‘জীবনে বাবার আদর পাইনি। বাবা ভরণ-পোষণ না করায় টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারিনি। আমার অতিলোভী বাবা বিনা কারণে মাকে বঞ্চিত রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বাবা বেঁচে থাকতেও অনাথের মতো আমাকে বড় হতে হয়েছে। ইসলামী আদর্শের নেতা হয়েও তিনি স্ত্রী-কন্যার প্রতি অবিচার করেছেন। বাবার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে তাই বাধ্য হয়েছি।’ কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট সৈয়দ মহিউদ্দিনের মেয়ে সৈয়দা নুসরাত জাহান মীম (১৯) গতকাল শনিবার বিকেলে কালের কণ্ঠের কাছে এভাবেই তাঁর ক্ষোভের কথা তুলে ধরেন।

সৈয়দা নুসরাত জাহান মীমের করা মামলায় পুলিশ তাঁর বাবা সৈয়দ মহিউদ্দিনকে (৫৫) গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বেসরকারি সংস্থা ইসলামী মানবিক উন্নয়ন সংস্থার কুলিয়ারচরের কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে গতকাল আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নিজ কন্যার দায়ের করা ভরণ-পোষণের মামলায় গাজীপুর জেলা জজ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। মহিউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি কুলিয়ারচরের পালতিমা গ্রামে।

পুলিশ ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে সংঘটিত একটি হত্যা মামলায় সৈয়দ মহিউদ্দিনের যাবজ্জীবন সাজা হয়। ১৩ বছর সাজা ভোগের পর ১৯৮৯ সালে তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। সৈয়দ মহিউদ্দিন ১৯৯২ সালে প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহারের অনুমতি ছাড়াই বাজিতপুর পৌরসভার চারবাড়ি এলাকার লুৎফুন্নাহার দিনাকে বিয়ে করেন। পরে পারিবারিক আদালতে খোরপোষ ও বিনা অনুমতিতে বিয়ে করার অভিযোগ এনে ১৯৯৭ সালে শামসুন্নাহার আদালতে মামলা দায়ের করলে তৃতীয় সিনিয়র সহকারী জজ আদালত সৈয়দ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ বাবদ এক লাখ ৬৭ হাজার টাকার ডিক্রি জারি করেন। শামসুন্নাহারের অভিযোগ, সৈয়দ মহিউদ্দিন আজ পর্যন্ত ডিক্রির টাকা পরিশোধ করেননি। এ ছাড়া মহিউদ্দিনের ঔরসজাত একমাত্র মেয়ে সৈয়দা নুসরাত জাহান মীমের কোনো ধরনের দায়িত্ব তিনি নেননি। বাবার স্নেহ-আদর ছাড়াই মেয়েটি বড় হয়। অভিযোগে আরো জানা যায়, ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মহিউদ্দিন ঢাকায় এফিডেভিটের মাধ্যমে মেয়ে মীমকে ত্যাজ্য ও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত ঘোষণা করেন। মীম মামলা করায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন।

আদালত সূত্র জানায়, সৈয়দা নুসরাত জাহান বাবার বিরুদ্ধে গাজীপুর তৃতীয় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ২০০৭ সালের ১০ জুলাই মামলা করেন। ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই আদালত মেয়ের ভরণ-পোষণ বাবদ মহিউদ্দিনকে ৯ লাখ ১২ হাজার টাকা দেওয়ার রায় (ডিক্রি) দেন। রায়ের বিরুদ্ধে মহিউদ্দিন গাজীপুর জেলা জজ আদালতে আপিল করলে চলতি বছরের ১৮ মে আদালত দোতরফা সূত্রে আপিল খারিজ করেন। সূত্রমতে, রায় দেওয়ার পর এক বছর দুই মাস পার হয়ে গেলেও মহিউদ্দিন মেয়ের পাওনা পরিশোধ করেননি। পরে বাদী মীম তৃতীয় সহকারী জজ আদালতে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ চেয়ে আরেকটি আবেদন করলে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

সৈয়দা শামসুন্নাহার জানান, তিনি সফিপুর আনসার একাডেমীতে চাকরি করতেন। মহিউদ্দিন আনসার কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করিয়ে রেখেছেন। পরে বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে তিনি গাজীপুরের একটি সোয়েটার কারখানায় ১২ বছর চাকরি করে মীমকে লালন-পালন করেন। তিনি বলেন, ‘ইসলামের লেবাসধারী ব্যক্তি হয়েও মহিউদ্দিন আমাদের সঙ্গে জঘন্য প্রতারণা করেছেন। টাকা-পয়সার অভাবে মেয়েটিকে লেখাপড়া করাতে পারিনি। আমরা তাঁর নানা অত্যাচার-অবিচারের প্রতিবাদ করায় তিনি আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর জন্য আমাদের মা-মেয়ের জীবন তছনছ হয়ে গেছে।’ কুলিয়ারচর উপজেলা মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি সৈয়দ আবুল কালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মহিউদ্দিন স্ত্রী-কন্যার প্রতি অবিচার করেছেন। আদালতের নির্দেশনাও অমান্য করেছেন। আমরা এ ঘটনার নিন্দা ও মহিউদ্দিনের শাস্তি দাবি করছি।’

গাজীপুর জেলা আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট এম নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘মেয়েটি (মীম) অসহায় বলে আমরা বিনা খরচে আইনি সহায়তা দিয়েছি।’ জামায়াত নেতা জেলহাজতে থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, ইসলামী মানবিক উন্নয়ন সংস্থার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ইসহাক মিয়া বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে তিনি গ্রেপ্তার হননি। মেয়ের দায়ের করা মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।’ কুলিয়ারচর থানার ওসি মো. মুঈদ চৌধুরী জানান, মেয়ের দায়ের করা মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় জামায়াত নেতা মহিউদ্দিনকে আটক করা হয়েছে। একটি হত্যা মামলায় মহিউদ্দিন যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করেন বলে ওসি নিশ্চিত করেন।

– নাসরুল আনোয়ার, হাওরাঞ্চল