মাঝ রাতে হঠাৎ করে মিতার ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট বোধ করতে লাগল। বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাল। গলা শুকিয়ে কাঠ! অন্যদিনের মত আজও দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ঘড়িতে দেখল ৩:১০মি:। আর ঘুমুতে যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার যদি দুঃস্বপ্ন সামনে এসে দাড়ায়। ঐদিনের পর থেকে সে স্বপ্নটা প্রায়ই দেখে, কি ভয়ঙ্কর সেই দুঃস্বপ্ন। অবশ্য ঘুমের ঘোর খেটে গেলে জীবনটাই তার কাছে ভয়াভহ দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এইতো সেই দিন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, সিলিং ফ্যানে শাড়ি জড়িয়ে। এমন ভাবে সবকিছু তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দাড়িয়েছে যে আত্মহত্যা করার রাস্তাও নেই। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নই শুধু তাকে আপন করে টানে, তার একমাত্র সঙ্গী।

গলায় শাড়ি জড়ানোর আগেই ৭মাসের শিশু মায়া ক্ষুদায় চিৎকার করে উঠে এযেন প্রচন্ড এক বাধা, এ বাধা সে কিছুতেই অতিক্রম করতে পারেনি। কোন মা তা উপেক্ষা করতে পারেনি কোন দিন, মিতাও পারেনি।মাঝে মাঝে প্রচন্ড ভাবে বাঁচতে ইচ্ছা করে কিন্তু দুঃস্বপ্নটা দেখলেই সবকিছু উল্টা পাল্টা হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় মিতা।হঠাৎ আলো ঝলকানী দিয়ে উঠে, আজ ভরা পুর্নিমা।

আকাশ থেকে স্নিগ্ধ আলো যেন সাড়া পৃথিবীতে কোমল পরশ বুলাচ্ছে। কি অপুর্ব জোছনা !!! প্রকৃতি যেন জোছনা জলে স্নানে মগ্ন। কতদিন মিতা জোছনা দেখেনা !শেষ জোছনা দেখেছিল ভার্সিটির নৌবিহারের সময়। সেদিন আকাশের দিকে সবাই এক সাথে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অনেক ক্ষন। সবার চোখ যেন এক সাথে আকাশের শূন্যতায় আটকে যায়। হঠাৎ সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল । কেউ কোন দিন যেন জোছনার সৌন্দর্য্যর মুখোমুখি হয়নি ।
এর পর মাঝখানে কতগুলো বছর…।

আজ তিন বছর পর মিতা আবার জোছনা দেখছে কিন্তু এখন সবকিছুই বদলে গেছে।মিতার কাছে বদলে গেছে অপূর্ব সুন্দর জোছনার ভাষা। অস্ফুট স্বর বেরুল মিতার গলা থেকে শুনলে যে কারো মনে হবে যেন কোন বোবা মেয়ে মনের ভাব প্রকাশের ব্যর্থ চেষ্টা করছে। অবশ্য অনেকটা তাই, অপূর্ব জোছনা দেখে সে ঠিক থাকতে পারছেনা।আজ প্রায় ৮টি মাস মিতা কথা বলে না। এমন কি তার একমাত্র মেয়ে মায়ার সাথেও না, কোন দিন আপন মনে ভুল করেও না কিন্তু আজ তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ক’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল হাতের উপর অনেকটা যেন তার অজান্তেই। তার চোখের পানি এখন সবচেয়ে সুলভ। অবশ্য ৮মাসে এটিই সবচেয়ে দুসপ্রাপ্য হবার কথা কিন্তু তার ক্ষেত্রে আলদা, সে কোন দিন কাঁদতে শেখেনি। কেন জানি দুঃস্বপ্নের কথা বার বার মনে পড়ছে। এ দুঃস্বপ্নকে যেকোন কিছুর বিনিময়ে মিতা ভুলে থাকতে চায় কিন্তু চাইলেই তো আর সব পারা যায়না কারন ঘটনার চিহ্ন সে বয়ে বেড়াচ্ছে আপন চোখে মুখে।

ভালই কাটছিল ভার্সিটির দিনগুলো। হই চই, আড্ডা, বন্ধু বান্ধব সব মিলিয়ে জীবন মানেই যেন এমন মিতার ভার্সিটি জীবনের অবসান ঘটাতে এল এক নতুন আগন্তুক।ছেলেটি ভালই, নিজ গুণে ও তার বাবার গুণে, বাবার ভাল ব্যবসা। প্রস্তাব এনেছিল মিতার বড় মামা। খবর নিয়ে দেখা গেল মিতার জন্য সবকিছুই লোভনীয়। তাই অল্প সময়ের মধ্যে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। মিতার পড়াশুনা আর হল না। কথা ছিল বিয়ের পর ছেলে বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা যাবে। মিতার কাছে তা অর্থহীন মনে হল কারন পড়াশুনা শেষ করে সে বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করবে এ ব্যপারে মিতা ১০০% নিশ্চিত। যথা সময়ে বিয়ে হল এক মাস সবকিছু ভালই চলছিল। মিতার স্বামী রাসেল তখন চলে গেল আমেরিকা। মিতা সংসার ধর্ম খুব ভাল ভাবেই আয়েত্ত্বে নিয়ে গিয়েছিল। সবার হৃদয় ছিল মিতার দখলে। শশুর শাশুড়ি মিতা বলতে অজ্ঞান। মিতার শশুর হঠাৎ স্ট্রোক করলেন। তার হাতে গুনা ২০দিন পর শাশুড়িও মারা গেলেন। সব কিছু উল্টে পাল্টে গেল, বদলে গেল মিতার জীবনের গতি পথ । যে রাসেল মা-বাবার মৃত্যু খবর শুনে দেশে ফিরলনা সেই রাসেল কোর্স কমপ্লিট না করেই এক বছরের মাথায় দেশে ফিরে এল। সে ব্যবসার দায়িত্ব বুঝে নিল। এ সব কাউকে বলে দিতে হয় না, রাসেলকেও বলে দিতে হল না।

মিতা অন্তঃসত্ত্বা হল। কিছু দিনের মধ্যে মিতা বুঝতে পারল রাসেল নিজের মধ্যে নেই। ইতিমধ্যে ব্যবসার অবস্থা শোচনীয় সেই সাথে রাসেলের নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। মিতার সাথে প্রায়ই ছোট খাট বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতে শুরু করল। মাঝে মাঝে এ ঝগড়া চরম আকার ধারন করত তখন রাসেল মিতাকে মারধর করত। মিতা সব নিরবে সহ্য করত। অবশেষে ব্যবসারও লাল বাত্তি জ্বলে উঠল ধীরে ধীরে রাসেলের আচরন দুঃসহ্য হয়ে উঠল। সে মিতাকে বাবা-মার কাছ থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিতে শুরু করে কিন্তু মিতা তার বাবা-মাকে এই ব্যপারে কিছুই জানাতে পারেনি । মিতা তার সমস্ত অলংকার বিক্রি করে রাসেলের হাতে সব টাকা তুলে দিল কিন্তু দু’দিনেই এই টাকা ফুরিয়ে গেল। রাসেল আবার টাকা পাগল হয়ে গেল আবার মিতাকে টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। চাপের সাথে সাথে মারধরের ধরনও পাল্টাতে লাগল মাঝে মাঝে খুন্তি গরম করে ছেঁকা দিত। অন্য এক মানসিক বীকারগ্রস্থ রাসেলকে মিতা উপলব্ধি করতে লাগল।

একদিন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে এক কথা দু’কথা থেকে রাসেল প্রচন্ড রেগে গেল। মিতা চায়ের জন্য পানি গরম করছিল হঠাৎ রাসেল কিল ঘুসি লাতি মারতে শুরু করল, এক পর্যায়ে সে মরিয়া হয়ে উঠল। চুলের মুঠি ধরে সে মিতার মুখ ডুবিয়ে দিল গরম পানিতে।এর পর…
কে মিতাকে হাসপাতালে আনে, কি ঘটে এর কিছুই মিতা জানেনা, জানতে চায়ও নি। শুনেছে রাসেল পালিয়েছে। মিতা ৩দিন জ্ঞানহীন ছিল। প্রায় দুই মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে আর এখানেই মায়ার জন্ম হয়।

হাসপাতলে থাকতেই মামাকে দিয়ে বাসা ভাড়ূা নিয়েছে। বাবা-মার সামনে মিতা আর বোঝা হয়ে দাড়াতে চায় না । সে বেছে নিয়েছে নিঃসঙ্গ জীবন এই জীবনে তার মেয়ে মায়াই সব। তার খরচটা অবশ্য বাবাই দেয়, মামা অন্যান্ন প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে দিয়ে যান। মাঝে মাঝে মা এসে মায়াকে দেখে যান। মিতা একবারও তার সামনে দাড়ায়নি।কি অপরাধ তার ? কেন আজ নিজেকে নিজেই কারাগারে বন্দী করে দুঃসহ্য স্বপ্নের শাস্তি পেতে হয় ? মিতার আফসোস রাসেলের এরুপ আচরনের রহস্য আজও অজানা থেকে গেল।

সবকিছুই ঠিকঠাক আছে আগের মত কিন্তু ঠিক নেই মিতার সুন্দর মুখ…. যা এখন বিভৎস।মৃদু বাতাসে এসে দোলা দিয়ে মিতার সমস্ত চিন্তাও তন্দ্রাকে গুলিয়ে দিল। রাতের নিস্তব্ধতা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। এটি দুটি করে ভোরের পাখি ডেকে উঠছে। একটু পর পুবের আকাশে দেখা দিবে উজ্জ্বল আভা। হাতে পড়া অশ্রু শুকিয়ে গেছে সেই কখন।

জানালার পাশ থেকে সরে দাড়াতে হবে। আলোকিত এই পৃথিবী ও কুৎসিত চিন্তার কতক মানুষের সামনে হাসির পাত্র হতে চায় না ।
থাক না, সে একা অন্ধকারে….

তলিয়ে যেতে থাক অন্ধকারের গভীর থেকে আরো গভীরে।