একে একে ডুবছে হাওড়। পেটবোঝাই পুষ্ট, অপুষ্ট দানা নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ধানের জমিন। এসব ধান জমিনের বয়স বেশ প্রাচীন, বইয়ের ভাষায় বলা চলে প্রত্নতাত্ত্বিক কৃষিজমি। হাওড়াঞ্চল ছাড়া দেশে এমনসব ঐতিহাসিক ধান জমিন খুব একটা নেই। দেখার হাওড়, শনির হাওড়, মাটিয়ান হাওড়, সজনার হাওড়, হাইল হাওড়, হাকালুকি হাওড়, কাউয়াদীঘি হাওড়, ঘুইঙ্গাজুড়ি হাওড়, জালিয়ার হাওড়, বাঁওড়বাগ, খরচার হাওড়, পাথরচাউলি বা চেপটির হাওড়ের মতো দেশের শত শত হাওড়ের আদি বৈশিষ্ট্যের সব জমিন আজ পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে যদি ছয় ভাগ করা হয়, তার এক ভাগই হাওড় জনপদ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া— এ সাতটি প্রশাসনিক জেলায় বিস্তৃত দেশের হাওড় ভূমি এক দুঃসহ মরণ যন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। হাওড়ে ধান মৌসুম একটাই, বোরো মৌসুম। আর এ মৌসুমের ধানকে ঘিরেই হাওড়বাসী পুরো বছরের টিকে থাকার প্রস্তুতি নেয়। এমনিতেই চৈত্র মাসে হাওড়ে চলে চৈত্রের নিদান। শস্যের আকাল।  এর ভেতর একমাত্র ফসল তলিয়ে গেলে সেই নিদানের রূপ কেমন হয়, তা কেবল হাওড়বাসীই দিনের পর দিন টের পায়।


রাষ্ট্র বরাবরই হাওড়কে এড়িয়ে চলে, হাওড়ের যন্ত্রণাকে আড়াল করে চলে।  লাগাতার রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অন্যায় আর অনাচারের ভেতরেই জেগে থাকে হাওড়।  দেশকে জোগায় ধান আর মাছ, দুনিয়াকে উপহার দেয় গান।  চৈত্র-বৈশাখে অবিরত বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওড়ের তলিয়ে যাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়।  হাওড়ের বিশেষ বাস্তুসংস্থানই হাওড়বাসীকে এ অঞ্চলে টিকে থাকার সংগ্রামে প্রতিদিন নতুনভাবে প্রস্তুত করে তুলে।  রাষ্ট্র এ প্রস্তুতির দিকে ফিরেও তাকায় না। সবকিছু ডুবে তলিয়ে গেলে সরকার কিছু উফশী ধানের সিদ্ধ চালের বস্তা নিয়ে আসে।  কখনো ঘর তোলার জন্য দেয় কয়েক বান্ডিল ঢেউটিন।  এর বেশি কিছু না।  হাওড়ের উন্নয়ন বলতে রাষ্ট্র এখনো বুঝে ডুবন্ত রাস্তা, ফসল রক্ষা বাঁধ আর বাণিজ্যিক মাছ চাষের জন্য বিল জলাভূমির ইজারাকে।  আর এ নিয়েই বছরভর লেগে থাকে স্থানীয় থেকে জাতীয় জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের ভেতর ভাগ-বাটোয়ারার দরবার, কোন্দল আর দুর্নীতি।


হাওড়ের উজান-ভাটির শর্তকে কেউই মান্য করে না।  প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখে পাহাড়ি ঢলে ধান জমিন তলিয়ে গেলে এ নিয়ে কিছুদিন কথা হয়। তারপর আবারো সব নিশ্চুপ। আবার পরের বছরের চৈত্র মাসের তলিয়ে যাওয়া দিয়ে শুরু হয়। কেবল তর্ক চলে ফসল রক্ষা বাঁধ বানাতে কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, কে কত ভাগ পেল কী পায়নি, কোন চেয়ারম্যান কত টাকা মেরেছে, কোন ঠিকাদার কাজ না করে চলে গেছে। কেউ কোনো দায়িত্ব নেন না। দায় নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। হাওড়ের সুরক্ষা প্রশ্নটি কোনোভাবেই বাঁধ, ইজারা আর অবকাঠামোর সঙ্গে জড়িত নয়। সমস্যার মূল জায়গাটি এখানেই। হাওড়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন বা হাওড়ের উজান-ভাটির অংক বুঝতে না পারা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের চাপিয়ে দেয়া এমনতর দশাসই সব উন্নয়ন চিন্তাই হাওড়কে প্রতি বছর তলিয়ে দেয়। হাকালুকির উত্তরে বান দিলে দক্ষিণে নিদান শুরু হয়। হাওড়ের সুরক্ষাকে দেখতে হবে হাওড়ের চোখেই। হাওড়বাসীর উজান-ভাটির অংক থেকেই।

২. তো, হাওড়ের এই উজান-ভাটির অংকটি কী? হাওড়াঞ্চলগুলো ভাটিতে অবস্থিত। এ কারণেই হাওড়াঞ্চল হলো দেশের ভাটি-বাংলা। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলগুলো হলো, হাওড়ের সাপেক্ষে উজান অঞ্চল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রায় হাওড়গুলোই উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের কাছাকাছি। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি উজানে জন্ম নিয়েছে শত সহস্র পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়া। এই পাহাড়ি জলধারাই বাংলাদেশের হাওড়াঞ্চলের নদ-নদীগুলোর উত্সস্থল। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি ও বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল দুনিয়ার দুই বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল হাওড়াঞ্চলেই অবস্থিত। চৈত্র-বৈশাখের বর্ষণের ঢল উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় থেকে বাংলাদেশের ভাটির হাওড়ে নেমে আসে বলেই এই ঢল ‘পাহাইড়্যা পানি বা পাহাড়ি ঢল’ নামে পরিচিত। আর পাহাড়ি ঢলেই আজ তলিয়ে যাচ্ছে ভাটির হাওড়। পাহাড়ি ঢলের ফলে তৈরি প্লাবিত এই অসহনীয় অবস্থাকে হাওড়ের অভিধানে বলে ‘আফাল’। কালবৈশাখী ঝড় আর বাতাসের গতি আটকে পড়া পাহাড়ি ঢলের পানিতে ‘আফরমারা’ তীব্র ঢেউ তৈরি করে, যা আফাল অবস্থাকে আরো জটিল ও দুঃসহ করে তুলে। পাহাড়ি ঢল থেকে হাওড়ের সুরক্ষায় অবশ্যই আফাল ও আফরমারাকে বুঝতে হবে। ইট-সিমেন্টের বাঁধ ঘিরে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের হিসাব দিয়ে কোনোভাবেই হাওড়কে বোঝা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় আর ভাটির বাংলাদেশের হাওড়ের এই সম্পর্ক কত দিনের? সম্পর্কটি যদি ঐতিহাসিক হয়, তবে আজ কেন ভাটিতে এই যন্ত্রণা? নাকি এভাবেই হাওড় তলিয়ে যেত? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, না। হাওড়ের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ের সম্পর্কটি ঐতিহাসিক। মৈমনসিংহ গীতিকা ও সিলেটি বারোমাসীর মতো হাওড়ের প্রাচীন দলিলগুলোয় এর সত্যতা মেলে। উজানের পাহাড় থেকে জল গড়িয়ে নামত ভাটির হাওড়ে। এ যেন নাইওরি আসা, জলের নাইওরি। পুরো বর্ষাকাল এই জল নাইওরি কাটিয়ে নানান নদীর প্রবাহে চলে যেত সমুদ্রে। পাহাড় থেকে সমুদ্র, জলপ্রবাহের এই দীর্ঘ পরিভ্রমণে হাওড়াঞ্চল পেত বৈশাখী জলের এক বিশেষ স্পর্শ। এ স্পর্শে কোনো আঘাত, যন্ত্রণা বা তলিয়ে যাওয়ার ছল ছিল না। বরং ওই জলে জীবনের টান ছিল। রাধারমণ থেকে শাহ আবদুল করিম কেউই এই জলের টান অস্বীকার করতে পারেননি।

৩. ইউরোপ থেকে ধনী হয়ে ভাগ্য বদলানোর জন্য রবার্ট লিন্ডসে সিলেটে এসেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশকালে। ব্রিটিশ রানীকে ঘুষ দিয়ে ১২ বছর সিলেট শাসন করেছেন। লিন্ডসে তার লেখায় তখনকার ভাটির সিলেট ও উত্তর-পূর্ব ভারতের যে বিবরণ দিয়েছেন, সেখানেও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়ার কোনো হদিস নেই। বরং পাহাড় ও হাওড়ের পুরো অঞ্চলে গভীর বনভূমির কথা আছে। এমনকি সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের হাওড়ের বৈশিষ্ট্য হলো— ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জলাবন। হাওড় অভিধানে তাই ‘করচের বাগ’, ‘হিজলের বাগ, ‘নল-নটার বন, ‘ইকর-আটিয়ার বন’ এগুলো খুবই প্রচলিত শব্দ। মেঘালয় পাহাড়জুড়ে যেমন মিশ্র বর্ষারণ্য, হাওড়জুড়ে জলাবন। চৈত্র-বৈশাখের কালবৈশাখী থেকে শুরু করে অবিরাম বর্ষণ উজানের বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে ভাটিতে গড়িয়ে পড়ত। এসব পাহাড়ি বনে বুনোলতা, ঘাস, গুল্ম ও বৃক্ষের আচ্ছাদন বৃষ্টির পানির ধারাকে দুম করে গড়িয়ে পড়তে বাধা দিত। পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ‘ছাঁকনি বা চুইয়ে পড়া নীতিতে’ উজান থেকে ভাটির হাওড়ে নামত। ১৯৬০ সালের দিকে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও পাহাড়ি ঢলের এ নামতা হাওড়বাসীর মুখস্থ ছিল। একেকটি হাওড় একেক ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থিত। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ঢল নামলে মাটিয়ান বা খরচার হাওড় পর্যন্ত আসতে কত সময় লাগবে— সে হিসাব মানুষের ছিল। আকাশের নানা কোণে কী রঙের কী ধাঁচের মেঘ জমল, তাই দেখে হাওড়ের বুড়িরা আগে আফালের হিসাব কষতে জানতেন। এখন এসব বুড়িও নেই আর প্রবীণ জঙ্গলগুলোও নেই। পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তের প্রাকৃতিক বনভূমি বিনাশ করে ভারত বহুজাতিক খনি প্রকল্প তৈরি করেছে। মেঘালয় পাহাড় আজ কয়লা আর চুনাপাথর তুলতে তুলতে ফাঁপা হয়ে গেছে। অল্প বিস্তর বৃষ্টিতেই আজ মেঘালয় পাহাড় ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশের হাওড়ে। এখন উজানের পাহাড় থেকে ঢল নয়, নামে পাহাড়ি বালি ও পাথর-কাঁকরের স্তূপ। উজানের পাহাড়ি বালিতে হাওড় ভাটির প্রায় নিম্নভূমি, জলা অঞ্চল, বিল ও নদীগুলো আজ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে যাওয়া হাওড় ভূমিতে এখন বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মতো বৈশিষ্ট্য নেই। তাই অল্প বৃষ্টি, এমনকি চৈত্রের প্রথম বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় হাওড়। মূলত বৃষ্টির জল কোথাও প্রবাহিত হতে না পেরে হাওড় ভূমির কৃষিজমিতেই ছড়িয়ে পড়ে, প্লাবিত হয়। তাই ডুবে যায় হাওড়ের ধান জমিনগুলো। মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়েই দুনিয়ার এক বিশেষ বন অবস্থিত। বালফাকরাম সংরক্ষিত বনভূমি। বালফাকরামের ভাটিতে কিন্তু পাহাড়ি ঢলে এখনো তলিয়ে যায় না সেখানকার নিম্নাঞ্চল। এ তো গেল উজানের কথা, ভাটিতে কি তাহলে জলপ্রবাহের অংক ঠিক আছে? ভাটির বাংলাদেশ সব হাওড় ধনী ও প্রভাবশালীদের ইজারা দিয়ে হাওড়কে বানিয়ে রেখেছে বাণিজ্যিক মত্স্য খামার। যে পাহাড়ি বালি হাওড়ের জন্য আজ অন্যতম প্রধান সমস্যা, সেই পাহাড়ি বালি-পাথর বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে একদল মুনাফাখোর। এই জল ও বালুমহাল ইজারাদার কি দখলদাররাই হাওড়ের অর্থনীতি থেকে আজ রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করছে। এরা মনে-প্রাণে চায় মেঘালয় পাহাড় ভেঙে হাওড় ভরাট হয়ে যাক এবং বছর বছর তলিয়ে যাক। উজানের খনি ব্যবসায়ী ও ভাটির ইজারাদাররা মূলত একই নয়া উদারবাদী করপোরেট মনস্তত্ত্ব ধারণ করে। ভাটির বাংলাদেশে হাওড় ইজারা নিয়ে প্রাকৃতিক জলাভূমিতে আগ্রাসী হাইব্রিড বিপজ্জনক মাছ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হাওড়ের নানা জায়গায় বান দিয়ে জলতরঙ্গ আটকে দেয়া হয়েছে। হাওড়ের নদী ও প্রবাহগুলোকে আটকে দেয়া হয়েছে। মানে হাওড়ের উজান ও ভাটি আজ সবখানেই সবদিক থেকে বন্ধ, শৃঙ্খলিত ও আবদ্ধ। তাহলে কি বৃষ্টি হবে না? পানির ধর্ম বদলে যাবে? পানি তো উজান থকে ভাটিতে গড়াবেই। তাহলে উজান থেকে ভাটিতে বৃষ্টির ঢল গড়িয়ে যাওয়ার পথগুলো বারবার বন্ধ করে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই হাওড়ের সুরক্ষা দিতে পারেনি। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। হাওড়ের এই উজান-ভাটির অংকটি সচল রাখার দাবি কোনোভাবেই আজকের নতুন নয়, ভাসান পানির আন্দোলনেরও আগ থেকে হাওড়বাসী এ দাবি করে আসছে। কিন্তু রাষ্ট্র এটি কোনোভাবেই কানে তুলছে না। রাষ্ট্র হাওড়কে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিয়েছে। নয়া উদারবাদী মুনাফার ময়দানে জিম্মি হয়ে আছে হাওড়। পাহাড়ি ঢলে হাওড়ের এই তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি একটি আন্তঃরাষ্ট্রিক সংকট। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই, এক বহুপক্ষীয় জলাভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণের ভেতর দিয়েই কেবল এর সুরাহা সম্ভব। কারণ এখানে উজান ও ভাটির প্রশ্নটি পরস্পর নির্ভরশীল। কিন্তু এসব আমরা কখনো বিচার করছি না। হাওড়ের অভিন্ন নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন কখনই ন্যায়বিচার করেনি। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্র যে উন্নয়ন বাণিজ্য চালু রেখেছে, তাতে হাওড় বছর বছর ডুববে। আর হাওড়বাসী দিন দিন হাওড় ছেড়ে নিরুদ্দেশ হবে। হাওড়ে জনমিতির এক ভয়াবহ ধস নামবে।

৪. ‘হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে।  কিন্তু বছর বছর পানিতে হাওড় তলিয়ে গেলেও এ প্রতিষ্ঠানটির কোনো চেহারা কোথাও দেখা যায় না। ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ গঠিত হয় এবং ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০০০ সালে এক রেজলিউশনের মাধ্যমে দেশের সব হাওড় ও জলাভূমি সমন্বিতভাবে উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পুনরায় ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’-কে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত অফিস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ যদিও হাওড় উন্নয়নে হাওড়-সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়গুলোকে সমন্বিত করে কাজ করার কথা বলেছে কিন্তু হাওড় এলাকার কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে তার ছাপ হাওড়বাসীরা দেখতে পায় না। ‘হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’কে এখন পর্যন্ত বাস্তবিকভাবে কার্যকর করে না তোলা হলেও বোর্ড গঠনকালে বলা হয়েছিল— ‘এ বোর্ড হাওর ও জলাভূমির সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়ন সাধনকল্পে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বয় ও সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করিবে। এ লক্ষ্যে বোর্ড হাওর ও জলাভূমির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে (সূত্র: নং পাসম-উঃ৫/বিবিধ-১৯/২০০০/৩৮৩, সূত্র: বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, ২৬/৯/২০০০)।’ সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের জন্য সেই আকাঙ্ক্ষিত ‘মাস্টারপ্ল্যানটি’ তৈরি করেছে। ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত তিন খণ্ডের এ হাওড় উন্নয়ন মহাপরিকল্পনাটি ছয়টি ধাপে প্রস্তুত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১০টি হাওড় উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ৩০টি দলগত আলোচনার ভিত্তিতে এটি করা হয়েছে। আসলে চরম মিথ্যাচার হয়েছে। কারণ হাওড় মহাপরিকল্পনায় হাওড়ের এই পাহাড়ি ঢলের মতো অন্যতম প্রধান সমস্যাটিকে হাওড়বাসীর চোখে দেখা হয়নি। হাওড় ও জলাভূমি বোর্ডকে মূলত পাহাড়ি ঢলে হাওড় তলিয়ে যাওয়ার যাবতীয় দায় ও দায়িত্ব নিতে হবে। তাদেরকে হাওড়বাসীর সামনে আসতে হবে, সবকিছুর কারণ ব্যাখ্যা করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বছর বছর পাহাড়ি ঢলে জমিন ও জনপদ তলিয়ে যাওয়ার যাবতীয় ক্ষতিপূরণ, শস্য বীমা, বীজ বীমা, শিক্ষা বীমা ও স্বাস্থ্যবীমার প্রচলন ঘটাতে হবে হাওড়াঞ্চলে। হাওড়ের অবকাঠামো ও ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে চলমান সস্তা ‘ভিলেজ পলিটিকস মার্কা’ দরবারকে রাজনৈতিক কায়দায় ফয়সালা করে পাহাড়ি ঢলে হাওড়ের তলিয়ে যাওয়াকে একটি আন্তরাষ্ট্রিক সংকট হিসেবেই বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

৫. চৈত্র-বৈশাখে পাহাড়ি ঢল নামে হাওড়ে। এ কারণেই হাওড় জন্ম দিয়েছে অবিস্মরণীয় সব গভীর পানির ধান জাত। গচি, রাতা, টেপী, বোরো, দীঘা, লাখাই থেকে শুরু করে চুরাক ধান। এসব ধান পাহাড়ি ঢলের পানিতেও তলিয়ে যায় না। প্লাবিত জলেও টানা বাঁচতে পারে। এসব জাত আগাম বলে পাহাড়ি ঢলের আগেই তা ঘরে তুলতে পারত হাওড়বাসী। কিন্তু তথাকথিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাষ্ট্র হাওড়বাসীর কাছ থেকে এসব ধান জাত কেড়ে নিয়েছে, চাপিয়ে দিয়েছে খর্বাকৃতির উফশী ধানের জাত। মূলত চালু হয়েছে সিনজেনটা, মনসান্টো কোম্পানির বিষ ব্যবসা। প্রতিটি সরকারই এসব কোম্পানিকে তোয়াজ করে চলে। তাই এসব কোম্পানির বিষের ব্যবসা চাঙ্গা হয়। কিন্তু মরেন কৃষক, মরে মাটি আর মরছি আমরা। পৃথিবীর প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিও তৈরি হয়েছিল হবিগঞ্জের নাগুড়ার হাওড়াঞ্চলে। এখন এটি তো মৌলিক প্রশ্ন, রাষ্ট্র কেন সেটি ধরে রাখতে পারল না? হাওড়ের গভীর পানির ডুবো জাতের ধানগুলো কেন সুরক্ষা করল না? তাহলে কীভাবে ধান রক্ষা পাবে? ফসল রক্ষা বাঁধ দিয়ে? যাতে কিছু ঠিকাদারের দালান বাড়ি তৈরি হয়।

৬. হাওড়ের সংকটকে হাওড়ের চোখেই দেখতে হবে। না জেনে না বোঝে হাওড়ের চলমান সংকটকে কোনোভাবেই ‘জলবায়ু পরিবর্তনের’ ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে না। যারা এভাবে জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাইছে, এতে প্রমাণিত হয় কেবল হাওড় নয়, জলবায়ু বিষয়টিও তাদের কাছে বিমূর্ত ও অস্পষ্ট। আর কয়েক দিন পরই হাওড়ে ছিল বৈশাখী। বিষুসংক্রান্তি। বেগুনপাতার বর্ত আর চড়কের আয়োজন এ বছর হয়তো বিষাদগ্রস্ত হয়েই রইবে। এক মুঠ ধানও ঘরে তোলা যায়নি। ধান তো কেবল খাদ্যদানা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো বছরের জটিল বিশ্বাস ও সম্পর্ক। যখন পাহাড়ি ঢল এগিয়ে আসছে এ বছর, হাওড়বাসীরা প্রকৃতির কাছে কত মিনতি করেছে, শেষমেশ ধানের জমিনের কাছে ক্ষমা চেয়ে রক্ষা করতে না পেরে চলে এসেছে। একজন কৃষক, তার নানা পরিচয়; একই সঙ্গে উত্পাদক ও সুরক্ষাকারী। যে কৃষক বালামুসবিত থেকে তার উত্পাদনের সুরক্ষা দিতে পারেন না, শুধু তিনিই জানেন বুকের ভেতর তার কেমন ছাড়খার হয়ে যায়। পাহাড়ি ঢলে হাওড়ের তলিয়ে যাওয়া কৃষকের কাছে এক প্রশ্নহীন পরাজয়। কৃষক কখনই এমন পরাজয় মেনে নিতে পারেন না বলেই বছর বছর সংগ্রামী জমিন সাজান। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কি এমন পরাজয় মেনে নিয়েই আগামীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চায়?

লেখক: গবেষক
সুত্রঃ  বনিক বার্তা