বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট অকাল বন্যায় তলিয়ে গেছে হাওর অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি। নদ-নদীর পানি উপচে নিশ্চিহ্ন হয়েছে হাজার হাজার একর ইরি-বোরো ধান। কোথাও কোথাও ধানক্ষেত ডুবে আছে আট-দশ ফুট পানির নিচে। বছরের একমাত্র ধানী ফসল ছাড়াও তলিয়েছে মৌসুমি ফসল পেঁয়াজ, বাদাম, কাউন, ভুট্টা ইত্যাদির ক্ষেত। পানির তোড়ে ধসে গেছে বিভিন্ন স্থানে তৈরি বেড়িবাঁধ। ক্ষেত্রবিশেষে কৃষকের স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি বাঁধেও শেষ রক্ষা হয়নি। গোটা হাওরাঞ্চলের কৃষকের ঘরে ঘরে এখন কান্নার রোল। বানের ঘোলাজল আর চোখের নোনাজল মিলেমিশে একাকার।

অকাল বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল। জানা গেছে, সুনামগঞ্জের দরিয়াবাজ অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় একমাত্র ফসল ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে রবি ফসল। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন খুইয়ে এ অঞ্চলের কৃষকরা আবাদ বাবদ দাদন নেয়া টাকা কীভাবে শোধ করবেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে গভীর হতাশা। ফসলের এই মর্মান্তিক পরিণতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নেত্রকোনার হাওর এলাকার কৃষকরাও। চৈত্র মাসের খরার সময় সেখানে আকস্মিক নেমে আসে উজানের ঢল, ডুবে যায় কাঁচা-পাকা সব ধানের ক্ষেত। অনাগত দিনের অনিশ্চয়তায় কৃষক এখন যারপরনাই বিপন্ন। এদিকে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল একযোগে নেমে আসে কিশোরগঞ্জ হাওরাঞ্চলের ফসলের মাঠে। একের পর এক তলিয়ে যেতে থাকে মাঠভরা ফসল। ফসল রক্ষাবাঁধ ভেঙে যায় অনেক জায়গায়। কোথাও আবার উঁচু বাঁধ উপচে পানির স্রোত নেমে আসে ক্ষেতে।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা এই অভাবনীয় প্রাকৃতিক তাণ্ডব সম্পর্কে জানিয়েছেন, গত পঞ্চাশ বছরেও ‘মরা চৈত্রে’ এমন ভরা বর্ষার প্লাবন দেখেনি হাওরবাসী। বাঁধ ভাঙা ছাড়াও নদ-নদী ফুলে-ফেঁপে ঢেউয়ের আঘাতে দিন-রাত মাটি ফেলে বাঁধ উঁচু করার সম্মিলিত প্রয়াসকে নস্যাত্ করে দেয়। পরিণামে চোখের সামনেই তলিয়ে যায় কৃষকের ঘাম ঝরিয়ে বোনা ধানসহ তাবত্ ফসল। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, গত ২ সপ্তাহে ৪০ হাজার হেক্টর জমির উঠতি বোরো ধান তলিয়ে গেছে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ ও কলমাকান্দা উপজেলায়। মোহনগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পানির তোড়ে এ উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার ১০০ হেক্টর ফসলি জমি, টাকার অংকে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ কোটি টাকা। খালিয়াজুড়ি উপজেলার ৮ ইউনিয়নের ৬ ইউনিয়নই ঢলের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কৃষকদের মতে, সরকারি হিসাবের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।


ভিডিওঃ আসিফ ইকবাল কাকন, কিশোরগঞ্জ ডট কম

 ‘শস্যভাণ্ডার’ বলে খ্যাত হাওরাঞ্চলের ফসল এভাবে নষ্ট হওয়ার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা গোটা দেশের অর্থনীতিতেই কম-বেশি প্রভাব ফেলবে। ধান-চালসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রুখতে বোরো মৌসুমে ভালো উত্পাদন সব সময়ই একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান আশানুরূপ রাখতেও ধানের উত্পাদন ভালো হওয়া দরকার। অথচ আশানুরূপ আবাদ হলেও শেষ পর্যন্ত আকস্মিক বন্যা যে সর্বনাশ করে গেল তা দুশ্চিন্তার কারণ বৈকি। এ অবস্থায় সরকার পক্ষ থেকে দ্রুত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। এরই মধ্যে সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পক্ষে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা)।

তারা হাওর অঞ্চলকে দুর্গত অঞ্চল ঘোষণা করে কৃষকদের কৃষিঋণ মওকুফ ও তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়েছে। যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে এ দাবি মোটেই অমূলক নয়। তবে কৃষিঋণ মওকুফ করলেও সব কৃষক ঋণের দায় থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কারণ, তাদের ওপর রয়েছে মহাজনী ঋণের বোঝা। এই বোঝার ভার লাঘব করার সুদবিহীন নতুন ঋণ মঞ্জুরির বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এক মাঘে শীত যাবে না। অকাল বর্ষণ ও উজানের ঢল ফিরে ফিরে আসতেই পারে। সেই অনিশ্চিত সঙ্কটকে সামনে রেখে হাওরের ফসল বাঁচাতে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের বিকল্প নেই।

এছাড়া শুকনো মৌসুমে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধসহ কৃষকদের উদ্যোগে তৈরি বিনষ্ট বাঁধগুলো আরও উঁচু এবং শক্তপোক্ত করে তৈরি করাও দরকার। তবে তাত্ক্ষণিকভাবে সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান, হাওর অঞ্চলের বিপন্ন কৃষকদের সহায়তা দিতে সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হোক।

কৃতজ্ঞতাঃ দৈনিক আমার দেশ ২৪-০৭-২০১০