবে আমি চাই ছাত্র রাজনীতি সুপথে ফিরে আসুক এবং টিকে থাকুক সদম্ভে।

ছাত্রদের আর জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখার প্রয়োজন নেই এই কথাটা আমি তর্কের খাতিরে আপাতত মেনে নিলাম। কিন্তু ক্যাম্পাসের ভিতরে ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা ব্যাপার আছে, এই বিষয়টিকে আমরা অবহেলা করব কি করে? যেসব মুরুব্বিরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার পরামর্শ দেন তারা কি ছাত্রদের অধিকার আদায়ের নিশ্চয়তা দিতে পারবেন? তারা বলতে পারেন ছাত্রদের অধিকার তো কেউ নষ্ট করতে যাচ্ছে না। আমরা তা বিশ্বাস করব কিসের ভিত্তিতে? চাহিদা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের সুযোগ-সুবিধা কি কখনও নিশ্চিত করা হয়েছে? পারলে একটি উদাহরণ দিন। মেধাবী ছাত্ররা তাদের মেধা বিকাশের সুবিধা ঠিকমত পাচ্ছে কি? যারা এর মধ্যেও ব্যাতিক্রমী সাফল্য দেখাতে পেরেছে তারাও পথে ঘাটে পঁচে মরছে। আপনারা নিশ্চিত করবেন আমাদের সুবিধা? এটাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? প্রত্যেক ব্যাক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেনীর স্বার্থ তাদের নিজেদেরই রক্ষা করতে হয়। ছাত্ররা যদি সংঘবদ্ধ না থাকে তাহলে তাদের দাবি কখনও আলোর মুখ দেখবে না।

আমাদের কতৃত্ববাদী সংস্কৃতি কথাও কিন্তু ভুলে যাওয়া চলবে না। যেখানে কোন প্রতিরোধ না থাকে সেখানে আমরা কোন ধরণের মগের মুল্লুক সৃস্টি করতে পারি তা তো আমরা জানি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটে তার কিছু নমুনা এখানে আমি তুলে ধরতে পারি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক যে ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তার তালিকাই অনেক দীর্ঘ। ৩৬ টি ক্লাসের জায়গায় অনেকে ৫ থেকে ১৫ টা ক্লাস নেন, ক্লাসে দেরী করে আসেন, সিডিউলের বাইরে যখন খুশি ক্লাস নেন (এমন কি সন্ধার পর কিংবা বন্ধের দিনে), টানা ২/৩ ঘন্টা ক্লাস নেন, ক্লাসে আলোচনা না করে শুধু প্রজেক্টরে তৈরি শীট দেখান, ২/৩ মাস ক্লাস না নিয়ে ১ মাসে কোর্স কমপ্লিট করার চেষ্টা করেন, প্রস্তুতির সময় না দিয়েই পরীক্ষা নেন, অপছন্দের ছাত্রকে কম মার্কস দেন, রেজাল্ট দিতে দেরি করেন (কখনো কখনো ২ বছর পর্যন্ত), রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের ছাত্রদের সময়মত পাস করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃস্টি করেন, কোর্সে খারাপ করানোর কথা বলে অথবা বেশি নাম্বারের লোভ দেখিয়ে ছাত্রীদের বিছানায় নেন, সর্বোপরী কেউ তাদের ভূল ধরলে বা কোন প্রকার প্রতিবাদ করলে সার্টিফিকেট খেয়ে ফেলার হুমকি দেন। যারা ক্ষমতাশালী শিক্ষক তারা বিভিন্ন লাভজনক পদ লাভের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত থাকেন, ছাত্রদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন, এমন কি অতি সম্প্রতি আমি একটি ঘটনায় দেখেছি যে গন্ডগোল লাগানোর আগে মিটিং করে তারা সম্ভাব্য লাশের সংখ্যাও হিসাব করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা নয়-ছয় করার কথা তো সবাই জানেন। এখন বলুন ছাত্রদের সংগঠন থাকার প্রয়োজন আছে কিনা? ছাত্রদের হাতে যদি শক্তি না থাকে তাহলে সার্টিফিকেটের ভয় দেখিয়ে তারা সব প্রতিবাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করে দিবে।

এছাড়া ছাত্রদের প্রয়োজন শুধু ছাত্ররাই বুঝতে পারে। তাই তারা যেসব প্রয়োজন উপলব্ধি করবে তার দাবি তাদেরই তুলতে হবে এবং তাদেরই আদায় করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। ছাত্রদের মধ্য থেকে ভবিষ্যত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। এ ধরনের আরো অসংখ্য বিবেচনায় ছাত্র রাজনীতি চালু রাখা প্রয়োজন।

এবার আমি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ছাত্ররাজনীতির অবদান সম্পর্কে কিছু ব্যতিক্রমী পাঠ দেব। ছাত্রসমাজের দেশপ্রেমের অতীত ঐতিহ্যের কথা আমি ভুলে যেতে রাজি আছি, যদি আপনারা তাই করতে বলেন। ভাষা, স্বাধীনতা আর গনতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের কথা ভুলে যেতে রাজি আছি, যদি আপনারা তাই করতে বলেন। তবুও আমি ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তার কথাই বলব। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমার দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি যুক্তি আমি এখানে তুলে ধরব। সাম্রাজ্যবাদীদের লীলাক্ষেত্র এই বিশ্বে আমাদের মত দুর্বল শক্তির একটি দেশের নিরাপত্তা কতটুকু সুরক্ষিত? অর্থনৈতিক শোষণের জন্য বিশ্বশক্তিগুলো যে জাল বিছিয়ে রেখেছে এর মধ্যে আপনি কতটুকু নিরাপদ বোধ করেন? তারা জোর করে আমাদের গ্যাস নিয়ে যেতে চায়, আমাদের বন্দর নিয়ে যেতে চায়, আমাদের শিল্প-বানিজ্য বন্ধ করে তাদের পুঁজির পথ প্রশস্ত করতে চায়, যন্ত্রের দাপটে আমাদের শ্রমশক্তিকে বেকার করে দিয়ে আবার তাদেরই পন্য কিনতে বাধ্য করতে চায়, আমাদের ভূখন্ডকে তাদের যূদ্ধ ফ্রন্ট বানাতে চায়। তারা চায় আমরা আমাদের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে তাদের পন্য গিলি আর নিঃস্ব হয়ে তাদের দাসে পরিণত হই। তারা জানে পৃথিবীতে যে সম্পদ আছে তা দিয়ে সবার জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই তারা চায় আমরা ক্রমে আমাদের সম্পদ বিলিয়ে দেই আর নিজেরা টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে পড়ি। তারা প্রায়ই যত সব অন্যায় আবদার উত্থাপন করে। প্রথমে আমরা একটু অসন্তোষ প্রকাশ করি। সময়ের ব্যাবধানে তারা তা ঠিকই আদায় করে নেয়। এমন এক বিশ্বে আমরা যে তবুও আমাদের জাতীয় স্বার্থের পেছনে অবস্থান নেই সেই জোর কোথা থেকে আসে? আমাদের নেতৃত্ব যে মাঝে মাঝে দৃঢ়তা দেখানোর চেষ্টা করে সেই সাহস কোথা থেকে আসে? দু’টাকা আয়ের চিন্তায় ব্যস্ত পেশাজীবি শ্রেনীর কাছ থেকে? আপনারা যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন, কিন্তু রাজনীতি যারা করেন তারা ঠিকই জানেন ছাত্ররাই তাদের শক্তি। রাজপথে নামতে হলে, জীবন দিতে হলে প্রথমে এগিয়ে আসবে ছাত্র, তার পেছনে বাকি সবাই। প্রথম এগিয়ে আসার লোক না থাকলে পেছনের লোক ও থাকবে না। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য দেশের শত্রুরা তা ভালোভাবেই জানে এবং সেই উদ্দেশ্যে ছাত্ররাজনীতির মধ্যে পোকা ঢুকিয়ে তা নষ্ট করায় ব্যস্ত। কিন্তু আমরা এই দেশের জনগনই তা বুঝতে পারি না এবং তা হতে দিয়ে চলেছি।

অতঃপর………

আই হ্যাভ অ্য ড্রীম

অনেক জটিল সমস্যায় আমরা নিমজ্জিত। সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে আমরা দিশেহারা। তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি। রাষ্ট্র আর সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন মার্টিন লুথার কিং, আর পৃথিবী পাল্টে দেয়া অসংখ্য স্বপ্নবাজ মানুষ। আমি স্বপ্ন দেখি আমরা ভালোভাবে পড়াশোনা করব। আমি স্বপ্ন দেখি আমরা একই সাথে দেশপ্রেমের ঝান্ডাকে সর্বদা উড্ডীন রাখব। আমরা সবাই মিলে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ব। আমি স্বপ্ন দেখি সংঘাতমুক্ত, সুশৃঙ্খ্ল, নিয়মানুবর্তী, সৃষ্টিশীল আর মুক্ত চিন্তার আধার একটি ক্যাম্পাস। যেই ক্যাম্পাস গঠনে ছাত্রদের ভূমিকা থাকবে। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় নিজেদের অধিকার নিয়ে রাজনীতি করবে, নেতৃত্বের পাঠ নিবে, আর সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে দলে দলে নেমে আসবে রাজপথে। লেজুড়ে সংগঠন নয়, তারা হবে স্বাধীন, এক একটি একক সত্তা। এই স্বপ্নের পথে আমার যাত্রা শুরু হয়েছে। শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি গড়ে তুলছি এমনই এক স্বাধীন সংগঠন যার নাম

“ভার্সেটাইল স্টুডেন্ট’স পার্টি”।