নরসিংদীর গৌরীপুর গ্রামের নদীর পাড়। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল সাড়ে ৫টা। এক লাখ ৪০ হাজার সিসি ব্লক থরে থরে সাজানো। সেগুলো ব্যবহার করা হবে ভৈরব শহর রক্ষা বাঁধের কাজে। নৌকা থেকে ওইখানে নেমেই ভৈরবের ইউএনও একটি সিসি ব্লক হাত দিয়ে চাপ দিলেন। ভেঙে গেল ব্লকটি। তারপর আরো একটি সিসি ব্লকে হাত রাখলেন তিনি। ফল একই হলো। এভাবে একের পর এক সিসি ব্লক হাতের স্পর্শে ভাঙতে লাগল। এ ঘটনা দেখে হতবাক সবাই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপস্থিত প্রকৌশলীরাও।

পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহাবুর রহমানের নির্দেশে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কমকর্তা (ইউএনও) মো. খোরশেদ আলম ভৈরব শহর রক্ষা বাঁধের কাজ পরিদর্শনে সেখানে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী খুশি মোহন সরকার, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আনোয়ার কাদির, উপজেলা প্রকৌশলী মামুন খানসহ স্থানীয় কয়েক জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকর্মীরা।

শুধু নিম্নমানের সিসি ব্লক তৈরিই নয়, পুরো ভৈরব শহর রক্ষা বাঁধের কাজে উঠেছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। গত শনিবার পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহাবুর রহমান ওই প্রকল্প পরিদর্শন করতে গেলে স্থানীয় এলাকাবাসী তাঁর কাছে ওই কাজের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরেন। মন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর সফরসঙ্গী পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী সুনীল বরণ দেব রায়কে অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে তিনি স্থানীয় ইউএনওকেও বাঁধের কাজ পরিদর্শন করে লিখিত প্রতিবেদন তাঁকে জানাতে বলেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কিশোরগঞ্জ জেলা অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য ভৈরব শহর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। পাঁচটি প্যাকেজে বিভক্ত ৪ ও ৫ নম্বর প্যাকেজের কাজ পায় পারিশা ট্রেড সিস্টেম নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে ওই প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মো. সারোয়ার হোসেনকে কাজগুলো হস্তান্তর করে।

প্রতিমন্ত্রীর কাছে অভিযোগকারীদের মতে, মো. সারোয়ার হোসেন কাজ শুরু করার আগ মুহূর্তে ভৈরব বাজারের কাঠবাজারের ঋষিপট্টির নদীর পাড়ে আগে থেকে বিছানো প্রায় সোয়া লাখ ঘনফুট পাথর (বোল্ডার, যার বাজার মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা) সরিয়ে ফেলেন। ওই পাথরের বিশাল একটি অংশ পানি উন্নয়ন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তিনি বাজারে বিক্রি করে দেন। বাকি অংশ নিয়মবহির্ভূতভাবে ভেঙে বাঁধের প্রতিরক্ষা দেয়াল ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহার করেন। সেই সঙ্গে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণে ৬০ গ্রেডের রড দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি সেখানে গ্রেডবিহীন রড ব্যবহার করেন। তা ছাড়া ১ নম্বর প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্যারাডাইস কনস্ট্রাকশন ও খন্দকার কনস্ট্রাকশন সিমেন্ট কম দিয়ে নিম্নমানের সিসি ব্লক তৈরি করেন।

এ ব্যাপারে মো. সারোয়ার হোসেনকে তাঁর ০১৭১১-৫৪৯১৪০ নম্বরের মোবাইলে বারবার ফোন করেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তাঁর সাইড অ্যাসিস্ট্যান্ড নাজমুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কাজের স্বার্থেই নদীর পাড়ের পাথরগুলো অন্যত্র সরিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণের পর সেগুলো আবার পানিতে ডাম্পিং করা হবে।’ উপজেলা যুবলীগ সহসভাপতি আতিক আহমেদ সৌরভ বলেন, নিম্নমানের সিসি ব্লক তৈরি করতেই তারা গৌরীপুরের নির্জন স্থানটি বেছে নিয়েছে। তাঁর অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি সোয়া লাখ ঘনফুট পাথর সরিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খুশি মোহন সরকার বলেন, ওই বাঁধের কাজের অংশ প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণের জন্য নদীর পাড়ের পাথরগুলো ভৈরবে পর্যাপ্ত স্থান নেয় বলে সেগুলো নরসিংদী জেলার গৌরীপুর গ্রামের নদীর পাড়ে রাখা হয়েছে। প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণের পর সেগুলো আবার বাঁধসংলগ্ন পানিতে ডাম্পিং করা হবে।

ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কমকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে সে দিন আমরা ভৈরব শহর রক্ষা বাঁধের কাজ দেখতে গিয়েছিলাম। নরসিংদীর গৌরীপুর গ্রামের নদীর পাড়ে রাখা সিসি ব্লকগুলো খুবই নিম্নমানের। হাতের স্পর্শেই অনেকগুলো ভেঙে গেছে।’
পাথর সরানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘গৌরীপুর গ্রামের নদীর পাড়ে রাখা পাথরের স্টেক মেপে ১০ হাজার ৬২৬ ঘনফুট পাওয়া গেছে। ভৈরবের নদীর পাড়ে কত পরিমাণ পাথর ছিল তা পানি উন্নয়ন বোর্ডে সংরক্ষিত কাগজপত্র পরীক্ষা করলে বের হয়ে যাবে।’

লিখেছেনঃ আবদুল্লাহ্ আল মনসুর, ভৈরব