ছেলে মোজাম্মেলকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে কৃষি ভর্তুকির ২০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন জমিরউদ্দিন (৪৫)। তিনি বাড়ি ফিরেছেন ঠিকই, তবে একা। ছেলেকে সঙ্গে আনতে পারেননি। পথে ছেলের লাশ পুলিশের হাতে দিয়ে বিপর্যস্ত জমির কোনো রকমে বাড়ি এসে সংজ্ঞা হারান। কৃষি ভর্তুকির টাকা পেলেও ছেলে হারানোর ক্ষতি তিনি কোন ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করবেন_সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে কেবল এ কথাই বলছেন তিনি। বাবা হয়ে ছেলেকে বাঁচাতে না পেরে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন আর মাটিতে মাথা ঠুকছেন।

কিশোরগঞ্জের-চামড়াবন্দর সড়কের করিমগঞ্জের মনসন্তোষ এলাকায় নিয়ামতপুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে বুধবার বিকেলে বাসচাপায় মারা যায় তাঁর ছেলে মোজাম্মেল হক (১২)। কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা একটি বাস তাঁদের সাইকেলকে ওভারটেক করে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ধাক্কা দিলে বাবা ছিটকে রাস্তার পাশে পড়ে যান। ছেলেটি পড়ে রাস্তার ওপর। তার মাথার ওপর দিয়ে বাসটি চলে যায়। মাথা থেঁতলে গিয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় মোজাম্মেল। চোখের সামনে ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান জমির। স্থানীয় লোকজন তাঁকে কিছুটা সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

জানা গেছে, মোজাম্মেল স্থানীয় খামার দেহুন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত। চরম দরিদ্র বাবাকে পড়ালেখার ফাঁকে সাহায্য করত মোজাম্মেল। বাবার সঙ্গে মানুষের ক্ষেতে কাজ করত এই শিশু। সবজির ছোটখাটো ব্যবসাও ছিল তাঁদের। এভাবে কোনো রকমে দিন চলে গেছে তাঁদের ছয়জনের পরিবারের। জমিরের দুই ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলেটিকেই হারালেন তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। সকালে করিমগঞ্জের দেহুন্দা ইউনিয়নের চরদেহুন্দা গ্রামে তাঁদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টির পানি আর চোখের পানিতে একাকার হয়ে শোকে ভাসছে পুরো পরিবার। ভাঙা একটি চালাঘরে থাকে ওরা। ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। এ কারণে ঘরটিও কর্দমাক্ত হয়ে গেছে। সহায়-সম্পত্তি বলতে এই ভাঙাচোরা বসতঘরটিই। বাবা নির্বাক হয়ে মাটিতে বসে আছেন। মা সালমা বেগম (৩৫) বিলাপ করে কাঁদছেন।

মা সালমা জানান, সামনে ঈদ তাই বাবার সঙ্গে যাওয়ার সময় ছেলেকে দুটি মুরগি দিয়েছিলেন তিনি। এগুলো বিক্রি করে জামা কেনার কথা ছিল মোজাম্মেলের। মুরগি বেচলেও ওই টাকা দিয়ে নতুন জামাকাপড় কেনা হয়নি তার। রক্তেভেজা টাকাগুলো পকেটেই ছিল। ছেলের শোকে কাতর সালমা জানান, অভাবের কারণে যখন তাঁদের খুব কষ্ট হতো, তখন এই শিশু মোজ্জাম্মেল তাঁদের সাহস দিত। কথাগুলো বলতে থাকেন আর বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন সালমা। এলাকাবাসীর কোনো সান্ত্বনাই তাঁকে প্রবোধ দিতে পারে না।

করিমগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক সফর আলী জানান, ঘাতক বাসটি আটক করা হয়েছে। এখনো এ বিষয়ে মামলা হয়নি। শুনেছি জেলা পরিবহন মালিক সমিতি পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে।