কক্সবাজার থেকে পার্বত্যাঞ্চল, ময়মনসিংহ থেকে হাওরাঞ্চল বা চায়ের দেশ সিলেট। ওই সব অঞ্চলের দেয়াললিখন ও রিকশার পেছনে একটি বিশেষ স্লোগান নজরে আসে অনেকের। কৌতূহলী অনেকে চোখ বুলান সেসব স্লোগানে—

‘যৌতুক চাওয়া মানে ভিক্ষা করা’, ‘যৌতুক চাওয়া মানে নিজের মনুষ্যত্বকে বিকিয়ে দেওয়া’, ‘যৌতুককে না’।

প্রথম লাইন থেকে দ্বিতীয় লাইন, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়—এভাবে একে একে নিচের দিকে গেলে ছোট্ট অক্ষরে লেখা নামটি ভেসে ওঠে, ‘নিয়াজী’। পুরো নাম জুম্মা খান নিয়াজী। বয়স ৪০। বাড়ি তাঁর কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। সামান্য আয়ের একজন চিত্রকর তিনি। প্রায় দেড় যুগ ধরে তিনি যৌতুক নামের সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন। এই কাজে তিনি একাই যোদ্ধা। হাতিয়ার বলতে রং, তুলি আর ব্যানার লেখা থেকে উপার্জিত আয়ের একটি অংশ।
সম্প্রতি কথা হয় সংগ্রামী এই মানুষটির সঙ্গে। ভৈরব পৌর শহরের ভৈরবপুর উত্তরপাড়ার সরু গলি পেরিয়ে তাঁর ঘরে গিয়ে দেখা যায়, জুম্মা খান বিছানায় শুয়ে আছেন; জ্বরে কাতর। স্মিত হেসে বললেন, ‘প্রথম আলো আমার সর্বনাশ করেছে।’ এমন কথায় খানিকটা নড়েচড়ে বসতে হলো। পরে জানা গেল সর্বনাশের কারণ।

কোনো প্রচার পাবেন—এমন চিন্তা থেকে যৌতুকবিরোধী দেয়াললিখন শুরু করেননি তিনি। যৌতুকের অভিশাপ বাঙালি নারীদের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে চলেছে—পত্রিকার পাতায় এমন খবর কিশোর জুম্মা খানকে ভাবিয়ে তোলে। সেই ভাবনা থেকেই এই কর্মযজ্ঞে নামা। ২০০৪ সালের ৩ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘যৌতুকের বিরুদ্ধে নিয়াজীর লড়াই’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে অভিনন্দনপত্র পান। তাঁর কথা প্রচারিত হয় জনপ্রিয় টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তেও। ‘এসব প্রচারের ফলে নিজের কাছে নিজের দায়বদ্ধতা আরও বেড়ে যায়’, বললেন জুম্মা খান।

জুম্মা খান আরও বলেন, ‘এক যুগ আমার এই কাজ শুধু নিজের ছোট্ট শহর ভৈরবে সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম। ওই সময়ের মধ্যে দেয়াললিখনের পাশাপাশি প্রায় পাঁচ হাজার রিকশার পেছনে যৌতুকবিরোধী স্লোগান লিখেছি। ২০০৪ সালের ৩ এপ্রিলের পর সাত বছর গত হলো। এই সময়ের মধ্যে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহে যৌতুকবিরোধী স্লোগান ছড়িয়ে দিই।’ তবে এবার হাতিয়ার বলতে শুধু রং-তুলি নয়, সঙ্গে যোগ হয়েছে যৌতুকবিরোধী পথনাটক ও শিক্ষার্থীদের শপথ পাঠ।

জুম্মা খান জানান, কিছুদিন আগে হবিগঞ্জ থেকে এক নারী এসে আমাকে কিছু গেঞ্জি দিয়ে গেছেন। ময়মনসিংহ থেকে এসে রঙের কৌটা দিয়ে গেছেন আরেক ভদ্রলোক।’  নারায়ণগঞ্জের সাবেক প্যানেল মেয়র খোরশেদ আলম পোস্টার ছাপিয়ে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। একজন এসে কিছু টাকাও দিয়ে গেছেন। বাইরে গেলে কেউ কেউ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করেন। অনেক অনুষ্ঠানে অতিথি হতে হয় জুম্মা খানকে। স্কুল-কলেজে ডাক পড়ে যৌতুক নিয়ে কথা বলার জন্য। এসবই অনেক আনন্দের, তাঁর কাজের স্বীকৃতি।

নতুন পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে জুম্মা খান জানান, ঈদের পর রং-তুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন তিনি। এবার যাবেন গাজীপুর ও ঢাকায়। এ জন্য টাকাকড়ির প্রাথমিক জোগান হয়ে গেছে। প্রতি ব্যানার থেকে ৩০ টাকা করে জমিয়ে রেখে খরচের টাকা হয়ে যাবে। তাঁর এই পথচলায় স্ত্রী লতিফা খানম বরাবরই উৎসাহ জুগিয়েছেন। স্ত্রী তাঁর দুই সন্তান তানজিনা ও দীপুর কথা ভাবেননি। প্রচারের খরচ মেটাতে নিজের স্বর্ণালংকার তুলে দিয়েছিলেন স্বামীর হাতে। আর এখন জমাচ্ছেন মুষ্টির চাল।

লিখেছেনঃ  সুমন মোল্লা, ভৈরব, 
লেখাটি  প্রথমআলো প্রকাশিত