নবজাতকসময়টা ২০১৪ সালের মে মাসের ১৪। অন্য দশটা নারীর মতো শিউলীর জীবনেও আকাঙ্খিত একটি দিন। সে দ্বিতীয় বারের মতো মা হতে চলেছে। মনে উঁকি দিচ্ছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কখন ভূমিষ্ট সন্তানের মুখ দেখবে! অবশেষে নোয়াখালি জেলার চাটখিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ায় সে দ্বিতীয় বারের মতো কন্যা সন্তানের জননী হন। প্রসবের পর হঠাৎ শিউলী আক্তারের বুকের কাছে থাকা নবজাতকের পায়ের দিকে নজর গেল স্বজনের, দেখলো সন্তানের একটি পা কেমন যেন একটু বাঁকা মনে হচ্ছে। তখন তারা ভাবছিলেন, হয়তো মাত্র ডেলিভারী হয়েছে, এজন্য এই অবস্থা, পরে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন দেখলো পায়ের অবস্থানটার পরিবর্তন হচ্ছে না, তখনই মা শিউলী ও খালাদের মনে আধাঁর নেমে এলো। এমনিতেই আগে কন্যা সন্তান, তার উপর এবারও কন্যা সন্তান, তাও পায়ের পাতা বাঁকা।

বুঝতেই পারছিলেন না সমস্যাটা কি? অবশেষে কর্তব্যরত ডাক্তার নিশ্চিত করলেন শিশুটি ক্লাবফুট আক্রান্ত। যেখানে জীবন যাপনের ব্যয়ভার সামলাতে বোন, মামা-খালাদের সহযোগীতাই সম্বল! সেখানে এই ধরণের রোগের চিকিৎসা কোথায় হয় বা চিকিৎসার জন্য কত টাকা লাগতে পারে কিছুই জানা নেই তার। কে তাকে টাকা জোগাড় করে দিবে? সবকিছু ভেবে শিউলীর সুখগুলো যেন কোথা একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিল। হাসপাতালে তার বেদনার বহিঃপ্রকাশে চোখের জলে ভাসাই তার একমাত্র সংঙ্গী হলো। বোনদের শান্তনাও যেন তাকে শান্ত করতে পারছিল না। তার মনে বার বার মনে হচ্ছিল, কেন এমন হলো? এই মেয়েকে নিয়ে সে কোথায় গিয়ে দাড়াবে? কিভাবে এর চিকিৎসা করাবে? সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার সংবাদটুকু ঢাকায় থাকা রিক্সাচালক স্বামীকে জানায় সে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, বাচ্চা হবার পর একবারের জন্য হলেও দেখে যায়নি স্বামী হান্নান। তার এই দুঃসময়েও সে স্বামীকে আসার জন্য কোন চাপও দিতে পারে না। অবশেষে স্বামীর এই অবহেলার হাত থেকে বাঁচতে ঠাঁই হয়েছে বাবার বাড়ীতে।

স্বামীকে এ ত্রুটির কথা জানানোর পর তিনি জানান, ‘কি আর করবা, আল্লায় যহন দিছে এইভাবেই থাকুক’। একদিকে স্বামীর অবজ্ঞা অন্যদিকে সন্তানের জন্মগত ত্রুটি যেন শিউলী আক্তারকে দুশ্চিন্তার আর এক নতুন জগতে প্রবেশ করে দিয়েছে। ভাবনার যেন কুল কিনারা করতে পারে না, একদিকে আর্থিক অনটন, অন্যদিকে সন্তানের এ ত্রুটি তাকে কিছুটা ভারসাম্যহীন করে তুলেছিল। তবে শিউলীর বোন, মামা, খালা’র সাহস ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা করলেও, অন্তঃপুরের শান্তি যেন তার কপালে কোন ভাবেই জুটছে না। তবুও শিউলি আশা ছাড়েনি, তার স্বপ্ন তার সন্তানও একদিন সুস্থ্য হয়ে উঠবে, অন্যান্য সবার মতো সেও হয়তো হেসে খেলে বেড়াবে। কিন্তু হতাশার বেড়াজালে সে আশাও যেন তাঁর কাছে কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল। কারণ বাবার সংসারে ঠাঁই নেয়া শিউলির কাছে তো আর এতো টাকা নেই যে, চিকিৎসা করাবে।

হঠাৎ কুমিল্লার এক নিকটাত্মীয় মামা তাকে আশ্বস্ত করে বললেন,‘যে, চিন্তা করো না, আমার সন্তানেরও এই রকম হয়েছিল, আমি তাকে লায়ন মোখলেছুর রহমান ফাউন্ডেশনের জিরো ক্লাবফুট ক্লিনিকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করিয়েছি। সে এখন মোটামুটি সুস্থ্য। অবশেষে শিউলি তার সন্তান ও বোনকে নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেলের জিরো ক্লাবফুট ক্লিনিকে আসলেন। এসে দেখলেন, এ সমস্যায় শুধু তার সন্তান হালিমা একা আক্রান্ত নয়। আরো অনেকেই আছেন যাদের সন্তানকে এখান থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন বা নিতে এসেছেন। শিউলি যেন খুঁজে পেলেন সন্তানের সুচিকিৎসার এক নিরাপদ ঠিকানা। সবার মতো সে ভাবছে, তার সন্তানও স্বাভাবিকভাবে হাঁটবে-দৌঁড়াবে। সকল দুর্ভাবনার ভিড়ে শিউলি আবারও স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে।

লিখেছেনঃ সুমিত বণিক
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, লায়ন মোখলেছুর রহমান ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা।