প্রখ্যাত সাহিত্যিক ডঃ নিরোধ চন্দ্র চৌধুরী ১৮৯৭ সালে নভেম্বরের ২৩ তারিখ বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন । পৈত্রিক নিবাস, কটিয়াদী উপজেলার বনগ্রামে। কিশোরগঞ্জের জ্যোতিষ্ক এই বঙ্গ সন্তান, উদার মনোভাবা সম্পন্ন শিক্ষিত পারিবারিক আবেষ্টনীতে তিনি বড় হয়ে উঠেন। বাংলায় প্রবন্ধ সাহিত্যের পথিকৃত অসামান্য ছিলেন মননশীলতায় ঋজু, যুক্তিবাদী, প্রখর গদ্যশৈলী তৈরী করার চেষ্টায় তাঁর কাজ তুলনাহীন।

পারিবারিক পরিবেশ তাঁর মুক্ত স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী এবং অকপট সত্যভাষণের সকল শক্তির উৎস। ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, সমরনীতি, ভূগোল, সঙ্গীত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লেখনীর অনায়াস বিচরনশীলতা এবং সেই সঙ্গে তাঁর মতো অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বর্তমানকালের তাঁর মতো সমাজবিদ ও চিন্তানায়কদের মধ্যে দূর্লভ। ইংরেজি ভাষায় তার রচনা আর বাংলায় তাঁর শৈলীর মধ্যে ছিল আকাশ পাতাল, দুই পৃথক মনন বিশ্বের অত্যাশ্চর্য লিখন শক্তি।সম্ভবত তিনিই ছিলেন একমাত্র লেখক যার জন্মের শত বছর পরে সর্বশেষ বইটি ( Three Horsemen of the New Apocalypse ) অক্সফোর্ড ইউনিভার্সেটি হতে প্রকাশ হয় ১৯৯৭ সালে । মজার ব্যাপার হলো ভারত বর্ষকে নিয়ে ইংরেজী সাহিত্যে লেখা সর্বপ্রথম রচনা নিরোধ চন্দ্র চৌধুরীই করেন এবং তখন তাঁর বয়স ৫৩ বছর যার নাম “The Autobiography of an unknown Indian” ( published by McMillan, London 1951)  যা তৎকালীন সময়ে সারাবিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়  । সমকালীন সময়ের A Passage to England , Clive of India,  and “Scholar Extraordinary: The Life of Max Muller মত সারা জাগানো বইয়ের মধ্যে তাঁর লিখা বইটিই ছিল সরচেয়ে বেশি পঠিত । তখন তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ভাষ্য লিখক হিসাবে কাজ করতেন । তিনি জ্ঞানের স্পৃহায় মগ্ন হয়ে ১৯৭০ সালে ৫৭ বছর বয়সে তিনি অক্সফোর্ড যান এবং সেখানে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে তিনি ইংলেন্ডের সাথে ইন্ডিয়ার সম্পর্ক ঊন্নয়নে কাজ করেন ।  তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সেটি ও স্টারলিং ইউনিভার্সেটি থেকে সম্মান লাভ করেন এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সেটি হতে Doctor of Letters  উপাধীতে ভুষিত হন ।

তিনি ইংরেজি ভাষা নিয়ে তাঁর অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেনঃ “I did not learn English from Englishmen, nor hear it as spoken by native speakers till late in life. Till 1910 I learned it from Bengali teachers at my birthplace, Kishorgonj, a small town in East Bengal. From 1910 to 1914, I learned it in Calcutta, also from Bengali teachers” ।  ডঃ নিরোধ চন্দ্র চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য বাংলা উপন্যাস “বাংগালী জীবনে রমণী”, তিনি ৯০ বছর বয়সে তার জীবনী “Thy Hand, Great Anarch”  শেষ করেন । ১০১ বছর বয়সে তিনি ইংলেন্ডে মৃত্যু বরণ করেন ।

 

নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর ‘কিশোরগঞ্জ’ লেখাটি শত বার্ষিকী সংকলন, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ থেকে সংগৃহীত নিচের এই লেখাটিতে তাঁর দেখা কিশোরগঞ্জ কে সুন্দর করে উপস্থাপন করেছিলেনঃ

আমার বয়স সম্প্রতি একশত বৎসর পূর্ণ হইয়াছে। বাংলা ১৩০৪ সনের ৯ই অগ্রহায়ণ, ইংরাজি ১৮৯৭-এর ২৩শে নভেম্বর আমার জন্ম হয়, তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জে।

কিশোরগঞ্জ সেই সময়ে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা শহর ছিল। শুনিয়াছি এখন এটি জেলা হইয়াছে। তখন কতকগুলি মহকুমা লইয়া একটি জেলা হইত। সেই সময়ের মহকুমার সরকারী অধিকর্তা হইতেনএকজন সাব ডিভিসনাল অফিসার, সংক্ষেপে এস.ডি.ও। তিনি পদাধিকারে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারিতেন, আমার আই.সি.এস-এর লোক হইতেও বাধা ছিল না। এই কিশোরগঞ্জেই আমি জন্মকাল হইতে আমার বারো বছর বয়স পর্যন্ত, শৈশব ও বাল্যজীবন কাটাই।

পূর্ববঙ্গের মফঃস্বল শহর যেমন হইত, কিশোরগঞ্জ শহরটিও সেইরূপ ছিল। পাকাবাড়ি ছিল খুবই কম। ভদ্রলোকের পাকাবাড়ি বোধ হয় ছয়-সাতটার বেশি ছিল না। আর বাদবাকী বাড়ি ছিল টিনের। টিনের চাল। সাধারণত মেঝে মাটির হইত। দেওয়াল দরমার। দরমা মোটা নয়, পাতলা ও সূক্ষ্ম কাজের হইত, কাঠের ফ্রেমে আটকাইয়া দেওয়াল তৈরী হইত। ঘরগুলি দেখিতে খারাপ হইত না। তাছাড়া ঘরের ভিতরে চালের নিচে সিলিং থাকিত, কখনও দরমার, কোন সময়ে কাপড়ের। সেজন্য ঘরগুলি গরমেও কষ্টকর হইত না।

সকল বাড়িতেই বাইরের মহল এবং অন্দরমহল সম্পূর্ণ পৃথক হইত। অন্দরমহলের চারিদিক বেড়া দিয়া বন্ধ থাকিত। বেড়াও দরমার হইত। সুতরাং বাইরের মহল হইতে ভিতর মহলে আসিতে হইলে মাঝখানে একটি দরজার ভিতর দিয়া আসিতে হইত। দরজার সামনে একটি নিচু বেড়া থাকিত। তাহা টপকাইয়া আসিতে হইত। অমনি সোজা চলিয়া আসার উপায় ছিল না। আর বাহির হইতে ভিতরের কিছু বিশেষ দেখাও যাইত না।

আমাদের বাড়ির বাহিরের মহলের সামনে একটি উঠান ছিল, ভেতরেও আর একটি উঠান ছিল। বাড়ির পেছনে অনেকখানি খোলা জায়গা ছিল। তাহার খানিকটা ছিল জঙ্গল। বাকীটা ছিল খালি জমি। পূর্বদিকে আমাদের অন্য বাড়ি,কিন্তু পশ্চিম দিকে সম্পূর্ণ এক সারি কলাগাছ। আর আরও কাছে পঁাচটা তালগাছ বাড়ির কাছে ভিতরের দিকে ছিল। ইহাতে বুঝিতে পারা যাইবে আমাদের বাড়িটা জমি সহ কতটা বড় ছিল। আমাদের বাড়ির সমস্ত জমির পরিমাণ ছিল প্রায় একশত বিঘার মত।

আমারা বাড়ির সামনের দিকে বাস করিতাম। পিছনের দিকে নয়। বহির্মহলে একটা বাড়ি ঘর ছিল। উহাকে আমরা কাছারিঘর বলিতাম। আর ভিতর-মহলে উঠানের চারিদিকে চারটি ঘর। এই চারটি ঘরের মধ্যে একটিকে আমরা ‘নিরামিষ ঘর’ বলিতাম। কারণ আমার পিসিমা বা অন্যান্য বিধবাদের কেউ আসিলে ঐ ঘরে রান্নাবান্না করিতেন। আর উত্তরদিকে ছিল আমাদের রান্নাঘরটি। আর দুটি ঘর ছিল শোবার ও বসিবার। প্রথমে রান্না হইত কাঠের উনানে। তাহার পর কয়লা আসিল, কয়লার উনান চালু হইল।

এই হইল আমাদের দেশের বাড়ি।

এখন কিশোরগঞ্জ শহরটি সেই সময়ে কিরকম ছিল বলা যাক। শহরটি একটি নদীর দুধারে। নদীটাই যেন শহরটির মেরুদন্ডের মত। এক সময় এই নদীটি খুব বড় ছিল। ব্রহ্মপুত্র হইতে ধেনু নামে আর একটি নদী সেখানে আসিয়া পড়িত, কিন্তু আমাদের সময়ে সেটা শুকাইয়া গিয়াছিল। কারণ যে স্থান হইতে ধেনু নদীটি বাহির হইয়াছিল নেই জায়গাটা বুজিয়া গিয়াছিল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমাদের নদীটির গ্রীষ্মকালেও বোঝা যাইত, প্রায় সিকি মাইল চওড়া ছিল। আমরা দেখিয়াছি নদীর উত্তরদিকে একটা রাস্তা গিয়াছে, আবার অপর পারেও এই রকম একটা বড় রাস্তা। দুটি রাস্তার ব্যবধান প্রায় সিকি মাইলের মতো ছিল।

গ্রীষ্মকালে নদীটি একটি ছোট নালার মতো হইয়া যাইত। এমন কি আমাদের এদিকের রাস্তাতেও এক ফুট দুই ফুট পর্যন্ত জল আসিত। মাঝে মাঝে একটু গভীর। কিন্তু বর্ষাকালে একেবারে এক ধার হইতে আর এক ধার পর্যন্ত জলে ভরিয়া যাইত। এমনকি আমাদের এদিকের রাস্তাতেও এক ফুট দুই ফুট পর্যন্ত জল আসিত। আমি সেখান হইতে অনেকদিন কপ্ কপ্ করিয়া মাছও ধরিয়া ফেলিয়াছি।

বষাকালে নদীর দৃশ্যটি খুব সুন্দর হইত। নদীল অপর পারের রাস্তা হইতে আমাদের এপারের রাস্তা পর্যন্ত জলে টল্টল্ করিতে থাকত। আর নানারকম নৌকায় এই জলপথ ভরিয়া যাইত। আমরা তিনরকমের নৌকা দেখিতেপাইতাম। বড়টাকে বলিতাম তিন মাল্লা বা তিন মাঝির নৌকা। মাঝারিটা দুই মাঝির বা সবচেয়ে ছোটটি এক মাঝির। প্রত্যেকটি নৌকাতেই দরমার ছই থাকিত। নৌকার পিছন দিকে বসিত এক মাঝি, যে হাল ধরিয়া থাকিত। সামনে আর একজন থাকিত যে দঁাড়ও বাইতে পারিত, আবার দরকার পড়িলে লগি দিয়াও চালাইত। কোন কোন সময়ে নৌকাগুলি পাল তুলিয়াও চলিত, বিশেষ করিয়া খোলা নদী পাইলে পাল তুলিত। কিন্তু দৃশ্যটা আসলে সুন্দর দেখিতে হইত সন্ধ্যার পর রাত্রে। নৌকাগুলি সব এক জায়গায় বঁাধা থাকিত। আর লগিগুলোও একসঙ্গে দড়ি দিয়া বঁাধা হইত। এসসঙ্গে বঁাধা লগিগুলি দূর হইতে দেখাইত বঁাশবনের মত। নৌকাগুলিতে লণ্ঠন জ্বালিলেই আলো যেন ছড়াইয়া পড়িতেছে মনে হইত। লণ্ঠনের আলো জলে পড়িত, আর মনে হইত জলের নিচে যেন দেওয়ালি শুরু হইয়াছে। জল যেমন নড়িতেছে, আলোও তেমনি নড়িতেছে। এই সুন্দর দৃশ্যটি দেখিতে আমাদের বড় ভারি ভাল লাগিত।

জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ হইতে জল বাড়িতে আরম্ভ হইত। সঙ্গে সঙ্গে সব চাষী মানুষরা ঝঁাপি বা পোলো লইয়া মাছ ধরিতে আসিত। তারপর আশ্বিন কার্তিক সাম নাগাদ জল নামিয়া যাইত। তখন আবার সমন্ত জায়গাটি কাদা-বালিতে ভরিয়া যাইত।

আমাদের বাড়ির সামনেতেই খানিকটা জায়গায় একটু বেশি জল জমিত। সেখানে আমরা স্নান করিতাম। কিন্তু শুধু আমরা নয়, আমরা স্নান করিতে করিতে দেখিতাম, ঐ জলে গরুকেও স্নান করানো হইতেছে। এমন কি দুটি হাতিকেও স্নান করানো হইত। একটা বড়, আর একটা বাচ্চা হাতি। বাচ্চা মানে ছোট হাতি, বড়টির বাচ্চা নয়। বাড়ির সামনের ঐ জলে মানুষ, গরু ও হাতির একসঙ্গে স্নান হইত। জল হইতে উঠিয়া আসিবার পর গায়ে বালি থাকিত, গায়ে গন্ধ হইত যেন গরুর বা হাতির।

বর্ষাকালে বাড়ির ভিতরে উঠানে বসিয়া আমরা একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখিতাম। আমাদের দেশে বর্ষায় বৃষ্টি একেবারে বড় বড় ফেঁাটায় পড়ে। দেখিতে দেখিতে ভিতর উঠানে প্রায় আধহাত মত জল জমিয়া যাইত। তাহার উপর বৃষ্টির বড় বড় ফেঁাটাগুলি পড়িয়া ভাসিত, মনে হইত যেন খেলার পুতুল। টপ্ টপ্ টপ্ টপ্ করিয়া যেন চারিদদিকে অসংখ্য পুতুল নাচিতেছে। এত সুন্দর দেখাইত, জলের পুতুল নাচিতেছে, ডুবিতেছে, আবার মাথা তুলিয়া আবার ডুব দিতেছে। হঠাৎ বৃষ্টিটা যা-ই থামিয়া গেল, এক সেকেন্ডের মধ্যে সব পুতুল কোথায় চলিয়া গেল। এই একটি অদ্ভুত দৃশ্য আমি শোবার ঘরের বারান্দায় বসিয়া দেখিতাম।

উত্তরের ঘরটিতে আমাদের খাওয়া-দাওয়া হইত। রান্নাঘরটির কথা তো আগেই বলিয়াছি। আমার মা কোনদিন রান্না করিতেন না। ঠাকুর-লোকজনই রান্না করিত। এইরূপ ছিল আমাদের বাড়ির পরিবেশ।

এখন শহরটি কিরূপ ছিল বলা যাক। শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দা, বিশেষ করিয়া যঁাহাদের আমরা সমকক্ষ বলিয়া মানিতাম, তঁাহারা সকলেই ছিলেন হয় উকিল নয় মোক্তার, অর্থাৎ আইন-ব্যবসায়ী। শহরটি মহকুমা শহর বলিয়াই এইরূপ বিভিন্ন পাড়া গড়িয়া উঠিয়াছিল। আমাদের পাড়া উকিলপাড়া। সেইরূপ সরকারী চাকুরিয়ারা যে পাড়ায় থাকিতেন, সে পাড়াটিকে আমরা আমলাপাড়া বলিতাম। শহরের সত্যকার বাসিন্দা বলিয়া গণ্য করা হইত যঁাহারা গণ্যমান্য তঁাহাদেরই। ইঁহারা সবাই রাস্তার দুই ধারে নিজস্ব বাড়িতে থাকিতেন। বাড়িগুলি বেশ বড় হইত। অনেকগুলি বাড়ি ছিল, একেবারে কাছারি হইতে পূর্বদিকে নদী পর্যন্ত, আর পশ্চিম দিকেও ঐভাবে বেশ কিছু বাড়ি ছিল।

কিশোরগঞ্জে আমাদের বাজারটি ছিল নদীর ওপারে পূর্ব দক্ষিণ কোণে। সেখানে দুই দিন হাট বসিত, বৃহস্পতিবার আর রবিবার। রোজকার বাজার অবশ্য নানা জায়গায় হইত। পশ্চিম দিকে যে বাজার বসিত, তাহাকে আমরা আটচালার বাজার বলিতাম। এইরূপ কোনটিকে পুরানো থানার বাজার, কোনটিকে বিক্রমপুরের বাজার, আবার কোনটিকে ইট-থান বাজার—এই রূপ বলিতাম।

হাটবারগুলিতে, বৃহস্পতিবার ও রবিবার,চারদিক হইতে চাল, ডাল, জিনিসপত্র সবই আসিত। তাহা ছাড়া স্থায়ী দোকানও অনেক ছিল। স্থায়ী দোকান কিন্তু এইসব জিনিসের নয়, স্থায়ী দোকান ছিল মনিহারী জিনিস ও বিশেষ করিয়া কাপড়-চোপড়ের। এক কোণে একটি মদের দোকানও ছিল। যঁাহারা মদ খাইতেন তঁাহারা মদের দোকানের এক কোণে বসিয়া মদ্যপান করিতেন।

হাটের মধ্যে মাছের জন্য একটি দিক নির্দিষ্ট ছিল। সুতরাং কি কি কিনিতে হইবে সেই বুঝিয়া আমরা সেই সব জায়গায় চলিয়া যাইতাম। কোন দোকান খঁুজিয়া বাহির করিতে হইত না। এখনও মনে পড়ে, যেখানে চাল বিক্রয় হইত, সেখানে গিয়া নানা রকম চাল হইতে তুলিয়া তুলিয়া কোন্টি ভাল চাল দেখিয়া সেই চাল কেনা হইত। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার বা রবিবার মা আগে হইতে ফর্দ করিয়া দিতেন কি কি জিনিস হাট হইতে আনা হইবে। লোকজন সেই মত জিসিনপত্র হাট হইতে কিনিয়া সন্ধ্যার পর ফিরিয়া আসিত।

উকিল-মোক্তার কর্তারা দশটা নাগাদ কোর্টে যাইতেন। আর পঁাচটা নাগাদ ফিরিয়া আসিতেন। মক্কেলদেরও সকালবেলা ঐ রাস্তা দিয়া কোর্টে যাইতে দেখিতাম। আমাদের দিকের রাস্তা পাকা ছিল না। ফলে গোটা রাস্তাই ধূলাকীর্ণ থাকিত। সকালবেলা দেখিতাম সব পায়ের দাগ পশ্চিম-মুখো। আর বিকালবেলা দেখা যাইত সব পায়ের দাগ পূব-মুখো। বর্ষাকালে এই রাস্তাতেই আবার এক হঁাটু পঁাক থাকিত। বর্ষাকালে আমরা বিশেষ কারণ ছাড়া বাড়ির বাহির হইতাম না।

কিশোরগঞ্জে থাকাকালীন আমি কখনও জুতা পরি নাই। সব সময়ে খালি পায়ে থাকিতাম। আর স্কুলে যাওয়ার সময় ছাড়া গায়েও জামা থাকিত না। খালি পা, খালি গা, কোন সময় ধুতিটি কোমরে বঁাধা অথবা সামনে কেঁাচা—এই ছিল বাড়ির নিত্যকার পোষাক।

১৯০৭ কিংবা ১৯০৮ সালে কিশোরগঞ্জ পরিদর্শনের জন্য ডিভিসনাল কমিশনার বা রিজিওনাল ম্যাজিস্ট্রেট আসেন। ইনি ইংরাজ ছিলেন। আমাদের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটও ইংরাজ ছিলেন। মনে পড়ে, কমিশনারের মেমসাহেব স্ত্রী ঘুরিয়া ঘুরিয়া সব দেখিতেছেন আর আমরা পিছনে পিছনে প্রায় জনাবিশেক কিশোর বালক নিজের ধুতির খেঁাট তুলিয়া চিবাইতে চিবাইতে যাইতেছি। আমাদের কিন্তু তাড়াইয়া দেওয়া হয় নাই। এই প্রথম আমি সামনে হইতে মেমসাহেব দেখিতে পাইলাম। পোষাক অবশ্য এখনকার মতো নয়। ১৯০০ সনের ইংরাজ মেয়েদের পোশাক। একেবারে পায়ের নিচ পর্যন্ত ঢাকা। পা দেখা যায় না। আমরা তখন একটা কথা শুনিতাম। হিন্দু মেয়েদের মুখ দেখানো যেমন অশোভন, মেমসাহেবদের পা দেখিতে পাওয়া অশোভন ছিল। তাই আমরা সেকালে মেমসাহেবদের গোড়ালি পর্যন্ত দেখিতে পাইতাম না, হঁাটু বা পায়ের গোছ দেখিতে পাওয়া তো দূরের কথা। ১৯০০ সনের কাছাকাছি ইংল্যান্ডের মেমসাহেবদের যেমন পোশাক দেখা যায়, সেই পোশাক।

বাবা প্রতিদিন অফিসে বাহির হইলে পর, মা বেশির ভাগ সময়েই শোবার ঘরে থাকিতেন। কোন কোন সময়ে রান্নাবান্না দেখিবার জন্য রান্নাঘরে উপস্থিত হইতেন। খাইবার সময়ে সর্বদাই উপস্থিত থাকিতেন। পরিবেশন করা ঠিকমত হইতেছে কিনা দেখিতেন। আমরা বাঙালীরা নিরামিষাশী নই, মাংসাশী। মাংস খুব কম হইত। মাসের চারবার হইলে যথেষ্ট। সাধারণত মাছ, তরকারি, ডাল ইহাই নিয়মিত পদ ছিল। দুধ থাকিত। কিন্তু পায়েস বা দই কম হইত। আমরা প্রায়ই দুধ-ভাত খাইতাম।

রাত্রে শুইবার পর আমার একটা ভয়ের কারণ উপস্থিত হইত। সিলিংয়ের চাল-এর উপরে ভাম আসিত ইঁদুর মারিবার জন্য। সারারাত ধরিয়া ভাম-এর দৌড়াদৌড়ি উপরে শুনিতে পাইতাম আর ভয়ে কঁাপিতে থাকিতাম। একদিন আমি ভাম দেখিয়াছিলাম, সিলিংয়ের ফঁাক দিয়া উঁকি মারিতেছে। চাহিয়া দেখি, চোখ দুইটা জ্বল্জ্বল্ করিতেছে। আমাদের দেখিয়াই হুড়ুৎ করিয়া বাহির হইয়া বাহিরের একটি নারিকেল গাছে উঠিল। সেটায় চড়িয়া সেখান হইতে এক লাফে আগের চালে গেল। তারপর সেখান হইতে এক লাফ দিয়া একটা তালগাছে উঠিয়া পড়িল। এইরূপে রাত্রে ভামের ইঁদুর-তাড়া আমার কাছে এক ভয়াবহ ব্যাপার ছিল। এ ছাড়া, আমি ভয় পাইতাম চামচিকা দেখিলে। রাত্রে চামচিকা যেই মশারির কাছে বসিল, আমি অমনি চেঁচাইতে শুরু করিতাম।

আমি ছয় বৎসর বয়সে স্কুলে ভর্তি হই। প্রথম দুই বৎসর বাংলা স্কুলে পড়ি। আমাদের ওখানে দুই রকম স্কুল ছিল। একটা মিড্ল্ স্কুল আর একটা হাই স্কুল। প্রথম দুই বৎসর আমি মিড্ল্ স্কুলে পড়ি। তাহার পর হাই স্কুলে। ক্লাস বা শ্রেণীর নাম আজকালকার মত ছিল না। সব চাইতে উপরের ক্লাসকে ফার্স্ট ক্লাস বলা হইত। তারপর হইত এন্ট্রান্স পরীক্ষা। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সময় হইতে ফার্স্ট ক্লাসকে টেন্থ ক্লাস বা দশম শ্রেণী বলা হইত। আমার সময়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা আরম্ভ হয় নাই। এন্ট্রান্স পরীক্ষা ছিল। ফার্স্ট ক্লাসকে এন্ট্রান্স ক্লাসও বলা হইত। নিচের দিকে ক্লাসের নামকরণ সেকেন্ড ক্লাস হইতে শুরু করিয়া সেভেন্থ্ ক্লাস এইট্থ ক্লাস এই রূপ ছিল। আমি বাংলা স্কুল হইতে আসিয়া সেভেন্থ্ ক্লাসে ভর্তি হইলাম।

কিশোরগঞ্জের জীবনে আর একটা জিনিস ছিল। সেটা হইল প্রত্যেক ঋতুতে একটা করিয়া উৎসব। আমরা দেখিতাম প্রত্যেক ভাদ্র মাসে ঝুলন মেলা হইত। কিশোরগঞ্জ শহর হইতে এক মাইল দূরে একটা মস্ত বড় টিলা ছিল। সেখানে এই মেলা হইত। কিশোরগঞ্জে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটা পাটের আড়ত ছিল। সেটিকে কুঠি বলা হইত। আমাদের সময়ে সে পাটের আড়ত চালাইতেন একটি তঁাতী পরিবার। উপাধি ছিল পরামাণিক। কিশোরগঞ্জে মেলার মাঠের পাশে ছিল তঁাহাদের আদি বাড়ি।

ঝুলনমেলা হইত এক মাস ধরিয়া। তখন প্রধানত ঢাকা হইতে, কখনও বা কলিকাতা হইতেও নানা জিনিসপত্রের দোকান আসিত এই ঝুলন মেলাতে। এক-একটা জিনিসের জন্য এক-একটি পট্টি ছিল। মনে আছে, একটি দোকানে একটি মুসলমানলোক খালি বই বঁাধাইত। তখন মুসলমানরা প্রধানত কোরান ও ফার্সি বই লইয়া আসিত। বই বঁাধাইয়া লইয়া তাহার উপর সোনার জলে কাজ করিয়া লইয়া যাইত। একটি পট্টিতে কঁাচের জিনিসপত্র বিক্রি হইত। যে জায়গাটি আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাল লাগিত এবং যেখানে আমরা সুযোগ পাওয়া মাত্র আগে যাইতাম, সেটি হইল বাজনা তৈরীর জায়গা। একটি জায়গায় মৃদঙ্গ তৈরী হইত। মৃদঙ্গ তো ঢোল বা ঢাকের মত নয়, মাটির। দেখিতাম, মাটি দিয়া মৃদঙ্গ তৈরী করিয়া চামড়া-টামড়া লাগাইয়া ঠিক করা হইতেছে। আর একটি জায়গায় তৈরী অদ্ভুত একটা যন্ত্র, আমাদের কাছে মনে হইত অদ্ভুত। কিশোরগঞ্জের মত অজ জায়গায় এরকম একটি যন্ত্র তৈরী সম্ভব তাহা ভাবিতে পারিতাম না। সেই যন্ত্রটা হইল বেহালা। আমরা দেখিতাম কি করিয়া বেহালা তৈয়ারী হয়। অসংখ্য বেহালা তৈরী করিয়া ঝুলাইয়া রাখা হইত। সে সময়ের বাংলায় যাহা কিছু তৈরী হইত,বলিতে গেলে তাহার প্রত্যেকটি জিনিস মেলায় পাওয়া যাইত।

অন্যদিকে বিলাত হইতে আমদানি করা ট্রাঙ্কের একটি পট্টি ছিল। ট্রাঙ্ক কেনা ছিল গিন্নীদের একটি বড় বাতিক। যতই বাড়িতে ট্রাঙ্ক থাকুক কেন, প্রত্যেকবার একটি বা দুইটি করিয়া ট্রাঙ্ক কেনা হইত। বড় ট্রাঙ্ক, চ্যাপ্টা ট্রাঙ্ক, এরকম করিয়া ঘরে শেষকালটা বারো-তেরটা ট্রাঙ্ক হইয়া যাইত। ট্রাঙ্কগুলিকে একসঙ্গে শিকল দিয়া বঁাধিয়া রাখা হইত, যাহাতে মাটির মেঝেতে সিঁদ কাটিয়া চোর না লইয়া যায়। ইহা ছাড়া প্রত্যেক বাড়িতেই একটা লোহার সিন্দুক থাকিত; টাকাপয়সা গয়নাপত্র রাখিবার জন্য। আর সে সিন্দুক অবশ্য খুব ভারী হইত। ট্রাঙ্কগুলির শিকল ঐ ভারী লোহার সিন্দুকের সহিতও আটকানো হইত।

আমাদের ঘরে আলমারি ছিল, বইয়ের শেল্ফ্ ছিল। আবার অন্য জিনিসের জন্য নানারকম শেল্ফ্ ছিল। এদিকে ঘর মাটির হইলে কি হইবে, ঘরের ভিতর আলো জ্বালিবার বন্দোবস্ত ছিল সব বিলাতী বা বিদেশী। বোহিমিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়ারপ্রকান্ড বড় ঝুলানো ল্যাম্প। তাহার উপরে রিফ্লেকটরের ঢাকনা দিয়া নিচে আলো পড়িত। ফটকের উপরে প্রায়ই হরিণের শিং বঁাধানো থাকিত। আমাদেরও দরজার উপরে হরিণের শিং ছিল। আর ছিল অনেকগুলি বঁাধানো ছবি। মনে আছে তাহার মধ্যে একটি ছবি ছিল র‌্যাফায়েলের। মা দেখাইয়া বলিতেন, এটা হল র‌্যাফেলের ম্যাডোনা ডেলা সেডিয়ার ছবি। ম্যাডোনা যীশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। অন্য দিকে ছিল দুটি অন্য রকমের ছবি, একটি মেয়ে একটি ঘুঘু বুকে লইয়া বসিয়া আছে। আর একদিকে ছিল বোয়ার যুদ্ধের দুটো বড় ছবি।

আবার মেলার কথায় ফিরিয়া আসি। কিশোরগঞ্জে রথের মেলা হইত আষাঢ় মাসে। যে পরামাণিক পরিবারের কথা বলিয়াছি, কেন জানি না তঁাহাদের বাড়িকে পৌনে চার আনার বাড়ি বলা হইত। তঁাহাদের পুকুরকে পৌনে চার আনার পুকুর বলা হইত। রথের মেলা হইত এই পৌনে চার আনার বাড়িতে,তঁাহাদের জমিতে। মা সব সময়েই আমাদের নিষেধ করিতেন, আমরা যেন রথের কাছ দিয়া না যাই। লোকে রথ টানিয়া লইয়া যাইত। চারদিকের জমিতে নানা জিনিসের দোকান বসিত। আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল নানারকম মাটির খেলনা পুতুল। বিলাতী পোর্সিলেনের গ্রে হাউন্ড হইত একেবারে মাটির। সেইরূপ মাটির বেড়াল। কিন্তু আমরা সব চাইতে ভালবাসিতাম আহ্লাদী পুতুল। প্রকান্ড ভঁুড়িওলা একটি পুতুল কিন্তু ছোট্ট শিশুর চেহারা। আমরা আহ্লাদী পুতুল দাও বলিলেই কুমোর একট আহ্লাদী পুতুল লইয়া তাহার টক্টকে লাল রঙের উপর গর্জন অর্থাৎ বার্নিশ মাখাইয়া আমাদের হাতে দিত। আমারা বার্নিশের গন্ধ শুকিতে শুঁকিতে বাড়ি ফিরিতাম মেলা হইতে তাল-পাতা বা নারেকেল-পাতা কিনিয়া আমরা ভেপু বঁাশি বানাইতাম। যতদিন রথের মেলা থাকিত, ঐ ভেপু বাঁশির আওয়াজে বাড়ির সকলের কান ঝালাপালা হইত।

বর্ষার পরে,কোথা হইতে জানি না ডোম বা চামার শ্রেণীর লোকেরা শূকর লইয়া আসিত। আমারা বলিতাম,তোমরা ভেতরের জমিতে এসে আমাদের কচুটচু সব পরিস্কার করিয়া দাও। ওরা শূকরদের দিয়া সব জমি পরিষ্কার করিয়া দিত। গ্রীষ্মকালে নদীর ওপার যখন মাঠ হইয়া যাইত, তখন কোথা হইতে বেদেরা আসিয়া তাবু ফেলিয়া বসিত। আমরা কিশোরগঞ্জে কখনও গাধা দেখিতে পাই নাই। বেদেরা আসিলে প্রথম গাধা দেখিলাম। গাধা দেখিয়া, গাধার ডাক শুনিয়া আমাদের কি আনন্দ।

বর্ষার সময়ে কিশোরগঞ্জের ভাটি মুলুক জলে ভাসিয়া যাইত। ভাটি মুলুকে যাহারা থাকিত তাহারা বর্ষার আগে গরু-মোষ লইয়া আমাদের বাড়ির সামনের দিকে শুকনো জায়গায় বাথান করিত। একবার একটি মোষ একজন লোককে শিং দিয়া গুতাইয়া জলে ফেলিয়া দিল। আমার বাবা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি নিয়ম করিয়া দিলেন, মোষ গরুদের লইয়া রাস্তা দিয়া যাইতে কেহ পারিবে না। রাস্তার নিচ দিয়া যাইতে হইবে।আমরা দেখিতাম, রাস্তার নিচ দিয়া গরু ও মোষের পাল পশ্চিমদিকে চলিয়াছে। উপরে আসিবার তাহাদের উপায় নাই। আমাদের শিখানো হইল মোষকে ভয় করিতে হয়। আর বলা হইল মোষ দুই রকমের হয়, খাচর ও ভাঙড়।খাচরগুলি গুতা মারে,ভাঙরগুলি পোষা গোছের। দুই রকমের মোষই আমি দেখিয়াছি। আমাদের ওখানে সব মোষই ছিল কালো রঙের। লাল রঙের মোষ কিশোরগঞ্জে দেখি নাই।

আমি কিশোরগঞ্জে থাকাকালীন কখনও দুর্গাপূজা দেখি নাই। তাহার প্রধান কারণ হইল বারোয়ারী চঁাদা লইয়া দুর্গাপূজা কোন ভদ্রলোকের বাড়িতে হইত না। ভদ্রলোকদের প্রত্যেকের পৈতৃক বাড়িতে গ্রামে দুর্গাপূজা হইত। তাহারা সকলেই পূজার ছুটির সময়ে সেখানে চলিয়া যাইতেন। আর শহরে যে বারোয়ারী পূজা হইত, সেখানে লোকজন মুহুরী আমলারাই প্রধানত যাইতেন। আমরা কখনো বারোয়ারী পূজাতে যাইব, একথা ভাবিতেই পারিতাম না। আমি দুর্গাপূজা একমাত্র আমাদের পৈতৃক বাড়িতে দেখিয়াছি। এমন কি কোন জ্ঞাতির বাড়িতেও পূজা দেখিতে যাই নাই। আমাদের প্রত্যেকের উপর নিষেধ ছিল।

দুর্গাপূজার পর কালীপূজায় আতসবাজি, তুবড়ি, পটকা ফাটানো হইত। পটকা অপেক্ষা আতসবাজির চল বেশি ছিল। অনেকেই ভাল আতসবাজি ঢাকা বা কলিকাতা হইতে আগে আগে আনাইতেন। তবে কালীপূজা আমরা বড় একটা দেখি নাই।

সরস্বতী পূজা প্রায় সব বাড়িতেই হইত। সরস্বতী পূজার উৎসব আমরা ভাল করিয়াই উপভোগ করিতাম। এখন আমরা যাহাকে হোলি বা রঙখেলা বলি, আমাদের সময়ে এই উৎসবকে দোলযাত্রা বলিতাম। বাড়িতে বাড়িতে বড় টব বানাইয়া রঙ গোলা হইত। সেই রঙ লইয়া দোলখেলা হইত।

এই হইল কিশোরগঞ্জের জীবনযাত্রা- বৈশাখ হইতে চৈত্র পর্যন্ত।

কিশোরগঞ্জে উকিলরা দেওয়ানী মামলা করিতেন যাহাকে সিভিল স্যুট বলে। আর মোক্তাররা করিতেন সব ক্রিমিনাল কেস, ফৌজদারি মামলা। আমার বাবার প্র্যাকটিস ছিল সবই ক্রিমিন্যাল কেসে। তঁাহাকে দেওয়ানী আদালতে বিশেষ আমি দেখি নাই। বাবা ক্রস-এগ্জামিন খুব ভাল করিতে পারিতেন, পরিচয়-খ্যাতিও যথেষ্ট ছিল।

সে সময় ইংরাজরা বাঙালী বা ভারতীয়দেরবেশি মাহিনার চাকুরি দিত না ইহা সত্য। বাঙালী বা ভারতীয় চাকুরের খুব বেশি বেতন হইলে পঁাচ-ছয়ন শ টাকা। তার বেশি মাহিনার চাকুরি কখনই হইত না। কিন্তু ওকালতি বা মোক্তারিতে সকল রকম সরকারী চাকরি অপেক্ষা উপার্জন অনেক বেশি ছিল। একটি উদাহরণ দিলে বুঝিতে পারা যাইবে। সে সময়ে কিশোরগঞ্জের সাব জুডিসিয়াল অফিসার খুব বেশি হইলে চারশত টাকা মাহিনা পাইতেন। আমি ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর অক্টোবর নাগাদ কিশোরগঞ্জে ছিলাম। বাবা যাহা কিছু উপার্জন করিতেন, দিয়া বলিতেন, ‘নীরদ, তুমি সংসার চালিয়ে বাকিটা সিন্দুকে রেখে দিও।’ মনে আছে, আমি একমাসে সব খরচা চালাইয়া ছয়শত (৬০০) টাকা সিন্দুকে তুলিয়াছিলাম। সুতরাং বাঙালী বা ভারতীয়র পক্ষে বেশী টাকা উপার্জন করা অসম্ভব ছিল না। আর একটা দৃষ্টান্ত দেখাই। স্যার সত্যেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ যিনি পরে লর্ড সিন্হা নামে পরিচিত হন তিনি কলিকাতা শহরের বড় ব্যারিস্টার ছিলেন। তিনি ১৯০৯ সনে ভাইসরয়ের সিকিউরিটি কাউন্সিলের ল-মেম্বার হন। সেই প্রথম কোন ভারতীয়কে ভাইসরয়ের কাউন্সিলের মেম্বার করা হইল। কিন্তু তখন তঁাহার কলকাতার উপার্জন ছিল ভাইসরয়ের মাহিনার সমান। পরে তিনি জজ হইয়াছিলেন। কিন্তু জজের মাহিনা তঁাহার আয় অপেক্ষা কম বলিয়া ছাড়িয়া দিয়া অ্যাডভোকেট জেনারেল হন। ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়াররাও নিজ নিজ পেশায় ভাল আয় করিতেন। তবে উকিল-ব্যারিস্টারদের আয় নিঃসন্দেহে বেশী ছিল। হাইকোর্টের ব্যারিস্টার একদিনে পঁাচশত টাকা উপায় করিতে পারিতেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় ডাক্তার, স্যার নীলরতন সরকারের ভিজিট ছিল চৌষট্টি টাকা।

কিশোরগঞ্জ শহরে চুরি ডাকাতি বিশেষ হইত না। অন্তত আমি সেরূপ শুনি নাই। একটি মাত্র খুনের কথা শুনিয়াছিলাম। একদিন সকালে ঘুম ভাঙিয়া শুনিলাম গৌরীপাদ্য রায়ের গলা কে বা কাহারা কাটিয়া দিয়াছে। আর একবার আমাদের পাশের বাড়ির চাকরকে পুড়াইয়া মারা হইয়াছিল।

কাছারী ঘরে বাবার কাছে ফৌজদারী মামলার লোকজন আসিত। দাঙ্গাহাঙ্গামায় ক্ষয়ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন রক্তমাখা কাপড়-চোপড়ে গ্রাম-গঞ্জ হইতে আসিত। এমন সব মানুষ আমরা প্রায়ই দেখিতাম। একদিন বাবা মাকে বলিতেছেন শুনিলাম, ছেলেরা এসব মোকদ্দমার কথা শুনছে, মামলা-মোকদ্দমার লোকজনেদের দেখছে, এটা আমার ভালো লাগে না। ওদের জন্য একটা আলাদা ঘর করা হোক।

তাহার পর আলাদা একটি ঘর হইল। আমরা কাছারি ঘর হইতে সরিয়া আসিয়া ঐ ঘরে পড়াশুনা করিতাম। একটি মোকদ্দমার কথা আব্ছা আব্ছা মনে আছে। কাছারি ঘরের পিছন দিকে একটি মেয়ে কাচুমাচু হইয়া দঁাড়াইয়া আছে। সম্ভবত মেয়েটি মুসলমান। মুহুরী বলিতেছেন, তোমার মোকদ্দমাতে দেন-মোহরের কথাটা বলা দরকার। এই শব্দটি মানে তখন বুঝিতে পারে নাই। শব্দটি হিন্দু সমাজের মধ্যে শুনি নাই।

এই ছিল আমাদের কিশোরগঞ্জের সাধারণ জীবন।